স্বাস্থ্য ও খাবার

অতিরিক্ত মাথা ব্যথার কারণ ও মুক্তির উপায়

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

মাথা ব্যথা এমন একটি সমস্যা, যা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে অনুভব করেছেন। তবে যখন মাথা ব্যথা অতিরিক্ত ঘন ঘন হয় কিংবা দীর্ঘস্থায়ী আকার ধারণ করে, তখন এটি আর সাধারণ সমস্যা থাকে না। বরং এটি শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বড় একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় অতিরিক্ত মাথা ব্যথা নানা কারণে হতে পারে—হালকা টেনশন থেকে শুরু করে গুরুতর স্নায়বিক সমস্যা পর্যন্ত। অনেক সময় মাথা ব্যথা নিজেই একটি রোগ নয়, বরং শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য কোনো সমস্যার ইঙ্গিত বহন করে। তাই এর কারণ বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

সাধারণভাবে মাথা ব্যথাকে কয়েকটি ভাগে ফেলা হয়। যেমন টেনশন হেডেক, মাইগ্রেন, সাইনাসজনিত ব্যথা, কিংবা ক্লাস্টার হেডেক। তবে এর বাইরেও রয়েছে নানা ভৌতিক ও মানসিক কারণ, যা মানুষের মাথা ব্যথাকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ ডা. ডেভিড ডজ লিখেছেন, “অধিকাংশ মাথা ব্যথার পেছনে সরাসরি কোনো প্রাণঘাতী কারণ থাকে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে, কাজের উৎপাদনশীলতা নষ্ট করে এবং মানসিক চাপে ফেলে।”

সবচেয়ে সাধারণ মাথা ব্যথার ধরন হলো টেনশন হেডেক। এ ধরনের ব্যথা সাধারণত মাথার দু’পাশে বা কপালে চাপের মতো অনুভূত হয়। এটি অনেকটা মাথার চারপাশে শক্ত করে বাঁধা ফিতার মতো লাগে। আন্তর্জাতিক স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল হেডেক সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো সময়ে টেনশন হেডেকের শিকার হয়েছেন। গবেষক ড. অ্যান্ড্রু মুর বলেন, “টেনশন হেডেক অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হলেও এটি খুব কম ক্ষেত্রেই গুরুতর রোগের লক্ষণ। তবে ঘন ঘন হলে অবশ্যই কারণ অনুসন্ধান করা দরকার।”

মাইগ্রেন মাথা ব্যথার একটি ভিন্ন এবং জটিল রূপ। এটি সাধারণত মাথার একপাশে তীব্র ব্যথা হিসেবে শুরু হয়, তবে ধীরে ধীরে অন্য পাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাইগ্রেন কেবল ব্যথাই দেয় না, এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, আলো বা শব্দে অস্বস্তি, চোখে ঝাপসা দেখা—এসব উপসর্গও থাকে। যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের স্নায়ুবিজ্ঞানী ডা. পিটার গুড বলেন, “মাইগ্রেন একধরনের স্নায়বিক অসুস্থতা, যেখানে মস্তিষ্কের ভেতরে স্নায়ুকোষের কার্যকলাপে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে। এটি শুধু সাধারণ মাথা ব্যথা নয়, বরং অনেক বেশি জটিল একটি সমস্যা।” পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ মাইগ্রেনে ভোগেন, এবং এটি মহিলাদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় তিনগুণ বেশি দেখা যায়।

সাইনাসজনিত মাথা ব্যথা আরেকটি বড় কারণ। যখন নাকের ভেতরের সাইনাস গহ্বরগুলো প্রদাহ বা সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, তখন মাথার সামনের অংশ ও চোখের চারপাশে চাপ অনুভূত হয়। বিশেষ করে ঝুঁকে কাজ করার সময় ব্যথা বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. এলিসা পিয়ার্স বলেন, “সাইনাস সংক্রমণ বা অ্যালার্জির কারণে মাথা ব্যথা হলে মূল সমস্যাটি সমাধান করা জরুরি। শুধু ব্যথা কমানোর ওষুধ খেলেই সমাধান হয় না।”

তবে সব মাথা ব্যথা যে শারীরিক কারণে হয়, তা নয়। মানসিক চাপও একটি বড় কারণ। অফিসের চাপ, পারিবারিক সমস্যা, ঘুমের অভাব, কিংবা অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মাথার ব্যথাকে বাড়িয়ে তোলে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষক ডা. মেলিসা কনরাড লিখেছেন, “মানসিক চাপ স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে এবং মাংসপেশিকে শক্ত করে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত মাথা ব্যথার রূপ নেয়।” এ কারণেই দেখা যায় পরীক্ষার আগে অনেক ছাত্র-ছাত্রী মাথা ব্যথায় ভোগেন বা অফিসের ডেডলাইন ঘনিয়ে এলে কর্মীদের মাথাব্যথা বেড়ে যায়।

