দেশপ্রেমের দাবি নিয়ে যত বিতর্ক

শাহরিয়ার শরীফ
বিএনপি ও জামায়াতের লোগো। ছবি: রাজনীতি ডটকম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়, যা প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দেশপ্রেম প্রশ্নে বিতর্কে জড়িয়েছে, যা রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমানের ভাষ্য, ‘দেশে দুটি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি আছে— একটি সেনাবাহিনী, আরেকটি জামায়াতে ইসলামী।’ তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গন ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।

এর মধ্যে শুক্রবার সকালে সমমনা জোটের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল বিএনপি। বৈঠক শেষে সাংবাদিকেরা জানতে চান, জামায়াত তো বিএনপির সঙ্গে ছিল। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কি না। জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে ফরমালি যুগপৎ আন্দোলনে আমরা ছিলাম না।’

সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে কি না কিংবা দূরত্ব কমাতে বিএনপি কোনো উদ্যোগ নেবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, ‘এমন কোনো দূরত্বের কিছু নেই। তারাও গণতন্ত্র চায়, নির্বাচন চায়, মানুষের অধিকারের কথা বলে। আমরাও বলি। কিন্তু যদি কেউ কখনো বলে যে শুধু তারাই দেশপ্রেমিক, তাহলে তো একজন মুক্তযোদ্ধা হিসেবে কষ্ট লাগবেই। আমরা তো বলবই— ভাই, কথাটা ঠিক না। আমরা সবাই দেশপ্রেমিক। আমরা আশা করব, এ রকম কথা কেউ না বলুক।’

এর আগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াত আমিরের ওই মন্তব্যকে ‘হাস্যকর’ বলে অভিহিত করেন। তিনি পালটা প্রশ্ন তোলেন, ‘একাত্তরে আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? কোন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেছেন?’

রিজভী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে কেউ দেশপ্রেমিক নেই, শুধু একটি রাজনৈতিক দল দেশপ্রেমিক— এ ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করলে মানুষ হাসবে, মানুষ হাসি ছাড়া আর কিছু দেবে না।’

বিএনপির সিনিয়র এই নেতা আরও উল্লেখ করেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল তা সবাই জানে।’

বিএনপির আরেক নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে বলেন, ‘জামায়াত একাত্তরে নিজেদের ভূমিকাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে।’

এমন মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন যে জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ড এখনো প্রশ্নবিদ্ধ এবং তাদের বর্তমান বক্তব্য সেই বিতর্ককে পুনরুজ্জীবিত করছে।

কেবল ‘দেশপ্রেমিক’ প্রসঙ্গ নয়, বিভিন্ন ইস্যুতেই এখন মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়ছে বিএনপি-জামায়াত। তাদের ২৫ বছরের ঐক্যে ফাটল অনেকটাই প্রকাশ্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় এখন জামায়াত বিএনপির অথবা বিএনপি জামায়াতের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে।

সাম্প্রতিককালে দুই দলের নেতাদের কথাবার্তায় এটি ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে, বিএনপি আর জামায়াত একে অন্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে ফিরে না আসা পর্যন্ত দল দুটির এক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

দুই দলের সম্পর্ক যখন এমন মুখোমুখি, সেই উত্তেজনাতেই ঘি ঢেলেছে ‘দেশপ্রেম’ ইস্যু। বিএনপির নেতারা জামায়াতের অতীত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। জামায়াতকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করছেন সুশীল সমাজেরও কেউ কেউ।

নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির সম্প্রতি একটি টকশোতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমিরের ‘দেশে দুটি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি’ সংক্রান্ত বক্তব্যকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক বেয়াদবি।’

নুরুল কবির বলেন, ‘একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। তারা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এখন তারাই নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, যা চরম মিথ্যাচার এবং জাতির জন্য অপমানজনক।’

নুরুল কবিরের মতে, ‘দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বার্থে কাজ করতে হয়। কিন্তু জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ড তার সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশপ্রেম নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।’

নিউ এজ সম্পাদকের এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অনেকেই নুরুল কবিরের মন্তব্যকে সঠিক বলে সমর্থন জানালেও জামায়াত ও তাদের সমর্থকরা একে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের দেশপ্রেম সম্পর্কিত ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সভাপতি আ স ম আবদুর রবও। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকা দেশপ্রেমের পরিচয় নয়।

সর্বোপরি, দেশপ্রেম নিয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতার এই বক্তব্য রাজনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা ও দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সংবেদনশীলতাকে প্রতিফলিত করে।

এটি সত্য, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল করার মতো অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলটি এখন স্বাধীনভাবে রাজনীতি করছে, সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

সবকিছুর পরও জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবেই স্বীকৃত। তাই মুক্তিযুদ্ধ, মানবতা ও দেশপ্রেম নিয়ে দলটি যত বেশি কথা বলবে, তত বেশি মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হবে।

লেখক: সাংবাদিক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচলে অর্থনীতি

ব্যাংক খাতের কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্দশা কাটেনি। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়েছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে। এ খাতে সুশাসন ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা গেলে ব্যাংক খাত আরও ভালো করবে।

৬ দিন আগে

অপারেশন মাউন্টেন ঈগল: মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতী গেরিলা

কর্ণফুলীর স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরের আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ। সেই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ যোগ দেয় একদল সশস্ত্র তিব্বতীয় গেরিলা। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আর কর্ণফুলীর স্রোত যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। আনন্দে উদ্বেলিত জনতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিব্বতীয়দের দিকে।

১৩ দিন আগে

সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

১৩ দিন আগে

সহিংসতার রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হ

১৪ দিন আগে