জাগ্রত ছাত্র জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা

মো. ইলিয়াস বিন কাশেম
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ০৮: ৪৯

একটি জাতির চেতনার শিখা জ্বলে ওঠে যখন তার যুবসমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আমাদের দেশের ইতিহাসে ছাত্র জনতা বহুবার জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে জাগরণ ঘটিয়েছে। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলন আবারও প্রমাণ করেছে, দেশপ্রেম ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার সাহসিকতা এখনো আমাদের তরুণদের অন্তরে জীবিত।

এই আন্দোলনের পেছনে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, যে স্বপ্নের জোয়ার তা কেবল ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি সুদূরপ্রসারী সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের সংকেত। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো— এই জাগরণকে টেকসই পরিবর্তনে রূপান্তরিত করতে হলে কী করণীয়? আমরা কোন পথে হাঁটব? এবং কাদের চিন্তা-চেতনা গ্রহণযোগ্য পথ দেখাতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করা যাক এ উপসম্পাদকীয়তে।

পরিবর্তনের ভূমিকায় ছাত্র-জনতা

আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষার্থীরা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তারা এখন রাজপথে, সংবাদের শিরোনামে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়। তারা চায় একটি ন্যায্য সমাজ, যেখানে মেধা-পরিশ্রম ও সততার মূল্যায়ন হয়। তারা চায় এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে দুর্নীতি দমন হয় বাস্তবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় প্রতিটি স্তরে, এবং প্রশাসন হয় জনগণের জবাবদিহিতার আওতায়। তাদের চাওয়া একটি সত্যিকারের সুশাসিত বাংলাদেশ।

কিন্তু এই চাওয়াগুলো বাস্তবায়নের পথে রয়েছে বহু বাধা, বহু ঐতিহাসিক সংকট এবং পুরাতন মানসিকতার জড়তা। এ থেকে উত্তরণের জন্য চাই চিন্তার মুক্তি, কাঠামোগত সংস্কার ও নীতি-পরিবর্তন। এবং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই যারা আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছেন তাদের চিন্তা-দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে।

চিন্তার পরিসরে পরিবর্তনের ছাপ

পরিবর্তন কোনো একক চিন্তা দিয়ে সম্ভব নয়। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখানে নানামুখী চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের সমন্বয় প্রয়োজন। যেমন—

নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি: যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের মধ্যে জনদাবি বুঝে তাতে সাড়া দেওয়ার সদিচ্ছা থাকতে হবে। প্রশাসনের মধ্যে সততা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষকদের চিন্তা: শিক্ষক সমাজ তরুণদের কাছে আদর্শ। তাদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ, মানবতা ও যুক্তিবোধ জাগিয়ে তোলা। তারা যেন দলীয় স্বার্থে নয়, জাতীয় স্বার্থে চিন্তা করেন— এটাই সময়ের দাবি।

সচেতন নাগরিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি: সমাজ কর্মী, সংস্কৃতি কর্মী, মিডিয়া ব্যক্তিত্বদেরও ভূমিকা রয়েছে। তারা যেন ছাত্র-জনতার চেতনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাস্তবধর্মী দাবি ও প্রতিকারমুখী পদক্ষেপ তুলে ধরেন।

তরুণ নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি: ২০২৪ সালের আন্দোলন প্রমাণ করেছে, নতুন নেতৃত্ব উঠে আসছে। এদের চিন্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তারা স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়ার ‘অ্যাকটিভিস্ট’ নয়, তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক।

বাস্তবায়নের পথনির্দেশ: কোন কোন খাতে সংস্কার জরুরি?

শিক্ষা খাতের রূপান্তর: আমরা এখনো মুখস্থভিত্তিক শিক্ষা থেকে বের হতে পারিনি। চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কোর্স ও কারিকুলাম গঠন করতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর, গবেষণানির্ভর ও কর্মমুখী শিক্ষা কার্যকর করতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা: যে রাষ্ট্রে টিআর-কাবিখার চাল চুরি হয়, সেই রাষ্ট্রে জনতার ভরসা থাকে না। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশাসনিক জবাবদিহিতা: একজন সচিব, ডিসি বা ইউএনও যদি মনে করেন তারা কারও জবাবদিহিতায় নেই, সেটি হবে গণতন্ত্রের পরিহাস। জবাবদিহিতার কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

চাকরি খাতের সংস্কার: বিসিএস বা সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও সময়োপযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগ দীর্ঘসূত্রতা, কোটা নিয়ে বিতর্ক ও পক্ষপাতমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা: একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম পারে রাষ্ট্রকে আয়নায় দেখতে সহায়তা করতে। সেন্সর ও ভয়ভীতি ছাড়া সত্য প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ছাত্র জনতার আন্দোলনকে ‘নতুন সামাজিক চুক্তি’র পথে রূপান্তর

আমরা যদি এই জাগরণকে শুধু ‘প্রতিবাদ’ হিসেবে দেখি, তাহলে তা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এটিকে ‘নতুন সামাজিক চুক্তি’র সূচনা হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে এটি একটি নয়া দিগন্তের পথ দেখাবে।

এই চুক্তির মূল বক্তব্য হতে পারে—

  • রাষ্ট্র জনগণের এবং এটি জনগণের কল্যাণেই থাকবে;
  • তরুণরা রাষ্ট্রের পরিচালনায় অংশ নেবে;
  • রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শনিষ্ঠ ও নৈতিক রাজনীতি চর্চা করবে; এবং
  • প্রশাসন থাকবে স্বচ্ছ, মানবিক এবং জবাবদিহির আওতায়।

এই চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক শ্রবণ ও অংশগ্রহণমূলক নীতি। একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় পৌঁছানো সমাধানই দীর্ঘস্থায়ী হয়।

কার চিন্তা অগ্রাধিকার পাবে?

এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো— পরিবর্তনের চিন্তায় কে নেতৃত্ব দেবে?

আমার মতে, নেতৃত্ব দিতে হবে সেই তরুণদের, যারা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। যাদের হাতে প্ল্যাকার্ড ছিল, কণ্ঠে স্লোগান ছিল, চোখে ছিল আগামীর স্বপ্ন।

এই তরুণদের চিন্তা যেমন কার্যকর, তেমনি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কারণ, তারা ব্যক্তিস্বার্থে নয়, সমষ্টির স্বার্থে কথা বলেছে। তাদের চিন্তায় যে বৈপ্লবিকতা আছে, তা কেবল আবেগের নয়, বিশ্লেষণমূলকও বটে।

আশার নতুন দিগন্ত

জাগ্রত ছাত্র জনতার এই আন্দোলন শুধু একটি ঘটনার প্রতিফলন নয়, এটি একটি চলমান চেতনার প্রতীক। এই চেতনাকে নষ্ট না করে, সঠিকভাবে লালন করে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উদার, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তোলাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

নানামুখী চিন্তার সম্মিলন, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সংলাপ এবং ভবিষ্যৎমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি এমন বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি তরুণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে।

ছাত্র-জনতার চেতনা কখনো নষ্ট হয় না। বরং, সেটি একটি জাতিকে বারবার তার মূল কক্ষপথে ফিরিয়ে আনে। আজ সেই ইতিহাসই পুনরাবৃত্তি করছে। সময় এসেছে, সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

যুক্তরাজ্যে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে পারবে অন্তর্বর্তী সরকার?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফরে রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই সফরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

৮ দিন আগে

সাম্রাজ্যবাদ: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে হালের ডিপ স্টেট— একই মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ!

হালের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশবাদের নয়া কৌশলে দাবার ছকের নতুন গুটি জর্জ সোরেসের ‘ডিপ স্টেট’! এ কালের কাবলিওয়ালারা আক্রান্ত নিজ দেশীয় দোসরদের মাধ্যমেই সেই সাম্রাজবাদের প্রসার ঘটিয়ে চলেছে দেশে দেশে। আর ডিপ স্টেটের প্রভুরা দেশীয় দোসরদের ব্যবহারের পর কাজ শেষে ছুড়ে ফেলে দেবে আস্তাকুঁড়ে। তবে ততদিনে সাড়ে সর্

১৪ দিন আগে

হাইকোর্টের যে রায় ঘিরে আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন

এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ গত বছরের পাঁচই জুন হাইকোর্ট যখন সরকারি চাকরিতে কোটা বহালের পক্ষে রায় ঘোষণা করেছিল, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কেউ তখন ধারণাও করতে পারেনি যে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে তাদের টানা দেড় দশকের শাসনের পতন ঘটে যাবে।

১৫ দিন আগে

শিক্ষায় অর্থায়ন: নিম্নমুখী বরাদ্দে ঊর্ধ্বমুখী অর্জন সম্ভব নয়

বৈষম্যের দেয়ালে ঘেরা এই বিশ্বে এখনও ২০ কোটির বেশি শিশু রয়েছে সাধারণ শিক্ষার বাইরে। যারা যাচ্ছে, তারাও আবার অনেক বিদ্যালয়ে গিয়ে যা শেখার তা শিখছে না। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে নিম্ন আয়ের দেশে মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, আবার কম আয়ের দেশে এই সংখ্যা আরও

১৮ দিন আগে