মতামত

আইন পরিবর্তনের চেয়ে নিজেদের পরিবর্তনই প্রকৃত উন্নতির পথ

বাংলাদেশে আইনের সংস্কার প্রায়ই ধীরে চলে এবং সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হয় না। নতুন আইন করা হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত ফল দেয় না। তাই কেবল আইন পরিবর্তনের দিকে না তাকিয়ে আমাদের মানসিকতা, শৃঙ্খলা ও নৈতিক আচরণ পরিবর্তন করাই টেকসই উন্নতির আসল উপায়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই পরিবর্তনের মাধ্যমে দ্রুত ফল পেতে পারে।

ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা, সততা ও জবাবদিহির মাধ্যমে নাগরিক ও প্রতিষ্ঠান উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশেও এমন অনেক ভালো উদাহরণ আছে, যা প্রমাণ করে স্ব-উদ্যোগই আসল চাবিকাঠি।

বাংলাদেশি উদাহরণ

বাংলাদেশের ব্যাংক ও কর্পোরেট সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল (Transparency International Bangladesh, ২০২৩)। তবে সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক নিজেদের উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ অডিট, কোড অব কন্ডাক্ট ও সাস্টেইনেবল ফাইন্যান্স নীতি গ্রহণ করেছে (Bangladesh Bank, Annual Report ২০২২)। এগুলো আইন পরিবর্তনের অপেক্ষা না করেই বাস্তব পরিবর্তন এনেছে।

শিক্ষা খাতেও একই ধারা দেখা গেছে। ঢাকার কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন চালু করে শিক্ষার মান বাড়িয়েছে (UGC Higher Education Report, ২০২১)।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী মনিটরিং ও পুরস্কারভিত্তিক কর্মসূচি চালু করেছে, যা কর্মকর্তাদের মধ্যে নৈতিক দায়িত্ববোধ বাড়াতে সহায়তা করেছে (NBR Performance Report, ২০২২)।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ

সিঙ্গাপুরে ১৯৭০-এর দশক থেকে সরকারি কর্মীদের দক্ষতা ও নৈতিকতার ওপর জোর দেওয়া হয়, যার ফলে আইন সংস্কারের অপেক্ষা না করেই সেবার মান উন্নত হয়েছিল (Quah, J. S. T., 2010, Public Administration Singapore)।

রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর সামাজিক পুনর্গঠন প্রোগ্রাম নাগরিকদের দায়িত্ববোধ বাড়িয়েছিল, যা দ্রুত স্থিতিশীলতা এনেছিল (Ansoms, A., 2009, African Affairs)।

ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধ বাড়ানোর কারণে শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা হয়েছে (OECD, Education Policy Outlook, 2015)।

জাপানে কর্পোরেট সংস্কৃতিতে স্ব-শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের জোরদার ভূমিকা ব্যবসায়িক নৈতিকতা বাড়িয়েছে (Abegglen, J. C., 21st-Century Japanese Management, 2006)।

হংকং-এ ১৯৭৪ সালে ICAC প্রতিষ্ঠার পর দুর্নীতি নাটকীয়ভাবে কমে যায় (Manion, M., Corruption by Design, 2004)।

ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড ও নরওয়েতেও সরকারি কর্মীদের স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ ও স্ব-উদ্যোগী প্রশিক্ষণ প্রশাসনিক দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বাড়িয়েছে (Transparency International Corruption Perceptions Index, 2022)।

বিশ্লেষণ ও প্রয়োগযোগ্যতা

এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে আইন সংস্কার সবসময় যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যদি নিজেরা উদ্যোগ নেয়, তবে উন্নতি দ্রুত সম্ভব। বাংলাদেশে নাগরিক, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি এই শিক্ষা কাজে লাগায়, তবে নতুন আইন কার্যকর হওয়ার অপেক্ষা ছাড়াই ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

ব্যক্তিগত সততা, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ মানোন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।

প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ম দুর্নীতি কমায়। তাই অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে আসল উন্নতি কেবল আইন পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে না। আমাদের মানসিকতা, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধই আসল হাতিয়ার। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যদি এই পরিবর্তন আনে, তবে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও স্থায়ী অগ্রগতি সম্ভব।

গ্লোবাল কেস স্টাডি ও স্থানীয় উদাহরণসহ দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতা দেখায়, আইন পরিবর্তনের অপেক্ষা না করে, নিজে থেকে পরিবর্তন আনা সবচেয়ে দ্রুত, স্থায়ী ও কার্যকর পথ।

লেখক: কোম্পানি সচিব, সিটি ব্যাংক পিএলসি

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৭ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৮ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৮ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

১২ দিন আগে