সম্পর্কের টানাপোড়েনে যুক্ত হলো কাঁটাতারের বেড়া

এস এম জামান

বাংলাদেশ-ভারতের অন্তত পাঁচটি সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া তৈরির উদ্যোগ নেয়ার পর বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। গত শুক্রবার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের কাজ শুরু করলে বিজিবি ও স্থানীয়রা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদের মুখে কাজ বন্ধ করে বিএসএফ। এসব ঘটনায় রোববার বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্রস‌চিব মো. জসীম উদ্দীনের দপ্ত‌র থে‌কে বে‌রি‌য়ে সাংবা‌দিক‌দের ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে।

প্রণয় ভার্মা জানান, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবি এ ব্যাপারে যোগাযোগ করছে। আমরা আশা করি তাদের মধ্যকার আলোচনা বাস্তবায়িত হবে এবং অপরাধ মোকাবিলায় একটি সহযোগিতামূলক পদ্ধতি থাকবে।

গত ৫ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের হাইকমিশনারকে দ্বিতীয়বারের মতো তলব করল। এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে প্রণয় ভর্মাকে তলব করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের অভিযোগ, ভারতের কাঁটাতারের বেড়া তৈরির উদ্যোগ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।  শূন্যরেখার ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থাপনা বেআইনি।  

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শনিবার বিজিবি-বিএসএফের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও বিএসএফ প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন। পরে বিএসএফ জানায়, আপাতত বেড়া তৈরির কাজ বন্ধ থাকবে।

এদিকে রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, পাঁচটি এলাকায় ভারত বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে লালমনিরহাটের তিন বিঘা করিডোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, কুমিল্লা ও ফেনী।

উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তের চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে তিন হাজার ২৭১ কিলোমিটার ইতিমধ্যেই বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে ভারত।  বাকি আছে ৮৮৫ কিলোমিটার। তার মতে, আগের সরকার ১৬০ স্থানে বেড়া নির্মাণের সুযোগ বা অনুমতি দিয়ে ভুল করেছে।

১৯৭৫ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, শূন্যরেখার দুই পাশে ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থাপনা, সীমান্ত রক্ষী বা সশস্ত্র কর্মী রাখা যাবে না। যদিও রোববার হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে দাবি করা হয়েছে, বিগত বেশ কয়েকদিন ধরেই সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় ভারত নিজেদের জমিতে কাঁটাতারের বেড়া দিতে গেলেও বিজিবির বাধার মুখে পড়েছে। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সুসম্পর্কে বড় ধরনের অবনতি হয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, যা নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার দাবি জানালেও ভারত সরকার তার ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে দিল্লীতে অবস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা সুবিধা কার্যত বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ভিসার পরিবর্তে কয়েকশ জরুরি ভিসা দিচ্ছে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেড়শ দিন পার করলেও মাত্র একবার টেলিফোনে কথা বলা ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ হয়নি তাঁর।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক ছাড়া দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে এখনও কোনও সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের প্রতিটি ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এসব প্রতিবাদপত্রে সব সীমান্ত হত্যার তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।

ছাত্র আন্দোলনের জেরে ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস।  একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় খুলনা এবং কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী বন্ধন এক্সপ্রেস এবং নিউ জলপাইগুড়ি ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী মিতালি এক্সপ্রেসও। কবে থেকে এই ট্রেনগুলি আবার চালু হবে, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত দুই দেশের সরকারের পক্ষ কিছু জানানো হয়নি।  তবে ভারতের সাথে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।

এছাড়া বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়াত্ত ও বেসরকারির সংস্থার কাজও।  সেগুলো এখনো শুরু করা যায়নি।  পাওনার দাবিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ভারতের আদানি পাওয়ার কোম্পানি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে ভারতের উদ্বেগ—এই দুটোই এখন দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়।  আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সরব রয়েছে ভারত।  যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি অতিরঞ্জিত দাবি করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনার দেড় দশকেরও বেশি শাসনকালে প্রতিবেশি ভারতের সাথে সম্পর্ক সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্কে শীথিলতা এখন স্পষ্ট।

এদিকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে ভারত বিরোধীতা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।  বিশেষ করে রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বপ্ন দেখা বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যেও ভারতবিরোধীতার বিষয়টি স্পষ্ট। বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো সব সময়ই ভারতবিরোধী।  দেশের বামদলগুলোরও মনোভাবও ভারতবিরোধী।

দুই প্রতিবেশী দেশের এই সম্পর্কের অবনতি দুই প্রান্তের সাধারণ নাগরিকদের অনেকেরই অপছন্দ, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, চিকিৎসাসহ নানাভাবে নির্ভারশীল।  কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে জোড়া লাগবে কবে, কিভাবে-তা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়ে যাবে-এটা যেমন নিশ্চিত, তেমনি বাংলাদেশের এখনকার সরকার বা আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারাও যে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে সেটিও নিশ্চিত। তাই কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা দুই দেশের সম্পর্ক আপাতত সহজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমই দেখতে পান।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে