ডিসি সম্মেলন

ক্ষমতা নয়, জনসেবক হওয়া জরুরি

ড. মিহির কুমার রায়
ড. মিহির কুমার রায়। ফাইল ছবি

প্রতি বছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করার রেওয়াজ রয়েছে। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনী প্রধান, জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনাররা বৈঠক করেন। ডিসি সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের কার্য-অধিবেশন, এছাড়া একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনা, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও একটি সমাপনী অনুষ্ঠান থাকে।

কার্য অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকেন। কিন্তু এবার ভিন্ন পরিস্থিতে ডিসি সম্মেলন চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী (১৬-১৮ই ফেব্রুয়ারি) সময়ে তিন দিন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার চার দিনের পরিবর্তে তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এই প্রথম ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলন বিগত সময়ের বিবেচনায় ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের সম্মেলনে ডিসিদের কারও আজ্ঞাবহ না হয়ে নির্ভয়ে মাঠ প্রশাসন পরিচালনার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি-কৌশল বাস্তবায়নে তাদের আন্তরিক হতে বলা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ৩৪টি অধিবেশন হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টিই ছিল কার্য অধিবেশন। সম্মেলনে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের কাছ থেকে এক হাজার ২৪৫টি প্রস্তাব এসেছিল। তার মধ্যে ৩৫৪টি প্রস্তাব কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদিকে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ডিসি সম্মেলনের কার্যকরি অধিবেশন ও ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।

জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন উদ্বোধন প্রধান উপদেষ্টাকে সম্বোধন করা হয়েছে প্রধান অতিথি হিসেবে, এতে ‘কষ্ট পেয়েছেন এবং বলেছেন যেন আমাকে খেলার মাঠ থেকে বাইরে রাখা হলো।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রধান অতিথি বলাতে আমি একটু কষ্ট পেলাম। যেন আমাকে বাইরে রাখা হলো এ খেলার মাঠ থেকে। হওয়া উচিত ছিল আমি খেলার ক্যাপ্টেন। আমি অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিতে চাই না। আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে বক্তব্য দিতে চাই। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যা কিছু করণীয়, সেই করণীয়ের দায়িত্বে আমরা সবাই আছি, এমনভাবে যেমন চিন্তা করুন আমরা একটা খেলার- ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার খেলোয়াড়। আমাদের আজকে এ খেলোয়াড়দের সমাবেশ। প্রস্তুতি নেওয়া, যে আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে, অবজেকটিভ কী হবে, আমাদের কার কী করণীয়- এসব ঠিক করা।’

মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘ডিসিদের জনবান্ধব প্রশাসন গড়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই তিনি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন তথা যাচাই বন্ধের ঘোষণা দেন। জেলার পাসপোর্টও ডিসিরাই তদারকি করেন। এভাবে নাগরিক হয়রানির যেসব উপলক্ষ আছে, সেগুলো বন্ধে ডিসিরা উদ্যোগী হতে পারেন। সচিবালয়ে থাকা সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তার চেয়ে জেলা প্রশাসকের সরাসরি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। সে জন্য ডিসিদের সদিচ্ছা থাকলে সাধারণ মানুষকে প্রশাসনিক জটিলতা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব। ডিসি সম্মেলনে সুপারিশের ক্ষেত্রে এ বিষয় প্রাধান্য পেলে মানুষ উপকৃত হতে পারে।’

এবারের সম্মেলনের প্রধান প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম জোরদারকরণ. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্ম-সৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ই-গভর্ন্যান্স, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ রোধ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, পর্যটনের বিকাশ, আইন-কানুন বা বিধিমালা সংশোধন। সর্বোপরি জনস্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়গুলোর অগ্রাধিকার।

এছাড়াও সম্মেলনে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ডিসিদের নির্ভয়ে কাজ করা, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, মব জাস্টিসের নামে অরাজকতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়াসহ নতুন সরকারের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বার্তা রয়েছে।

সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও বলেছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার জেলা প্রশাসকদের জনগণের নিপীড়নে কাজে লাগিয়েছে। নিজেদের অপকর্ম আড়াল করার জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আগামী দিনে দলীয় আনুগত্যে জনগণের নিপীড়নের কাজে ব্যবহৃত না হতে ডিসিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

উপদেষ্টারা বলেছেন, ডিসিদের রাষ্ট্রের সেবা করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। ভালো মানসিকতা নিয়ে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য ভালো কিছু করতে হবে। আগামী ১০ মার্চের মধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ৮০ শতাংশ ই-নামজারির কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ডিসি সম্মেলন শেষে সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ সব কথা বলেন তিনি।

জমির নামজারি (মিউটিশন) করাও ডিজিটাল পদ্ধতির কাজ চলমান রয়েছে-এ কথা জানিয়ে ভূমি উপদেষ্টা বলেন, ‘ভূমির কাগজপত্রের কাজ নিয়ে মানুষের হয়রানি বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। জেলা প্রশাসকরা যাতে এ কাজে সহায়তা করবেন সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আসন্ন রমজান সামনে রেখে মার্চ এবং এপ্রিল এ দুই মাসে দেড় লাখ টন করে মোট ৩ লাখ টন চাল দেওয়া হবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায়, এ কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এছাড়াও ৩০ টাকা কেজি দরে ১৫ কেজি করে এ কর্মসূচির আওতায় ৫০ লাখ পরিবার চাল পাবে। আর ঈদে পাবে বিনামূল্যে চাল পাবে ১ কোটি পরিবার।

জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘দেশে এখন পর্যন্ত যত ভালো নির্বাচন হয়েছে সেটা প্রশাসনের হাত দিয়ে হয়েছে। আবার খারাপ নির্বাচনও প্রশাসনের হাত দিয়েই হয়েছে। প্রশাসনকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সেভাবেই তারা কাজ করে। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রশাসনের হাত দিয়েই ভালো নির্বাচন হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ প্রশাসনিক একরাশ কঠোর বার্তা পেলেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘নির্বাচন ঘিরে ইসির যতটুকু ক্ষমতা আছে তার সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করবে। একইসাথে সারা দেশের জেলা প্রশাসকরা যাতে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেন সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

সিইসি বলেন, ‘আমরা ছেলেবেলায় পড়েছি জেলা প্রশাসকরা হলো- সরকারের চোখ, হাত এবং মুখ। এই ডিসিদের চোখ দিয়ে সরকার দেখে, মুখ দিয়ে সরকার বলে এবং হাত দিয়ে সরকার কাজ করে। কিন্তু এই চোখ, মুখ এবং হাত আজ নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচন পরিচালনায় উচ্চ পর্যায়ের কোনো চাপ ডিসিদের ওপর যাবে না। যদি চাপ আসে সেটা ইসি অবজারভ করবে। সুতরাং মাঠ পর্যায়ে একটি সুষ্টু নির্বাচন উপহার দিতে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে। কোন ব্লেমিং গেম শোনা হবে না। কার কারণে কী করতে পারে নাই এসব শোনা হবে না। মানুষরাই প্রশাসনে যোগ দেন। পরবর্তীতে ডিসি হয়ে কাজ করেন।’

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ফ্যাসিস্ট সরকার রাষ্ট্রের এত বড় সম্পদকে জনগণকে অত্যাচার-নির্যাতন ও নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য অপব্যবহার করেছে। আগামী দিনে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা যেন প্রশাসন ক্যাডারের সম্ভাবনাগুলোকে জনগণের নিপীড়নে কাজে না লাগান। আগামী দিনে যে দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা যেন প্রশাসন ক্যাডারের অসীম সম্ভাবনাগুলোকে জনগণের নিপীড়ন কাজে না লাগান। সংবিধানে যেমনটা বলা হয়েছে, জনগণের সেবা করার কাজে যেন তাদের ব্যবহার করা হয়।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। এটিকে সমূলে বিনষ্ট করতে না পারলে দেশের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হবে না। সব লেভেল থেকে দুর্নীতি কমাতে হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্য-অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, ‘জেলা প্রশাসকরা সীমান্ত এলাকায় আরও বেশি হারে বিজিবি মোতায়েন, নৌপথের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে নৌ-পুলিশ বৃদ্ধি করার কথা বলেছেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকা ও শিল্পপুলিশের জনবল বৃদ্ধির কথাও বলেছেন তারা। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বে সঙ্গে দেখছি ও বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক। কিন্তু এটাকে আরও উন্নত করার অবকাশ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। যাতে আরও উন্নতি ঘটে, সেজন্য সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করা হচ্ছে।’

দেশে জনপ্রতিনিধি না থাকায় জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এমনকি অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি পেতে তারাও দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘দেশে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় তারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। জেলা প্রশাসকরা প্রতিনিয়তই বলছেন দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি দিতে। এ বিষয়ে হয়তো দ্রুই একটা সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে।’

