নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি পরিবারই আছিয়াদের রক্ষাকবচ

জাকির আহমদ খান কামাল

নৈতিক শিক্ষার প্রথম যে দিকটি রয়েছে তা হলো— শিশুকে বোঝানো নৈতিক শিক্ষা কী? পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, বন্ধু-বান্ধব ও নিকট পরিবেশ— মূলত এসব স্থান থেকেই শিশু তার পার্থিব জীবনের নৈতিকতার প্রাথমিক ধারণা লাভ করে। সেই সময় যদি শিশুকে ভালো ও মন্দের পার্থক্য বোঝানো যায়— কোন কাজটি করা উচিত, কোনটি নয়; কোনটা খারাপ গুণ, কোনটা ভালো; কোনটা কল্যাণকর, কোনটা অকল্যাণকর; কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা—এসব বিষয়ে যৌক্তিক ধারণা দিয়ে শিশুর মধ্যে যৌক্তিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে নৈতিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।

বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে শিশু নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে এবং তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে। তবে নৈতিক শিক্ষা কোনো সহজ বিষয় নয়— এটি একটি অর্জনের বিষয়।

নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক মাধ্যম হলো পরিবার। কারণ একটি শিশু তার শৈশবে পরিবারের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করে এবং তার জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলো পরিবারের মাধ্যমেই অভিজ্ঞতা হিসেবে পায়। শিশু যদি নিজের চিন্তা, ভাবনা ও আদর্শ অনুসারে জীবনযাপন করতে চায়, তবে তার নিজ পরিবারকে এ বিষয়ে আগে থেকেই সচেতন হতে হবে।

নৈতিক শিক্ষা একজন শিশুর জীবনে সর্বপ্রথম যে গুরুত্ব নিয়ে আসে তা হলো তার চারিত্রিক বিকাশ। নৈতিক শিক্ষা বলতে মূলত চরিত্র গঠনের কথা বোঝানো হয়েছে। এর মাধ্যমেই শিশু নিজের চারিত্রিক উন্নতি সাধন করে এবং নৈতিকতার প্রকাশ ঘটায়। আর নৈতিকতা হলো একজন শিশুর তথা একজন ব্যক্তির জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যার ভিত্তিতে সে জীবনে ভালো কিছু অর্জন করতে পারে।

ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পর নির্ভরশীল। ব্যক্তি যদি মা-বাবা তথা পরিবার বা নিজস্ব পরিবেশ থেকে ভালো শিক্ষা গ্রহণ করে, তবে সে একটি ভালো নৈতিক জীবন গড়ে তুলতে পারবে। আর যদি ব্যক্তি সর্বত্র মন্দ শিক্ষা পায়, তবে সে অনৈতিকতার মধ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এতটাই নৈতিকভাবে অবনমিত হয়েছে যে সবখানেই মন্দ লোক ও মন্দ স্বভাবের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে।

এভাবে যদি আইন হয় নৈতিকতার পক্ষে, ব্যক্তির পক্ষে—তবে তা অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি আইন হয় নৈতিকতা ও ব্যক্তির বিপক্ষে, তাহলে ব্যক্তি মন্দ পথ খুঁজে নেবে। তাই জেনা-ব্যভিচারের মতো অন্যায় অপকর্ম প্রতিরোধে যেমন ব্যক্তির সংশোধন জরুরি, তেমনি সমাজের ন্যায়নিষ্ঠ পরিবর্তনও আবশ্যক।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলেছিলেন, ‘আমি বাবার কাছে ঋণী জীবনের জন্য, কিন্তু আমার শিক্ষকের কাছে ঋণী আমার সুন্দর জীবনের জন্য।’

আছিয়াদের সুন্দর জীবন নষ্টের জন্য দায়ী কে? আছিয়ার মৃত্যু আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? সময় এসেছে তা অনুসন্ধানের। প্রতিটি জীবনের জন্য মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু অস্বাভাবিকতা নিয়েই আমাদের বুকে হিমালয়ের মতো ভারী হয়ে চেপে বসে। সেই চাপাকান্না বুকে নিয়েই জীবন কাটে আছিয়াদের পরিবার।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আটজনের একজন নারী ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে তিন হাজার ৪৩৮টি শিশু ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে আরও বেশি। এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের নিচে। সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে রয়েছে ৯৩৩ জন।

গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী বা পরিচিতদের দ্বারাই শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়।

অধিকার কর্মীরা বলছেন, সেক্ষেত্রে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে মা-বাবার সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কেবল ঘরের বাইরের অপরিচিতদের নয়, বরং পরিচিত-নিকটাত্মীয়দের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের যৌন শিক্ষা দেওয়া এবং কোন ধরনের স্পর্শ ভালো, আর কোনটা খারাপ— এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করাও জরুরি এবং এগুলো পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা প্রয়োজন।

তবে অধিকারকর্মী সুলতানা বলেন, ‘পাঠ্যক্রমে আমাদের এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়গুলো সহজভাবে নেওয়া যায়নি, এমনকি কিছু পাঠ্যপৃষ্ঠাও স্ট্যাপলার দিয়ে আটকানো হয়েছে।’

ফলে যেমন সচেতনতা তৈরি হয়নি, তেমনি শিশুরাও হয়েছে বঞ্চিত। এ ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে সতর্ক করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাশাপাশি অপরাধ রোধে সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষা, বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য। ধর্মীয় শিক্ষাই হলো নৈতিক শিক্ষার মূল ভাণ্ডার। এই বিষয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে ধর্ষণ-ব্যভিচার প্রতিরোধে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি—

  • নারীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণে ধর্মীয় শিক্ষা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
  • নারীর অশ্লীল উপস্থাপনা ও তাদের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রতিরোধ করতে হবে;
  • পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এ বিষয়ে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে;
  • ধর্ষণ-জেনা-ব্যভিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি ৯০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে জনসমক্ষে কার্যকর করতে হবে;
  • মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; এবং
  • আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ ও হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

ক্রমাগত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ বেড়েই চলেছে। আছিয়ার ওপর পরিচালিত নির্মম নির্যাতন ও এর জের ধরে তার মৃত্যুকে ঘিরে দেশ জুড়ে সব শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতিক্রিয়া এই বার্তাই দেয় যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।

‘আছিয়া’ এখন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, যেমন সীমান্ত হত্যার প্রতীক হয়ে আছেন ‘ফেলানী’। সেই ফেলানী থেকে আছিয়া— আর যেন কোনো ক্ষণজন্মা নারী এভাবে অপরাধপ্রবণতার বলি হয়ে প্রাণ বিসর্জন না দেয়— এটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও কলাম লেখক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে