ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিল না কেউই

শরিফুল হাসান
আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ১৬: ১১

রাজনৈতিক সরকার বলুন কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; সব আমলেই তাদের সাথে একদল উন্মত্ত ক্ষমতাশালী মানুষ দেশকে কীভাবে প্রতিযোগিতা করে পিছিয়ে দিতে পারে, তার প্রমাণ বাংলাদেশ!

এই দেশে ৫৪ ধারা বা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো বর্বর আইন ছিল, এখনো আছে। কোনও সরকার তা বাতিল করেনি। বরং আওয়ামী লীগ আমলে যুক্ত হয় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। কথায় কথায় মামলা, জামিন নেই। তরুণ থেকে কিশোর, লেখক থেকে সাংবাদিক কেউ বাদ যেত না।

এরপর এলো জুলাই-আগস্ট। আফসোস, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিল না। কথায় কথায় হত্যা মামলা, মব সন্ত্রাস, এখানে আগুন, ওখানে ভাঙচুর। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও এত অদ্ভুত সব হত্যা মামলা হয়েছে কি না জানা নেই। দলে দলে সাংবাদিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এক মামলায় ৫০০-৬০০ আসামি।

পৃথিবীর ইতিহাসে একেকটা মামলায় এত বেশি বেশি হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। এমন সব লোককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে, যে সাধারণ মানুষও বোঝে এগুলো মিথ্যা মামলা। দুর্নীতি, লুটপাট, ভোট কারচুপি যাই হোক, অপরাধ হলে হত্যা মামলা। গ্রেপ্তারকৃতদের কোনো জামিনের নামগন্ধ নেই। তাই বলে একজন অভিনেত্রীকেও হত্যা মামলার আসামি ও গ্রেপ্তার করতে হবে?

অবশেষে মঙ্গলবার (২০ মে) নুসরাত ফারিয়াকে জামিন দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। কেন তিনি জামিন পেলেন, সেটি আমরা সবাই জানি। কারণ তাকে নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়েছে। সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

পৃথিবীর আর কোথাও অভিনয় করার জন্য হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। আপনাদের জানা থাকলে বলবেন। বিশেষ করে এই সরকারের অনেক উপদেষ্টা তো বিদেশের নাগরিক, প্রায় সবাই দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন। আচ্ছা, পৃথিবীর কোথায় একটা রাজনৈতিক চরিত্রে অভিনয়ের কারণে হত্যা মামলা হয়েছে বলেন তো আপনারা?

আর মামলাটা দেখেন। ১৯ জুলাই রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে জনৈক এনামুল হক নামের একজনের হত্যার ঘটনায় এই মামলা, যেটি ৩ মে এজাহার হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। অথচ মামলার ঘটনার তারিখ ১৯ জুলাই, নুসরাত ফারিয়া তখন কানাডায় ছিলেন। পেশাগত কাজ শেষে গত বছরের ১৪ আগস্ট তিনি দেশে ফেরেন। পাসপোর্ট ও ভিসার কাগজপত্র আদালতের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।

শুধু তা–ই নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নুসরাত ফারিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষে লেখালেখি করেছিলেন, সহমর্মিতাও প্রকাশ করেছিলেন। কী করে এই মামলা টিকে? রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কেন তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হলো? প্রতিটি মামলার এই হাল বলে দেয় মামলার নামে কী সব হাস্যকর ঘটনা ঘটেছে।

গত ২৭ মার্চ আদালতে দায়ের করা মামলায় এনামুল হক নামে এক ব্যক্তি আসামি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১৭ জন অভিনয়শিল্পী ও আরও ২৬৫ জনকে।

আদালতের নির্দেশে ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ৩ মে মামলাটি নথিভুক্ত করেন। এই মামলায় আসামি হিসেবে যে ১৭ জন অভিনয়শিল্পীর নাম রয়েছে তারা হলেন—নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, সৈয়দা কামরুন নাহার শাহনুর, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, তানভীন সুইটি, মেহের আফরোজ শাওন, জাকিয়া মুন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আজিজুল হাকিম, আশনা হাবিব ভাবনা, সায়মন সাদিক, জায়েদ খান, রোকেয়া প্রাচী ও তারিন জাহান।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগকে অর্থদাতা হিসেবে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। শুধু প্রশ্ন, এই গ্রেপ্তারে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কী বাড়ল? আচ্ছা, দেশে না সংস্কারের আলাপ চলছে। এই বুঝি সংস্কার? এই বুঝি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা? কী করে আদালত একজন অভিনেত্রীকে জেলে পাঠাল? অবশ্য বিচার বিভাগের আর বিচারকদের জীবনে কী চলছে, কম-বেশি জানি। আচ্ছা, কোন অপরাধ প্রমাণ ছাড়া কেন সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানা মানুষ মাসের পর মাস জেলে?

তুরস্ক ও ইউরোপের দেশগুলোতে মিটিং আর কাজের জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে ঘুরছি। নানা শহর দেখছি, দেখছি সরকার, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, নগর আর নাগরিকদের। যখনই আমি ইউরোপ বা অন্য অনেক শহরে যাই, আফসোস লাগে—পৃথিবী কোথায় চলে গেছে, আর আমরা বাংলাদেশ কোথায়?

এই লেখা শেষ করার আগেই আবার খবর, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলায় একজন ব্যবসায়ীকে মারধর করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব ছিলেন তিনি। এখনো সরব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। আগে মার খাননি, এখন খেলেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের অ্যাকটিভিস্ট এন্ডি হল মেসেজ দিলেন—আওয়ামী লীগ আমলে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো তুলে নিতে হবে। মালয়েশিয়ায় বসে আগে যিনি সব নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখনো নাকি তিনিই নিয়ন্ত্রণ করবেন।

আজকাল এসব নিয়ে লিখতেও ইচ্ছে করে না। আওয়ামী লীগ আমলে এই ক্রসফায়ার, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, দুর্নীতি, লুটপাট, কোটা সংস্কার, ভোট, গণতন্ত্র, অনিয়ম, মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট—এসব নিয়ে দিনের পর দিন লিখেছি। তখনও ক্ষমতাসীনদের গালি খেয়েছি, এখনো খাই। তবে এখন আর লিখতে ইচ্ছে করে না। ধৈর্য হারাচ্ছি। ক্লান্ত লাগে।

এই যে দেখুন, ইউরোপের এক দেশ বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় বসে এই লেখা লিখছি। আমার জানালা দিয়ে সোফিয়া পর্বত দেখা যাচ্ছে। তার চূড়ায় হালকা বরফ। সকালের সূর্যের আলোয় কী সুন্দর লাগছে! একটু পরেই বুলগেরিয়ার পুলিশ, ইন্টারপোল আর ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশনের সাথে আমার বৈঠক—মানব পাচার আর অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ে। ল্যাপটপে বসে প্রেজেন্টেশন ঠিক করছিলাম। হঠাৎ খবর দেখে এই লেখা আর দেশ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল!

বাংলাদেশ কী অসাধারণ একটা সম্ভাবনাময় দেশ! কত কত অর্জন হতে পারত! সেই দেশটাকে ক্ষমতায় বসে একদল মানুষ সব আমলে, সব সময় পিছিয়ে দিচ্ছে। এরা বোঝেই না কোন কাজে দেশের মান বাড়ে আর কোন কাজে কমে?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব উপদেষ্টা, নীতিনির্ধারকদের কাছে আমার প্রশ্ন, আচ্ছা একজন অভিনেত্রীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেশের কী লাভটা করলেন আপনারা? সে কী এমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশ-দুনিয়ায় এই বার্তা দিতে হবে—সিনেমা চরিত্রে অভিনয় করার জন্যও বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়? অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলছে স্বদেশ! হে আল্লাহ, তুমি আমাদের বোধ দাও! নীতিবোধ, মানবিক বোধ, দেশপ্রেমের বোধ!

লেখক: সাংবাদিক ও অভিবাসন বিশ্লেষক

সোফিয়া, বুলগেরিয়া, ১৯ মে ২০২৫

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

গণশুনানির নামে নাটক চলছে কি আগের ধারায়?

বিগত সরকারের সময় এসব বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় আমরা অনেক সময় প্রতিবাদ জানিয়ে গণশুনানিতে যাইনি। অনেকের আশা ছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে গণশুনানি করবে। কিন্তু না— তা হলো না। সরকার অতীতের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকারের পথ

৬ দিন আগে

জুলাই সনদ সইয়ে জটিলতার সমাধান কোথায়

ঐকমত্য কমিশনে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার অনেকগুলোতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে বা ঘোরতর দ্বিমত জানিয়েছে। এসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ঘোরতম দ্বিমতকে কোনোভাবে ঐকমত্য হিসেবে ধরা যাবে না।

৮ দিন আগে

বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য: মানবতার নীরব বিশ্বাসঘাতকতা

ক্ষুধা ধীরে হত্যা করে, ভেজাল নীরবে হত্যা করে। খাদ্যে ভেজাল কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে চার লাখ ২০ হাজার মানুষ মারাও যায়।

৯ দিন আগে

ইতিহাসের সাক্ষী আহমদ রফিক

এ জাতির মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে কে হবেন কান্ডারী? আমরা কি সেই ইতিহাসের ভারবাহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছি? না পারার দায় কার? লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

১১ দিন আগে