শুধু মানসিক চাপই নয়, আধুনিক জীবনের কিছু অভ্যাসও অতিরিক্ত মাথা ব্যথার জন্য দায়ী। যেমন দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা, পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া, অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ বা হঠাৎ তা ছেড়ে দেওয়া, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস কিংবা অনিদ্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ডা. চার্লস হার্ডম্যান বলেন, “আজকের ডিজিটাল জীবনে আমরা দিনে গড়ে ৭-৮ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনে কাটাই। এর ফলে চোখ ও মস্তিষ্কে চাপ পড়ে, যা মাথা ব্যথাকে বাড়িয়ে তোলে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এটিই প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”

ক্লাস্টার হেডেক মাথা ব্যথার মধ্যে অন্যতম তীব্র ও দুর্বিষহ একটি রূপ। এটি সাধারণত মাথার একপাশে চোখের চারপাশে ঘটে এবং একটানা কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে বারবার দেখা দেয়। এই ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে অনেক রোগী একে “সুইসাইডাল হেডেক” নামেও উল্লেখ করেন। ফ্রান্সের লিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিস্ট ডা. জাঁ-পিয়ের বার্নো বলেন, “ক্লাস্টার হেডেক বিরল হলেও ভুক্তভোগীদের জন্য এটি ভয়াবহ কষ্টের কারণ। এর সঠিক কারণ পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ এর সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা করা হয়।”

অতিরিক্ত মাথা ব্যথার আরেকটি কারণ হলো ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার। অনেকেই ঘন ঘন মাথা ব্যথা হলে ব্যথানাশক ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ব্যথানাশক খাওয়া উল্টো মাথা ব্যথাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব মানুষ মাসে ১০ দিনের বেশি ব্যথানাশক খায়, তাদের মধ্যে ওষুধ-নির্ভর মাথা ব্যথা দ্রুত দেখা দেয়।

এ ছাড়া কিছু জটিল রোগও মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। যেমন ব্রেইন টিউমার, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, মেনিনজাইটিস বা স্নায়বিক প্রদাহ। যদিও এগুলো বিরল, তবে হঠাৎ অস্বাভাবিক ও তীব্র মাথা ব্যথা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ডা. লরা কেনেডি বলেন, “যদি মাথা ব্যথা হঠাৎ বজ্রপাতের মতো শুরু হয় বা এর সঙ্গে ঝাপসা দেখা, কথা জড়িয়ে আসা, হাত-পা অবশ হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকে, তবে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।”

সর্বোপরি বলা যায়, অতিরিক্ত মাথা ব্যথা কেবল একটি সাধারণ শারীরিক সমস্যা নয়, বরং এটি শরীর ও মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নানা অসঙ্গতির প্রতিফলন। তাই কেবল ব্যথানাশক খাওয়া বা অস্থায়ী উপশমের চেষ্টা যথেষ্ট নয়। বরং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত পানি পান, সুষম খাবার, মানসিক চাপ কমানো এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণ নেওয়া—এসবই হতে পারে কার্যকর সমাধান।

বেষকদের বক্তব্যগুলো থেকে স্পষ্ট যে, মাথা ব্যথার কারণ অনেক রকম হতে পারে—মানসিক চাপ থেকে শুরু করে স্নায়বিক অসুখ পর্যন্ত। তাই প্রত্যেকের উচিত নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকা, মাথা ব্যথাকে হালকাভাবে না নেওয়া, এবং প্রয়োজনে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া। কারণ অতিরিক্ত মাথা ব্যথা শুধুই অসুবিধা নয়, বরং তা শরীরের ভেতরের বড় কোনো সমস্যার সতর্কবার্তাও হতে পারে।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

ব্ল্যাকহেড দূর করার ঘরোয়া উপায়

প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো নিয়মিত মুখ পরিষ্কার রাখা। ত্বকের ধরণ অনুযায়ী নরম ও মানানসই একটি ফেসওয়াশ ব্যবহার করা উচিত। যদি ত্বক তৈলাক্ত হয় বা ব্রণের সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত ফেসওয়াশ ভালো কাজ করবে।

১২ ঘণ্টা আগে

রুপালি ইলিশের গল্প

২ দিন আগে

ইদ্রাকপুর দুর্গের ইতিহাস

মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলেই দুর্গটির নির্মাণ শুরু হয়। তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন মীর জুমলা, যিনি শুধু যুদ্ধকৌশলেই পারদর্শী ছিলেন না, বরং নদীপথে প্রতিরক্ষা গড়ার জন্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রশাসক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলার নদীপথ ছিল বাণিজ্য ও যুদ্ধের মূল কেন্দ্র। বিশেষ করে

২ দিন আগে

দারুচিনির ১০ উপকারিতা

দারুচিনি শরীরে প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন অনেক রোগের মূল কারণ হতে পারে, যেমন আর্থ্রাইটিস বা হৃদরোগ। দারুচিনির ভেতরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলো প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মার্কিন গবেষক ড. জর্জ স্যাভান্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “দারুচিনির মধ্যে থাকা পলিফেনল জাতীয় অ্যান্টিঅক্

২ দিন আগে