রুপালি ইলিশের গল্প

আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৩০
ইলিশের সঙ্গে মিশে আছে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ছবি: এআইয়ের তৈরি

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ কেবল একটি খাদ্য নয়, এটি বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জাতিগত পরিচয়ের প্রতীক। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা অববাহিকার এই রুপালি ইলিশ শত শত বছর ধরে বাঙালির খাবার টেবিল, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আমাদের মাঝে বিচরণ করছে। দুই দশক আগেও সচারচর ১ থেকে ২ কেজির ইলিশের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই ছিলো, যা আজ নেই। প্রবাদে আছে “মাছে-ভাতে বাঙালি”, আর সেই মাছের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইলিশ। বর্তমানে বছরে প্রায় ৬–৭ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়, যা দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২–১৫ শতাংশ। ইলিশকে কেন্দ্র করে জেলে, ব্যবসায়ী, আড়তদার, রপ্তানিকারকসহ প্রায় ২৫–৩০ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। একদিকে এটি রসনার তৃপ্তি জাগায়, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ভূমিকা রাখে। তবে ইলিশের গল্পে যেমন আছে গৌরব, তেমনি আছে সংকট ও সংরক্ষণের সংগ্রাম।

ইলিশ, প্রাচীন থেকে ঔপনিবেশিক আমল

প্রাচীন ভ্রমণকারী গ্রিক লেখক মেগাস্থেনিস ও আরব অভিযাত্রী ইবনে বতুতা বঙ্গোপসাগরের মাছের প্রাচুর্যের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে ইলিশ ছিল অন্যতম আকর্ষণ। মুঘল আমলে ইলিশ হয়ে ওঠে রাজকীয় ভোজের বিশেষ উপাদান। ঢাকার নবাবরা সম্রাট আকবরের দরবারে ইলিশ পাঠাতেন, যা শুধু খাদ্য নয়, বরং বাঙালি ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতা ইলিশ বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পদ্মা-মেঘনার ইলিশ তখন রেল ও নৌপথে কলকাতার অভিজাত মহলে পৌঁছে যেত। ব্রিটিশরা ইলিশকে ডাকত The King of Fish নামে। জমিদারবাড়ির ভোজে ইলিশ পরিবেশন ছিল সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। ইতিহাসের এসব পর্ব প্রমাণ করে যে, ইলিশ কেবল খাদ্য নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির ধারাবাহিকতার এক অনন্য প্রতীক।

সংস্কৃতি ও ভোগে

ইলিশ বাঙালির সংস্কৃতি ও আবেগের গভীরে প্রোথিত। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন “শাদা শাদা রূপালি ইলিশ…।” লোকগানেও ইলিশের উল্লেখ পাওয়া যায় “দুই কুলি দুই মান ইলিশ আনলো গঙ্গার ঘাটে।” প্রবাদে বলা হয় “বাঙালির দুই প্রিয়: ইলিশ আর পদ্মা।” পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ এখন আর কেবল খাদ্য নয়, বরং জাতীয় উৎসবের প্রতীক। পদ্মার ইলিশের স্বাদ অনন্য; এর তেলযুক্ত নরম মাংস ভোক্তাদের জন্য অসাধারণ আনন্দের উৎস। গবেষণা বলছে, পদ্মার প্রবাহমান পানির খনিজ উপাদান ও প্ল্যাঙ্কটন ইলিশের শরীরে বিশেষ ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করে, যা স্বাদকে করে তোলে অতুলনীয়। ভোক্তারা সাধারণত ৭০০–১২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশকে সর্বোত্তম মনে করেন এবং বর্তমানে যা ১০০০ থেকে ২০০০ টাকায় পাওয়া যায়, তাই সাধারণ মানুষেরও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।

বাজার ও ক্রয়ক্ষমতা

আমাদের দেশে ইলিশের দাম সাধারণত আকার ও মৌসুমভেদে ওঠানামা করে। ছোট আকারের ইলিশ (৪০০–৭০০ গ্রাম) সাধারণত ৮০০–১২০০ টাকায় বিক্রি হয়, যা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য জনপ্রিয়। মাঝারি আকারের ইলিশ (৭০০–১,২০০ গ্রাম) বিক্রি হয় ১,০০০–২,০০০ টাকায়, যা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত উভয়ের কাছে সমাদৃত। বড় আকারের ইলিশ (১.২–২ কেজি বা তার বেশি) বিক্রি হয় ২,৫০০–৩,২০০ টাকায়, যা উচ্চবিত্তদের জন্য বা উপহার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভোক্তা জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ পরিবার বছরে অন্তত একবার ইলিশ কেনে। বিশেষত পহেলা বৈশাখ, ঈদ ও দুর্গাপূজার সময়ে ইলিশের দাম দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়, তবুও মানুষ কিনতে দ্বিধা করে না। সামাজিক মর্যাদা, নতুন আত্মীয়, আপনজন, পারিবারিক আনন্দ ও সাংস্কৃতিক আবেগের কারণে ইলিশ কেনা অনেকাংশেই আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতি ও উৎপাদন

