হাইকোর্টের যে রায় ঘিরে আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন

বিবিসি বাংলা
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫, ১২: ৩৯

এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ গত বছরের পাঁচই জুন হাইকোর্ট যখন সরকারি চাকরিতে কোটা বহালের পক্ষে রায় ঘোষণা করেছিল, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কেউ তখন ধারণাও করতে পারেনি যে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে তাদের টানা দেড় দশকের শাসনের পতন ঘটে যাবে।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় নিজেই বিবিসি'র কাছে সে কথা স্বীকার করেছিলেন। ‌আমাদের কেউ ভাবেনি এই সহিংস আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার উৎখাতের দিকে গড়াবে, পাঁচই অগাস্টের পর বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন মি. জয়।

হাইকোর্টের রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রথমদিকে তাদের দাবিকে সেভাবে আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যে আন্দোলন বড় আকার ধারণ করতে শুরু করলে তারা বল প্রয়োগের পথে হাঁটেন।

১৫ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিবাদে পরদিন বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে তিন জেলায় অন্তত ছয়জন নিহত হন, যার মধ্যে রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর ভিডিও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এ ঘটনার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইন্টারনেট বন্ধ, এমনকি কারফিউ জারির মাধ্যমে সেনা মোতায়েন করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি তৎকালীন সরকার। উপরন্তু আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একের পর এক হামলা ও নির্বিচার গুলিতে শিশুসহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় ফুঁসে ওঠে দেশের সর্বস্তরের মানুষ।

এ অবস্থায় তেসরা অগাস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ ঘটনার একদিন পর শিক্ষার্থীদের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে লাখো মানুষ ঢাকার রাজপথে নেমে আসলে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কিন্তু হাইকোর্টের যেই রায়কে কেন্দ্র করে এতকিছু ঘটে গেল, সেই রায়ে আসলে কী বলা হয়েছিল?

কী ছিল রায়ে?

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, সেটি মেনে নিতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের একটি অংশ। কোটা সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য বিক্ষুব্ধদের কয়েকজন ২০২১ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন।

সেই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২৪ সালের পাঁচই জুন রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্টের দুই বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং খিজির হায়াতের বেঞ্চ। রায়ে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

এর ফলে সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের মতোই ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে বলে তখন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন রিট আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী।

তবে এই রায়ের ফলে মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি অন্য কোটাগুলোও ফিরবে কি-না, শুরুতে সে বিষয়টি পরিষ্কার ছিল না। ‘পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না’ পাঁচই জুনের রায়ের পর বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান। এ ঘটনার দেড় মাসের মাথায়, অর্থাৎ ১৪ই জুলাই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট।

মোট ২৭ পৃষ্ঠার ওই রায়ে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদী, তথা সরকারপক্ষকে নির্দেশ দেয় আদালত। সেইসঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটাও আগের মতো বজায় রাখার আদেশ দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্ত করার আগে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও ১০ শতাংশ জেলা, ১০ শতাংশ নারী, পাঁচ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা ছিল।

তিন মাসের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সবগুলো কোটা ফিরিয়ে এনে পরিপত্র জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। তবে সরকার প্রয়োজন মনে করলে কোটার অনুপাত বা হার কমাতে কিংবা বাড়াতে পারবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া রায়ে এটাও বলা হয় যে, সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পূরণ না হলে সাধারণ মেধতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা যাবে।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ছিল ৫৬ শতাংশ, যা নিয়ে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। সেই অসন্তোষ থেকেই কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, কয়েক মাসের মধ্যে যা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।

শিক্ষার্থীরা তখন ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন, যাদের অন্যতম দাবি ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার। আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য যে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেটিকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক।

কিন্তু সেটি না করে ওই বছরের ১১ই এপ্রিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ছয় মাসের মাথায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা রিট আবেদন করলে আদালত তাদের পক্ষে রায় দেয়। যার ফলে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ খুলে যায়। এতে আবারও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন চাকরিপ্রার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

২০২৪ সালের পাঁচই জুন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ কোটা পুনর্বহালের পক্ষে যে রায় ঘোষণা করেছিল, সেটি প্রত্যাখ্যান করে ওইদিন সন্ধ্যাতেই বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে ছয়ই জুন বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।

ঘোষণা অনুযায়ী ছয়ই জুন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বড় বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আয়োজিত ওই বিক্ষোভ মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন।

কলাভবন, টিএসসি ঘুরে মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ‘এটা আমরা মেনে নেব না। কোটা বাতিলের পরিপত্র অবশ্যই বহাল রাখতে হবে। তারপর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সেটা নিতে হবে। তবে কোটা বাতিলের পরিপত্র অবশ্যই বহাল থাকতে হবে,’ সমাবেশে বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও তৎকালীন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব নাহিদ ইসলাম।

মি. ইসলাম পরবর্তীতে কোটা আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ, তথা অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। সেদিনের সমাবেশে আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে দাবি মেনে নেওয়া না হলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এদিকে, কোটা বহালের রায়ের প্রতিবাদে একইদিন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

একইভাবে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মাঠে নামেন। এমন পরিস্থিতিতে নয়ই জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর কিছুদিনের মধ্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ঈদুল আযহার ছুটি শুরু হওয়ায় ২৯শে জুন পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা।

৩৬ দিনে সরকার পতন

পহেলা জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে নতুন একটি প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আন্দোলন দ্রুতগতিতে সারা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

আন্দোলনকে সুসংগঠিত করতে শুরুর দিকে দেশব্যাপী ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়ক রাখা হয় ২৩ জন। বাকিরা ছিলেন সহ-সমন্বয়ক।

‘আমরা কোনো একক নেতৃত্ব, একক মুখপাত্র রাখিনি। আমাদের এখানে যারা সমন্বয়ক আছেন তারা যে কেউ যেকোনো সময় সামনে আসতে পারেন, কথা বলতে পারেন। এখানে কোনো একক নেতৃত্ব নেই আসলে,’ তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন কমিটির এক নম্বর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের পরবর্তী কয়েক দিন ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এরমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি শেষে চৌঠা জুলাই কোটার পক্ষে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

এ ঘটনার পর কোটা বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে সাতই জুলাই সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

দাবি না মানা পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় ১০ই জুলাই কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেইসঙ্গে, সাতই অগাস্ট বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়।

১৪ই জুলাই কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। এদিন সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও (চাকরি) পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে?...তার মানে হলো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা-নাতি-পুতিরা হলো মেধাবী, তাই না?’

শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে সেদিন মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করার সময় ‘তুমি কে আমি কে?- রাজাকার রাজাকার'; কে বলেছে কে বলেছে?- স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগান দেন।

এ ঘটনার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে ব্যাপক মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও তাদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে।

ওই হামলার ঘটনার পরদিন ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ছয়জন নিহত হন।

এরমধ্যে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ওই ঘটনার ভিডিও গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেও পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

১৮ই জুলাই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে অনেকে নিহত হন। এদিন ঢাকার রামপুরা এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এছাড়া ঢাকার মেরুল বাড্ডায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে একটি ভবনে অবরোধ করে রাখলে একপর্যায়ে হেলিকপ্টার দিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।

এদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দেওয়া হলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা প্রস্তাব দেওয়া হলে সেটিও নাকচ করেন দেন আন্দোলনকারীরা। পরে রাত নয়টার দিকে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

পরদিন ঢাকার মিরপুরে মেট্রোরেলের দু'টি স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ১৯শে জুলাই সারা দেশে সহিংসতার পর মধ্যরাতে কারফিউ জারি করে সরকার।

পরের এক সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে নারী, শিশুসহ আরও অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়।

এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড নিয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করার ঘটনা ঘটতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে তেসরা অগাস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ করে সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম। দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।

এদিকে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুতে ছয়ই আগস্ট ওই কর্মসূচি পালনের কথা জানানো হলেও পরে সেটি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট আনা হয়। শিক্ষার্থীদের ডাকে সাড়া দিয়ে পাঁচই অগাস্ট লাখো মানুষ ঢাকার রাস্তায় নেমে এলে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৪ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে