স্বাস্থ্য

শরীর আগুনে পুড়লে করণীয়

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

আগুন মানুষের জীবনে যেমন আশীর্বাদ, তেমনি কখনও কখনও হয়ে ওঠে অভিশাপ। রান্না, আলো বা উষ্ণতা—এসবের জন্য আগুন অপরিহার্য। কিন্তু সামান্য অসাবধানতা আগুনকে পরিণত করতে পারে ভয়ংকর বিপর্যয়ে। রান্নাঘরে চুলার গ্যাস লিক হয়ে বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, কিংবা শিল্পকারখানার দুর্ঘটনা—এমন অসংখ্য ঘটনায় মানুষ দগ্ধ হয় এবং জীবনের চাকা থেমে যেতে বসে। তাই শরীর আগুনে পুড়ে গেলে কী করতে হবে, কোন ভুলগুলো করা যাবে না, আর কীভাবে দ্রুত ক্ষতি কমানো যায়—এসব জানা প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

আগুনে দগ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ঘটে। যখন ত্বকের ওপর আগুন লাগে, প্রথমে বাইরের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ত্বকের লালচে দাগ, ব্যথা এবং হালকা জ্বালাকে বলে প্রথম স্তরের পোড়া। দ্বিতীয় স্তরে ত্বকে ফোসকা পড়ে এবং ব্যথা অনেক তীব্র হয়। তৃতীয় স্তরের পোড়া সবচেয়ে বিপজ্জনক। এতে ত্বক ও ভেতরের টিস্যু একসঙ্গে পুড়ে যায়, কখনও হাড় পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় জীবনহানি পর্যন্ত হতে পারে।

আগুনে পোশাক জ্বলে উঠলে আতঙ্কে অনেকেই দৌড়াতে শুরু করেন। কিন্তু দৌড়ানো খুবই বিপজ্জনক, কারণ এতে বাতাস আগুনকে আরও ছড়িয়ে দেয়। বরং তখনই প্রয়োগ করতে হবে বহুল পরিচিত নিয়ম—“স্টপ, ড্রপ অ্যান্ড রোল।” অর্থাৎ দাঁড়ানো থামাতে হবে, মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে এবং গড়াগড়ি খেতে হবে। এতে পোশাকে লেগে থাকা আগুন দ্রুত নেভে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের গবেষক ড. জন হল এই বিষয়ে বলেছেন—“আগুনের প্রথম মুহূর্তে আতঙ্কই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। শান্ত থেকে মাটিতে গড়াগড়ি খেলে আগুন ছড়িয়ে পড়া অনেকটাই থামানো যায়।”

আগুন নেভানোর পর প্রাথমিক চিকিৎসাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা পানি সবচেয়ে কার্যকর উপায়। আগুনে পুড়ে যাওয়া স্থানে টানা দশ থেকে বিশ মিনিট পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি ঢালতে হবে। এতে ব্যথা অনেকটা কমে, ক্ষতস্থানে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয় এবং গভীর ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ব্রিটিশ রেড ক্রস-এর চিকিৎসক ড. রিচার্ড স্ট্যান্টন বলেছেন—“ঠাণ্ডা পানি হলো আগুনে দগ্ধ হওয়ার প্রথম ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা। এটি শুধু ব্যথা কমায় না, বরং ত্বকের ভেতরে আগুনের প্রভাব আরও ছড়িয়ে পড়তেও বাধা দেয়।”

তবে প্রাথমিক চিকিৎসায় অনেকেই ভুল করে বসেন। কেউ কেউ দুধ, মাখন, তেল কিংবা বরফ পোড়া জায়গায় লাগান। এগুলো একেবারেই ব্যবহার করা যাবে না। এসব জিনিস ক্ষতের ভেতরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বাড়ায়, চিকিৎসা জটিল করে তোলে। বরফ ব্যবহারে ত্বক আরও নষ্ট হতে পারে। আমেরিকান বার্ন অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষজ্ঞ ড. জোসেফ লুইস বলেছেন—“পোড়া স্থানে ঘরোয়া নানা কিছু লাগানো বিপজ্জনক। এগুলো ক্ষত গভীর করে তোলে। সবচেয়ে নিরাপদ হলো পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি আর জীবাণুমুক্ত ব্যান্ডেজ ব্যবহার।”

এখন প্রশ্ন হলো, কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি? আসলে দগ্ধ হওয়ার মাত্রা যদি বেশি হয়, ফোসকা পড়ে যায়, কিংবা মুখ, হাত, পা অথবা যৌনাঙ্গে পোড়া লাগে, তবে দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। এসব জায়গায় ত্বক নাজুক এবং সহজেই স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। আবার শরীরের বড় অংশ পুড়ে গেলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোই জীবন রক্ষার উপায়।

কিছু ক্ষেত্রে আগুনে শরীর নয়, শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধোঁয়া বা আগুনের তাপে শ্বাসনালী পোড়া মারাত্মক বিপজ্জনক। এ অবস্থায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রোগীকে সোজা বসিয়ে রাখা, অক্সিজেন দেওয়া এবং দ্রুত বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি।

শরীর আগুনে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা শারীরিক কষ্টেই সীমাবদ্ধ থাকে না। মানসিক ক্ষতও অনেক গভীর হয়। দগ্ধ রোগীদের অনেকেই আয়নায় নিজের মুখ বা শরীর দেখতে চান না। আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে, হতাশা বাড়ে। কানাডার মনোবিজ্ঞানী ড. সুসান ম্যাককোয়ারি এ বিষয়ে বলেছেন—“পোড়া রোগীরা এমন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন যা চোখে দেখা যায় না। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, সাহস দেওয়া, কথা শোনা—এসবই চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”

তাই পরিবারের ভূমিকা এখানে অপরিসীম। দগ্ধ রোগীকে একা করে রাখা যাবে না। তাঁর মনে সাহস জাগানো, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করা—এসব বিষয় সুস্থ হওয়ার পথে বড় ভূমিকা রাখে।

অবশ্যই মনে রাখতে হবে প্রতিরোধই সেরা প্রতিকার। রান্নাঘরে ঢিলা কাপড় না পরা, শিশুদের হাতে দিয়াশলাই বা লাইটার না দেওয়া, ঘরে সবসময় ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা, বিদ্যুতের তার নিয়মিত পরীক্ষা করা—এসব ছোট ছোট পদক্ষেপ বড় দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করে। আমেরিকার ফায়ার সেফটি বিশেষজ্ঞ ড. হ্যারল্ড নেলসন বলেছিলেন—“আগুন থেকে বাঁচার সেরা উপায় হলো প্রতিরোধ। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই যদি মানুষ সচেতন হয়, তাহলে প্রাণ বাঁচে, সম্পদ বাঁচে।”

সবশেষে বলা যায়, শরীর আগুনে পুড়ে যাওয়া এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে ক্ষতি কমানো যায়, এমনকি প্রাণও রক্ষা করা সম্ভব। আগুন নেভানোর পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ক্ষত ঠাণ্ডা করা, কোনো ভুল ঘরোয়া পদ্ধতি না ব্যবহার করা, দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, রোগীর মানসিক কষ্টকে গুরুত্ব দেওয়া—এসবই করণীয়। আর সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো প্রতিরোধ। কারণ আগুনের সঙ্গে মানুষের জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, কিন্তু সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বিপদ থেকে দূরে রাখা আমাদের বুদ্ধিমত্তারই প্রমাণ।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

কলার মোঁচার পুষ্টিগুণ

কলার মোঁচা, বা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় “banana peel”, আমাদের জীবনে অনেক সময়ই অবহেলিত একটি জিনিস। আমরা কলা খেয়ে মোঁচাটা সাধারণত ফেলে দিই। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কলার মোঁচায় রয়েছে চমকপ্রদ অনেক উপকারিতা, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি। এই মোঁচা শুধুমাত্র একটি বর্জ্য নয়, বরং এটি অনেক

৩ দিন আগে

অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছে গাছপালা

ভাবুন তো, ঘরের কোণে রাখা টবে একগুচ্ছ গাছ, আর রাত নামতেই হালকা নীল, সবুজ, লাল কিংবা বেগুনি আলো ছড়িয়ে পুরো ঘরটাকে আলোকিত করে তুলল। বিদ্যুতের বাল্ব নয়, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক গাছের ভেতর থেকেই বের হচ্ছে সেই আলো। এমন স্বপ্নময় কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন চীনের একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা তৈরি করেছেন পৃথিবীর প্রথম ব

৩ দিন আগে

মধুর সঙ্গে রসুন কীভাবে খাবেন

মানুষের খাদ্যাভ্যাসে মধু আর রসুন দুটোই বহুকাল ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। দুটো উপাদান আলাদাভাবে যেমন ভেষজ গুণে ভরপুর, একসাথে খাওয়ার বিষয়টিও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছে। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেমন আয়ুর্বেদ বা ইউনানি চিকিৎসায় রসুনকে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক, তেমনি মধুকে ধরা হয় দেহশক্তি বৃ

৩ দিন আগে

যা আছে টিকটকের কমিউনিটি গাইডলাইনে

টিকটক এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ নিজের পছন্দের জিনিস আবিষ্কার করে, নতুন কমিউনিটি গড়ে তোলে এবং নিজের ভাবনা বা প্রতিভা প্রকাশ করে। আমাদের লক্ষ্য খুবই সহজ—মানুষকে সৃজনশীলতায় অনুপ্রাণিত করা এবং আনন্দ দেওয়া।

৩ দিন আগে