ইলিশ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় খাত। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশে আনুমানিক ৫.৮৫ লাখ টন ইলিশ ধরা হয়েছে, যা ২০২১–২২ সালের ৫.৬৬ লাখ টনের তুলনায় প্রায় ৩.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। সরাসরি প্রায় ৪–৫ লাখ জেলে পরিবার এবং পরোক্ষভাবে ২০–২৫ লাখ মানুষ ইলিশকেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। জেলে সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ট্রলার নির্মাণ, জাল প্রস্তুত, বরফকল, বাজারজাতকরণ, পরিবহন, এসব খাতও ইলিশ অর্থনীতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক গবেষণা অনুযায়ী, দেশের মৎস্য খাতের মোট আয়ের ২০ শতাংশেরও বেশি আসে ইলিশ থেকে। শুধু অভ্যন্তরীণ বাজার নয়, উৎসবকেন্দ্রিক ভোক্তা ব্যয় ইলিশের অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৫০০–৬০০ কোটি টাকার ইলিশ রপ্তানি করে। ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এর উচ্চ চাহিদা রয়েছে। প্রবাসী বাঙালিরা বৈশাখ, ঈদ ও দুর্গাপূজার সময়ে বিপুল পরিমাণে ইলিশ কিনে থাকেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দুর্গাপূজার আগে বাংলাদেশ সরকার একাই ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছিল ভারতে, যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ইলিশের দাম প্রতিকেজি ১০–১২ ডলার পর্যন্ত, যেখানে ভারতের ইলিশ ৬–৮ ডলার ও মিয়ানমারের ইলিশ ৪–৬ ডলারে বিক্রি হয়। পদ্মা-মেঘনার ইলিশের স্বাদ ও গুণগত মানই এই পার্থক্যের মূল কারণ। এভাবে ইলিশ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সংরক্ষণনীতি ও চ্যালেঞ্জ

সরকার ইলিশ সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। জাটকা ধরা নিষিদ্ধ, মা ইলিশ রক্ষায় মৌসুমি অবরোধ, অভয়ারণ্য স্থাপন, এসব নীতির ফলে উৎপাদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সংকট এখনো কাটেনি । নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, বাঁধ নির্মাণ, নদী দখল, শিল্পবর্জ্য ও দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, অতিরিক্ত মাছ ধরা ও জাটকা নিধন, এসব কারণে ইলিশের অভয়ারণ্য ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। মৌসুমি নিষেধাজ্ঞার সময় প্রায় দুই মাস জেলেরা মাছ ধরতে না পারায় তারা বিপাকে পড়ে। সরকার তাদের জন্য ভর্তুকি, চাল ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ব্যবস্থাপনা, গবেষণা ও নদী সংরক্ষণ ছাড়া ইলিশের স্থায়িত্ব এবং বিস্তার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ২০১৭ সালে ইলিশকে বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ফলে পদ্মার ইলিশ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পুষ্টিগুণেও ইলিশ অনন্য, এতে রয়েছে উচ্চমানের প্রোটিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এ, ডি, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। হৃদরোগ প্রতিরোধ, শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতায় ইলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে ইলিশকে রক্ষা করা মানে কেবল একটি মাছকে নয়, বরং আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা। প্রজনন ও বৃদ্ধির নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, শিকারি, জেলে সমাজ ও ব্যাবসায়ীদের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে ইলিশ মাছের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সর্বোপরি টেকসই ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি, জেলে-সরকার-গবেষক ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে রুপালি ইলিশের এই গৌরবময় ইতিহাসকে দীর্ঘস্থায়ী করতে।

লেখক: বেসরকারি নর্থ সাউথ উনিভার্সিটিতে কর্মরত এবং সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নালিস্টস এসোসিয়েশন

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

দৈইখাওয়া গ্রামের হট্টিটি

লাল লতিকা হট্টিটি মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এই পাখিটি খুবেই চটপটে ও চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তার সতর্ক ভঙ্গি ও জলশয়ের পাতার ওপর দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা।

১ দিন আগে

মারা গেছেন ‘থ্রি ইডিয়েটস’ সিনেমার অধ্যাপক

অচ্যুত পোতদারের অভিনয়জীবন ছিল চার দশকেরও বেশি। তিনি ১২৫টির বেশি হিন্দি ও মারাঠি ছবিতে কাজ করেছেন। হিন্দি ও মারাঠি চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সহকর্মী, ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। বাস্তব জীবনেও তিনি ছিলেন নম্র, অমায়িক এবং বহুমুখী প্রতিভ

১ দিন আগে

থাইরয়েড সমস্যায় কোন কোন ফল খাওয়া উচিত

থাইরয়েড সমস্যায় ওষুধের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে কিছু ফল আছে যেগুলো থাইরয়েড রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। এসব ফলে থাকে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা থাইরয়েড গ্রন্থির কাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র ফল খেয়েই থাইরয়েড সারানো

১ দিন আগে

শরৎকালে কেন কাশফুল ফোটে

শরৎকালে দিন আর রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান বাড়তে শুরু করে। দিনে থাকে হালকা রোদ, আর রাতে আসে শীতলতা। এই পরিবর্তিত আবহাওয়া কাশগাছের ভেতরে হরমোনের মতো কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালু করে, যা ফুল ফোটার সংকেত দেয়। উদ্ভিদতত্ত্বের গবেষকরা বলেন, প্রতিটি গাছেরই একটা নির্দিষ্ট "ফোটার মৌসুম" থাকে। কাশফুলের জন্য সেই

২ দিন আগে