চে গুয়েভারা— মৃত্যুতেও চিরভাস্মর

প্রকৃত নাম এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না। মন্ত্রী হিসেবে কিউবায় তার দাপ্তরিক নাম ছিল ‘আর্নেস্তো গুয়েভারা’। বিশ্বের কোটি মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ‘চে গুয়েভারা’ নামে। এককথায় ‘চে’ বললেই সবার মানসপটে ভেসে ওঠে তারই ছবি।

জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ মে, আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের রোজারিও শহরে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর, বলিভিয়ার লা হিগুয়েরায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন মার্কসবাদী বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক ও গেরিলা যোদ্ধা। কিউবার বিপ্লবে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম শীর্ষ বিপ্লবী নেতা। এ সময় থেকেই তিনি ‘চে’ নামে পরিচিতি পান। বিপ্লব-পরবর্তী কিউবা পুনর্গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিপ্লবের পর চে গুয়েভারা কিউবার নতুন সরকারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব, কৃষিজমি সংস্কার, দেশব্যাপী সাক্ষরতা অভিযান, ন্যাশনাল ব্যাংকের সভাপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর নির্দেশিকা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সমাজতান্ত্রিক কিউবার পক্ষে কূটনীতিক হিসেবেও বিশ্ব ভ্রমণ করেন। এসব দায়িত্ব তার সামরিক নেতৃত্বকে আরও দৃঢ় করে তোলে। ‘বে অব পিগস’ আক্রমণ প্রতিহত করা এবং কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র আনার মতো ঐতিহাসিক ঘটনাতেও তিনি ভূমিকা রাখেন।

১৯৬৩ সালে লুক ম্যাগাজিনের জন্য তোলা চে গুয়েভারার ছবি। চে তখন কিউবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন লরা বারকুইস্ট। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
১৯৬৩ সালে লুক ম্যাগাজিনের জন্য তোলা চে গুয়েভারার ছবি। চে তখন কিউবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন লরা বারকুইস্ট। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া চে বিশ্বাস করতেন— ‘পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় হলে একজন মার্কসবাদী বিপ্লবীর কর্তব্য তা প্রতিরোধ করা।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি কিউবার বিপ্লবে যোগ দেন। পরে একই চেতনায় বলিভিয়ায় গিয়েও লড়াই শুরু করেন।

কিউবা ছাড়ার আগে ফিদেল কাস্ত্রোকে লেখা একটি চিঠিতে চে বলেন—“আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আমার সব পদ থেকে পদত্যাগ করছি, এমনকি নাগরিকত্বও। কিন্তু যে বন্ধন রইল, তা কোনো পদত্যাগে ভাঙার নয়।”

চে ছিলেন শারীরিকভাবে দুর্বল কিন্তু মানসিকভাবে দৃঢ়। মেডিকেল ছাত্রাবস্থায় বন্ধু আলবের্তো গ্রানাদোকে নিয়ে ১৯৫২ সালে মোটরসাইকেলে ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। এ সফরই তার মধ্যে জন্ম দেয় বিপ্লবী চেতনা। পরে ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে যোগ দিয়ে ‘২৬ জুলাই আন্দোলনে’ অংশ নেন এবং সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে বিপ্লবের অন্যতম সেনাপতি হয়ে ওঠেন।

সহযোদ্ধাদের সঙ্গে চে গুয়েভারা (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। মাঝে দাঁড়ানো ফিদেল ক্যাস্ত্রো, বাঁ দিকে হাঁটু গেড়ে বসা রাউল ক্যাস্ত্রো। ছবি: টাইম ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত
সহযোদ্ধাদের সঙ্গে চে গুয়েভারা (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। মাঝে দাঁড়ানো ফিদেল ক্যাস্ত্রো, বাঁ দিকে হাঁটু গেড়ে বসা রাউল ক্যাস্ত্রো। ছবি: টাইম ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত

বিপ্লব-পরবর্তী কিউবায় দায়িত্ব পালনকালে চের সঙ্গে পরিচয় হয় পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট বিপ্লবী তানিয়ার সঙ্গে। তারা বলিভিয়ায় গেরিলা অভিযান শুরুর পরিকল্পনা করেন। ১৯৬৫ সালে চে গোপনে কিউবা ত্যাগ করে কঙ্গো, তানজানিয়া, প্রাগ হয়ে বলিভিয়ায় প্রবেশ করেন। সেখানে নতুন করে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন।

চে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তার বলিভিয়ার ডায়েরিতে উঠে আসে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত যুদ্ধ পরিস্থিতি। পরদিন ৮ অক্টোবর সরকারি বাহিনীর হাতে তিনি আহত অবস্থায় বন্দি হন। এর পরদিন ৯ অক্টোবর বলিভিয়ান সেনা কর্মকর্তা মারিও তেরান গুলি চালিয়ে হত্যা করেন চে’কে। ৯টি বুলেটের আঘাত পাওয়া যায় চে’র দেহে।