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় জনপ্রতিনিধি নেই। তাদের দায়িত্বগুলো বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকরা পালন করছেন। যে কারণে তাদের নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ডিসি সম্মেলনে সেগুলো শোনা হয়েছে এবং পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায়ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে যা চলমান। দ্রুতই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন আয়োজন, অন্যথায় প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে।’

প্রায় প্রতিবছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা তাদের ক্ষমতার পরিধি আরও বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। তাদের কর্তৃত্ব বাড়ানো, বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ যৌক্তিক কিছু প্রস্তাবনা লিখিতভাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সরকারপ্রধানের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে। আবার একাধিক ডিসি আক্ষেপ করে বলেছেন, তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আলোচনায় প্রাধান্য পায়নি। সার্বিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেসব প্রস্তাব নাকচ হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের মৌলিক সমস্যাগুলো হয়তো আগামীতে ক্ষমতায় আসা যেকোনো সরকার সমাধান করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারে। কেননা অতীতেও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সেসব কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। ফলে প্রত্যেক বছরই ঘুরেফিরে একই প্রস্তাব লিখিতভাবে তুলে ধরা হয়। সম্মেলনে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের কাছ থেকে যে সকল প্রস্তাব এসেছে তার মধ্যে ৩৫৪টি প্রস্তাব কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সরকারের নীতিনির্ধারক এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের মধ্যে সামনাসামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে প্রতি বছর ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষ হয়েছে । তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ সম্মেলনে বিভিন্ন মহল থেকে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ উঠে এসেছে। বিশেষত দেশে আইনের শাসন বজায় রাখতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে এ সম্মেলনে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটের দিকে লক্ষ করলে এ আহ্বান তথা ডিসিদের পেশাদারত্ব আচরণের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগ হিসেবে সরকার ব্যাপক রদবদল করেছে প্রশাসনে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এ দেশে ডিসিদের পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত ডিসিদের জেলায় তিন ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। রাজস্ব আদায়, বিচারসংক্রান্ত এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ তাদের ওপর অর্পিত থাকে। এসব কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে পালনে দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারলে কোনো রাজনৈতিক দলের শাসনযন্ত্র হবে না তারা। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।

জেলা প্রশাসক নিয়োগ হতে হবে যোগ্যতার মানদণ্ডে। দল বা সরকারের আনুগত্যের বদলে কিংবা প্রার্থীর রাজনৈতিক আনুগত্যের বদলে পেশাদারত্বের প্রতি গুরুত্ব দেয়া এক্ষেত্রে সর্বাধিক জরুরি। তাই কেউ নিজেকে পদবঞ্চিত দাবি করলেই তাকে পদায়ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে জনপ্রশাসনে জনসেবা উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে দায়িত্বরতরা জনগণের আস্থা হারিয়েছেন। তবে নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার করতে হবে। সেক্ষেত্রে ডিসি সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্বশীল হওয়ার পাশাপাশি আরো যে সুপারিশ প্রস্তাবিত হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। সবকিছু যাতে ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে সেজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতায়িত করার বিষয়টি নিয়ে বহু বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে চান না। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের জন্য মাঠ প্রশাসন এখনও অনেক ক্ষেত্রে ‘কেন্দ্রের দিকে’ তাকিয়ে থাকে। এতে সাধারণ মানুষ সরকারী সেবা পেতে বিড়ম্বনা ও দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে। জেলা প্রশাসক ও জন প্রতিনিধিদের মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীক যে ভারসাম্য তা অনেক ক্ষেত্রেই বিঘ্নিত হয় এবং উভয় পক্ষই আরও বেশী প্রতিনিধিত্ব চান যা ডিসিদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়। ফলে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা  বাস্তবায়নে কতটুকু সফলকাম হবে তা সময়ই বলে দেবে। তিন দিনের এ সম্মেলন শেষে জেলার প্রশাসকগণ ফিরে গেছেন তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে এবং প্রত্যাশার বিষয় হলো মাঠ পর্যায়ের সম্পর্কে সরকারের উপলব্ধির পরিসর বাড়াতে জেলা প্রশাসকগণ অবদান রাখবেন যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জেলা প্রশাসকদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করবে।

লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে