পবিত্র শবেবরাত ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস: একসঙ্গে সবার হৃদয়ে গভীর অনুভূতি

বিল্লাল বিন কাশেম

মুসলমানদের জন্য শবেবরাত একটি অত্যন্ত পবিত্র রাত, যেটি তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, মাগফিরাত (মাফ) ও মুক্তির রাত। এই দিন দুটি একত্রে পড়ে, যার ফলে প্রাপ্তির আনন্দ ও অনুভূতির গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়।

এদিকে আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, পৃথিবীর নানা প্রান্তে এক বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হয়— বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এটি একটি বৈশ্বিক উদ্‌যাপন, যেখানে মানুষ তাদের প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে নানা রকম উপহার ও বার্তা আদান-প্রদান করে। তবে এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি অন্য একটি বিশেষ কারণে আরও গুরুত্বপূর্ণ— এটি একই সঙ্গে পবিত্র শবেবরাতের রাতও।

এখানে দুটি আলাদা ঘটনাকে একসঙ্গে মিলিয়ে ভাবলে এটি আমাদের জীবনের গভীর সম্পর্ক ও ভাবনা নিয়ে নতুন উপলব্ধি তৈরি করে। প্রথমত, ভালোবাসা দিবস শুধুমাত্র রোমান্টিক ভালোবাসা প্রকাশের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয় না, এটি একই সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের চেতনা, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করার দিন।

অন্যদিকে শবেবরাত মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এক বিশাল ধর্মীয় রাত, যা আমাদের উপদেশ দেয় কীভাবে আমাদের অন্তরের দিক থেকে পবিত্র হওয়া এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুলগুলো সংশোধন করা যায়। এই দুই দিবস একে অন্যের পরিপূরকতাকে স্পষ্ট করে তোলে। কেননা ভালোবাসা ও দয়া কেবল পার্থিব সম্পর্কেই নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কেও গভীরভাবে স্থান পায়।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের অর্থ ও তাৎপর্য

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের সূচনা হয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে। তখন এটি একমাত্র পাপ্য প্রথার আকারে পালিত হতো। পরবর্তীকালে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং একসময় এটি হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দিবস।

এই দিনটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— এটি শুধু পারস্পরিক ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নয়, বরং এটি মানবিক সম্পর্কের এক দুর্দান্ত উদ্‌যাপন। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, বা সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসার মূল্যায়ন করাও এর অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সমাজের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়ার সংস্কৃতি বিকশিত হয়। এটি যেকোনো ধরনের সম্পর্কের মধ্যে মধুরতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যুগলদের জন্য এটি প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসার প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে পৃথিবী জুড়ে যা ঘটছে তাতে মনে রাখা দরকার, ভালোবাসা শুধু একটি দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

পবিত্র শবেবরাতের তাৎপর্য

শবেবরাত ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা ‘লাইলাতুল বারাত’ নামে পরিচিত। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এই রাতে আল্লাহ তার সৃষ্টিকূলের জন্য পরবর্তী এক বছরের কিসমত নির্ধারণ করেন। মুসলমানরা এই রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, নিজেদের আত্মা ও মনকে পবিত্র করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেন এবং সমস্ত দুঃখ ও পাপের জন্য আল্লাহর মাগফিরাত চান। শবেবরাত মুসলিম বিশ্বের জন্য এক অনন্য রাত, যেটি শুধু আত্মিক উন্নতির জন্য নয়, বরং একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি দেওয়ারও সুযোগ তৈরি করে।

শবেবরাতের রাতটি ইসলামের ইতিহাসে একটি বিশেষ রাত হিসেবেও চিহ্নিত। এই রাতে পৃথিবীর ওপরে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তি বর্ষিত হয়। মুসলমানরা এই রাতে দীর্ঘ সময় জেগে থেকে বিশেষ দোয়া করেন, তাওবা করে নিজেদের ভুলগুলো সংশোধন করতে চান এবং আল্লাহর কাছ থেকে মঙ্গল কামনা করেন। শবেবরাতের রাতটি শান্তির রাত, যেখানে মানুষ একে অপরকে মাফ করে, নিজেদের মনকে পরিষ্কার করে এবং মানবতা ও ভালোবাসার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানায়।

ভালবাসা দিবস এবং শবেবরাতের সমন্বয়

ভালোবাসা দিবসের সূচনা মূলত ধর্মীয় নয়। তবে এই দিনটি কোনো না কোনোভাবে মানবিক মূল্যবোধ ও সম্পর্কের প্রতি আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে। শবেবরাতের মাধ্যমে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়, যেখানে কেবল পার্থিব ভালোবাসা নয়, বরং মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, ক্ষমা ও মাগফিরাতের সম্পর্কটিও উন্মোচিত হয়।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমরা যখন আমাদের প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি, তখন শবেবরাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমাদের এই ভালোবাসার ভিত্তি শুধু পার্থিব জীবনে নয়, বরং এক মহান শক্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শবেবরাত আমাদের শিখিয়ে দেয়, ভালোবাসার প্রকৃত রূপ কেবল মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মধ্যেও নিহিত। এর মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যায়। কারণ আমরা জানি, মানবিক সম্পর্কগুলো ঈশ্বরের বিধান ও নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ হয়।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও শবেবরাতের সঙ্গমে আমাদের জীবন সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এই দুটি দিবস একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করে, যেখানে পার্থিব ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর প্রতি আধ্যাত্মিক ভালোবাসাও প্রকাশিত হয়। এই দিনগুলো আমাদের শেখায়, জীবন কেবল সম্পর্কের মাধ্যমে নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমেও পূর্ণতা লাভ করে।

পবিত্র শবেবরাত ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, একত্রে, আমাদের জীবনে সঠিক পথে চলার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় এবং আমাদের মন ও হৃদয়ে এক নিবিড় শান্তি ও ভালোবাসার আলো প্রবাহিত করে।

লেখক: কবি, প্রবন্ধকার ও গল্পকার

[email protected]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

রক্তাক্ত বাংলাদেশ: ১৯৭১ থেকে ২০২৫

২০০৮ থেকে ২০২৪। বাংলাদেশে শুরু হলো এক রক্তঝরানোর অধ্যায়। হত্যা, খুন, গুম, আয়নাঘর— বিরোধী দলের নেতাদের ওপর অমানুষিক, নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচার। মানবতা বিসর্জন দিয়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে নিজের দেশের

৪ দিন আগে

সবার মুখে ফেব্রুয়ারিতে ভোট, বিরোধ জুলাই সনদ ঘিরে

তবে হঠাৎ করেই ঘুরে গেছে হাওয়া। বদলে গেছে সবার সুর। সবার মুখে মুখে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। কেউ বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতেই হবে। তবে সংস্কার নিয়ে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিন দলের অবস্থান ভিন্

৪ দিন আগে

টেলিগ্রাফের হেডিং— ডাস ক্যাপিটাল

এই সেপ্টেম্বরেই ১৫৮ বছরে পা দিলো সেই বই, যার নাম থেকে এই হেডলাইনের খেলা— কার্ল মার্ক্সের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ডাস ক্যাপিটাল’।

১৮ দিন আগে

জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং বিকেন্দ্রীকরণ

একটি জাতির উন্নয়নের ভিত্তি তার জনশক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা (Demographic Stability) অর্জন করা এখন আর কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অং

১৮ দিন আগে