১৯৫৯ সালে ভারত সফরে এসেছিলেন চে গুয়েভারা। বাঁয়ের ছবিতে সে সফরে দিল্লির একটি কমিউনিটি ব্লক পরিদর্শন করার সময় বয়োবৃদ্ধ এক ভারতীয় ফুলের মালা দিয়ে তাকে বরণ করে নিচ্ছেন। ডানের ছবিতে চে’কে নিজের আবাসিক কার্যালয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। ছবি: ভারতের সরকারি দপ্তর
১৯৫৯ সালে ভারত সফরে এসেছিলেন চে গুয়েভারা। বাঁয়ের ছবিতে সে সফরে দিল্লির একটি কমিউনিটি ব্লক পরিদর্শন করার সময় বয়োবৃদ্ধ এক ভারতীয় ফুলের মালা দিয়ে তাকে বরণ করে নিচ্ছেন। ডানের ছবিতে চে’কে নিজের আবাসিক কার্যালয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। ছবি: ভারতের সরকারি দপ্তর

সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, চে যুদ্ধের সময় আহত হয়ে মারা যান। সে বিবৃতি কেউ বিশ্বাস করেনি। সরকার গোপনে তার মুখের ছাপ তুলে ও দুই হাত কেটে রাখে প্রমাণ হিসেবে, যেন তার কবর কোনো বিপ্লবী তীর্থে পরিণত না হয়।

ফিদেল কাস্ত্রো পরে চে’র মৃত্যুর খবর ঘোষণা করলে সারা বিশ্ব শোকাহত হয়। কিউবায় তিন দিন জাতীয় শোক পালন করা হয় এবং ৮ অক্টোবরকে ‘বীর গেরিলা দিবস’ হিসেবে পালনের অঙ্গীকার করা হয়।

পরের বছর প্রকাশিত হয় চে’র বলিভিয়ার ডায়েরি, যা প্রকৃতই চে’র লেখা বলে প্রমাণ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। পরে জানা যায়, বলিভিয়ার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও আর্গেদাস নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চে’র ডায়েরি, মুখের ছাপ ও কাটা হাত হাভানায় পাঠিয়েছিলেন।

কিউবার হাভানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশে অবস্থিত প্লাজা ডি রিভোলুসিয়নে পাঁচ তলা ভবন জুড়ে চে গুয়েভারার প্রতিকৃতি, যেখানে একসময় চে নিজেই কাজ করেছেন। চে’র প্রতিকৃতির নিচে লেখা তারই বিখ্যাত স্লোগান (স্প্যানিশ ভাষায়)— হাসতা লা ভিকটোরিয়া সিয়েমপ্রি, যার অর্থ বিজয়ের পথে, চিরকাল। ছবি: মার্ক স্কট জনসন (অস্ট্রেলিয়া), উইকিপিডিয়া থেকে
কিউবার হাভানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশে অবস্থিত প্লাজা ডি রিভোলুসিয়নে পাঁচ তলা ভবন জুড়ে চে গুয়েভারার প্রতিকৃতি, যেখানে একসময় চে নিজেই কাজ করেছেন। চে’র প্রতিকৃতির নিচে লেখা তারই বিখ্যাত স্লোগান (স্প্যানিশ ভাষায়)— হাসতা লা ভিকটোরিয়া সিয়েমপ্রি, যার অর্থ বিজয়ের পথে, চিরকাল। ছবি: মার্ক স্কট জনসন (অস্ট্রেলিয়া), উইকিপিডিয়া থেকে

চে গুয়েভারা শুধু কিউবার নয়, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রতীক। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিপ্লবের আগুন এক দেশে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়— তা ছড়িয়ে পড়তে হবে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকায়। তার মৃত্যু ঘটলেও আদর্শের মৃত্যু হয়নি। চে আজও বেঁচে আছেন প্রতিটি মুষ্টিবদ্ধ হাতে, প্রতিটি বিপ্লবী চিন্তায়, প্রতিটি ন্যায়বিচার-পিপাসু হৃদয়ে।

চে গুয়েভারার ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র:

১. বলিভিয়ার ডায়েরি, চে গুয়েভারা স্টাডিজ সেন্টার, হাভানা, কিউবা

২. চে গুয়েভারার ডায়েরি, ভূমিকা: ফিদেল কাস্ত্রো

৩. চে গুয়েভারার ডায়েরি, অনুবাদ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়

৪. মোটরবাইকে চে গুয়েভারার সঙ্গে, আলবের্তো গ্রানাদো

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি)

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

ইতিহাসের সাক্ষী আহমদ রফিক

এ জাতির মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে কে হবেন কান্ডারী? আমরা কি সেই ইতিহাসের ভারবাহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছি? না পারার দায় কার? লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

৮ দিন আগে

তিন শূন্যের পৃথিবী গড়া জাতিপুঞ্জের সকলের স্বপ্ন হোক

গত আট দশক ধরে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে । বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০ টি দে

১৪ দিন আগে

‘রূপালী ক্যাশ’, ডিজিটাল জালিয়াতি ও গ্রাহকের অসহায়ত্ব

এসব গ্রাহকের কাজ ছিল টাকা ওঠানো থেকে শুরু করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রভৃতি সংগ্রহ। কিন্তু সেজন্য কেন তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষমান ছিলেন? কারণ ব্যাংকের ‘সার্ভার ডাউন’, তাই কোনো কাজই করা যাচ্ছিল না!

১৫ দিন আগে

চাকরিজীবীদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতেই হবে

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ মানে শুধু শারীরিক নিরাপত্তা নয়, বরং রাজনৈতিক ও মানসিক চাপমুক্ত একটি পেশাগত পরিবেশও নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বেসরকারি খাতেও দক্ষ জনবল টিকে থাকতে পারে না, উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়ে।

১৫ দিন আগে