জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্বেগের যত কারণ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

বিগত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাবির সাবেক শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টরিয়াল টিমের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি নির্দেশ করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাবেক শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ভূঁইয়াকে আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য এবং হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত সকল সাবেক শিক্ষার্থীর সনদ বাতিলের জন্য প্রশাসনের কাছে আমরা দাবী জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসন শীতল ভূমিকা পালন করে আসছে। শামীম মোল্লার রাজনৈতিক পরিচয় তাকে হত্যার বৈধতা প্রদান করে না। প্রশাসনের নীরব ভূমিকা এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রশাসনের এহেন নীরবতা ২০২৪-এর শিক্ষার্থী- জনতার অভ্যুত্থানের স্পিরিটের পরিপন্থি এবং আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা আবারো শামীম মোল্লা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ শাস্তি বিধানের জোর দাবি জানাচ্ছি।

আমরা লক্ষ্য করছি যে আত্মপরিচয় গোপন রেখে এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন না করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (জাবি শাখা) বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ ধরনের গোপনীয়তা আসন্ন জাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে নানা অস্পষ্টতা তৈরি করতে পারে এবং উক্ত নির্বাচনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সকল শিক্ষার্থী সংগঠনসমূহের গুপ্ত রাজনীতি পরিহার করা আবশ্যক।

আমরা এও লক্ষ্য করছি যে জাবি ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটিতে অধিকাংশ পদে সাবেক শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উক্ত কমিটিতে বর্তমান শিক্ষার্থী নয় এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক স্পিরিটের সাথে স্ববিরোধী। এছাড়াও পদপ্রাপ্তদের যারা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থী নয়, তাদের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নানা প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হবে এবং এ ধরনের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষার্থী-নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নানা বিশৃংখলার সৃষ্টি করবে।

* সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের সাথে ভাষিক নিপীড়নমূলক, উত্যক্ত করণমূলক, হয়রানিমূলক ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাবির টিএসসিতে নারী শিক্ষার্থীদের প্রক্ষালন কক্ষে ভিডিওধারণের চেষ্টাকালে একজন বহিরাগতকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যম থেকে জানা গেছে। এ সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিষয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগে শ্রেণীকক্ষে নারী শিক্ষকের প্রতি পুরুষ শিক্ষার্থীদের অশোভন আচরণ প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে বলে জেনেছি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং নারী সহকর্মীদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ।

আমরা লক্ষ্য করেছি ‘ইংরেজী নববর্ষ, ২০২৫' উদযাপন কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানের নামে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দিবা-রাত্রির যে কোনো সময়ে সকল শিক্ষার্থীর নিরাপদ অবস্থান ও চলাফেরা নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব। নিরাপত্তা বিধানের নামে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও হলের বাইরে অবস্থান করার সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তার অধিকার ক্ষুন্ন করার শামিল।

এছাড়াও খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণের প্রাক্কালে ধর্ম বিশ্বাসের ভিন্নতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে কিছু শিক্ষার্থীকে মদ্যপানের অভিযোগে আটক এবং কোনো তদন্ত ব্যতিরেকে সামাজিক মাধ্যম এবং পত্রিকায় তাদের ছবি ও নাম প্রকাশ করার মাধ্যমে প্রক্টরিয়াল টিম তাদের অতি-প্রতিক্রিয়াশীল, অসংবেদনশীল মানসিকতা এবং আচরণ প্রদর্শন করেছে, যা নিন্দাযোগ্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইন বিশেষ ধর্ম ও বিশেষ গোষ্ঠির মানুষের ক্ষেত্রে মদ্যপানকে বৈধতা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন যেখানে ধর্ম বিশ্বাসের ভিন্নতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব প্রদান করে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের এহেন ‘মোরাল পোলিসিং' বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অনিচ্ছা/ব্যার্থতা ঢাকবার অপপ্রয়াস বলেই বোধ হয়।

স্বৈরাচারী সরকার পতনের উদ্দেশে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন চলাকালে বিগত ১৫ জুলাই, ২০২৪-এ তৎকালীন জাবি উপাচার্যের বাসভবনে সমবেত আশ্রয়প্রার্থী, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার পর প্রশাসনে বদল ঘটলেও এবং দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তদন্তের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। উক্ত হামলায় শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের অনেকে গুরুতর আহত হন, যাদের কাউকে কাউকে দীর্ঘ সময় ধরে নানা শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে হামলার মদদদাতা শিক্ষক ও হামলাকারী শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে উক্ত ঘটনার যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন করে সকল অংশীজনের সামনে দোষী ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করার এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

বিবৃতি প্রদানকারি: মির্জা তাসলিমা সুলতানা, স্বাধীন সেন, এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া, রায়হান রাইন, আইনুন নাহার, শরমিন্দ নীলোমি, সৈয়দ নিজার আলম, রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, ধীমান সরকার, মাহমুদা আকন্দ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষক)।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচলে অর্থনীতি

ব্যাংক খাতের কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্দশা কাটেনি। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়েছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে। এ খাতে সুশাসন ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা গেলে ব্যাংক খাত আরও ভালো করবে।

৬ দিন আগে

অপারেশন মাউন্টেন ঈগল: মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতী গেরিলা

কর্ণফুলীর স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরের আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ। সেই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ যোগ দেয় একদল সশস্ত্র তিব্বতীয় গেরিলা। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আর কর্ণফুলীর স্রোত যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। আনন্দে উদ্বেলিত জনতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিব্বতীয়দের দিকে।

১৩ দিন আগে

সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

১৩ দিন আগে

সহিংসতার রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হ

১৪ দিন আগে