ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠক: নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রণয়নের ইঙ্গিত

সাইমন মোহসিন
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৫, ২১: ৩০
হোয়াইট হাইসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বৈঠক নজিরবিহীন বাদানুবাদে ভেস্তে যায়

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক বৈঠক বিশ্ব কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই বৈঠক যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় মিত্রদেশ এবং ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। বৈশ্বিক অঙ্গীকার থেকে পিছু হটায়, বৈশ্বিক আইনব্যবস্থা এবং মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্কের দৃঢ়তার প্রতীক হবে বলেই আশা করছিলো অনেকে। কিন্তু ট্রাম্প এই বৈঠকে ইউক্রেনের নেতৃত্ব নিয়েই প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে বক্তব্য দিয়েছেন।

এই আকস্মিক আচরণ, কিংবা বলা উচিৎ অসদাচরণ, ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করবে এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে গভীরভাবে পুনর্গঠিত করার হুমকি তৈরি করেছে।

উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। গত শুক্রবার লাইভে ট্রাম্প-জেলনেস্কির তুমুল ঝগড়ার ভিডিও বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয়েছে।

এরই জের ধরে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউজ থেকে চলে যেতে বলা হয়। বাতিল করা হয় পূর্ব নির্ধারিত যৌথ সংবাদ সম্মেলন। ট্রাম্প কথা কাটাকাটির সময় জেলেনস্কিকে কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য বলেন। একইসঙ্গে জেলেনস্কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন বলেও অভিযোগ করেন। জেলেনস্কির ওয়াশিংটন সফরে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, যা এই পরিস্থিতির কারণে হয়নি।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সবসময়ই লেনদেনকেন্দ্রিক। তিনি বহুপাক্ষিক সহযোগিতার চেয়ে একক সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। তার প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী, সম্পর্ক জোরালো করতে সচেষ্ট। ইউরোপীয় মিত্রদের পাশ কাটিয়ে চলা এবং ইউক্রেনকে দোষারোপ করা তাদের নীতির অংশে পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামো বিবেচনায় এই আচরণ আমূল পরিবর্তন। এই অবস্থান ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা দুর্বল করেছে। ইউরোপীয়দের বিশ্বাস এতে রাশিয়া সুবিধা পাচ্ছে, এবং তারা এক্ষেত্রে সঠিক ধারণাই করছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের এই নীতি রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী অভিলাষাকে উৎসাহিত করবে।

বিশ্বায়নের ইতিকালে, সংরক্ষণবাদী নীতির উত্থান বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে আরও জটিল করেছে। ট্রাম্পের লেনদেনকেন্দ্রিক কূটনীতি এই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার "আমেরিকাই প্রথম" নীতি বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন এবং অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতিগুলি বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে আন্তজাতিক নিয়মভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার অবক্ষয় ঘটছে।

জেলেনস্কির কূটনৈতিক অপমান শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা নয়। এটি বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো পরিবর্তনের প্রতিফলন। এতে প্রতীয়মান যে সমর্থন, ও সহযোগিতা এখন আর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে না। এখন তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে সমর্থন নির্ধারিত হবে।

ট্রাম্প ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এর কারণ ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের বিষয়ে ট্রাম্পের দাবি করা শর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ট্রাম্প ইউক্রেনের সম্পদকে মার্কিন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ন্যায্য পাওনা বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু জেলেনস্কি জানেন, এই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হলে ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি অথনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্বল হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি এড়ানোর প্রবণতা বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে আরও অবনত করতে পারে। ইউক্রেন যদি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাহলে এটি অন্যান্য দুর্বল দেশগুলোর জন্যও একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

বাংলাদেশের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি তাদের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য সুরক্ষা নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে প্রভাব ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভরতা রয়েছে। মানবাধিকার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান কৌশলগত স্বার্থের উপর নির্ভরশীল হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্বাথান্বেষী হবে। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে কৌশলগত সতর্কতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্প-জেলেনস্কির সংঘর্ষ পশ্চিমা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে স্পষ্ট করেছে। পশ্চিমা মিত্ররা এতদিন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প এই নীতিকে অগ্রাহ্য করছেন। তার নীতি শক্তি এবং কৌশলগত সুবিধার উপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। তবে, এটার সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা অকপট দ্বৈতনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই করেছে।

এই পরিবর্তন বিশ্ব ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই নতুন বাস্তবতায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। পশ্চিমা মিত্রদের সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসায় উদ্বিগ্ন। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন যারা এর মাধ্যমে গ্লোবাল সাউথের জন্য নতুন সুযোগও দেখছেন।

ট্রাম্পের লেনদেনকেন্দ্রিক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি বৈশ্বিক মৈত্রীকে বিঘ্নিত করছে। এর ফলে গ্লোবাল সাউথ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বড় ভূমিকা রাখার একটি অনন্য সুযোগ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন বহুপাক্ষিক প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাচ্ছে, তখন উদীয়মান অর্থনীতিগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় বৈশ্বিক শাসন কাঠামো পুনর্গঠনের সুযোগ পাচ্ছে। ব্রিকস ব্লক, জি ২০-এর পরিবর্তনশীল নেতৃত্ব এবং নতুন বাণিজ্য অংশীদারিত্ব অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এবং কৌশলগত স্বাধীনতার পথ খুলে দিচ্ছে। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক বাণিজ্য উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতায় বিনিয়োগ এবং পশ্চিমা আধিপত্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোর সুবিধা নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতার অবনতি এবং ট্রাম্পের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ওপর জোর দেওয়ার কারণে এই দেশগুলো আরও ভালো বাণিজ্য চুক্তি করতে পারে। তারা ন্যায্য আর্থিক শর্ত দাবি করতে পারে এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, জলবায়ু কার্যক্রম এবং উন্নয়ন অর্থায়নে নীতিগত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ট্রাম্পের নীতির প্রতি উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিবর্তে, গ্লোবাল সাউথ এটাকে পুনর্গঠনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তারা আরও ন্যায়সঙ্গত একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, যেখানে তারা মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে পাশ কাটিয়ে একটি বহুমেরুকরণ ও বিচ্ছিন্ন বিশ্বে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করা সম্ভব।

লেখক: রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৪ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে