ড. মিহির কুমার রায়
চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ২২ বছর বয়সে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যখন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যান তখন তার বয়স ৫৩ বছর। মাঝের তিন দশক চুটিয়ে কাজ করেছেন, অভিনয় করেছেন প্রায় দুই শ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন, পরিচালনাও করেছেন। সব ধরনের চরিত্র তো বটেই, বিশেষ করে হয়ে উঠেছিলেন রোমান্টিক চরিত্রের সমার্থক। ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে থাকতেই তাই তিনি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক।
আজ ৩ সেপ্টেম্বর, সেই মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্মদিন। ১৯২৬ সালের এই দিনে কলকাতায় আহিরীটোলায় জন্ম হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পীর। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে তার মতো জনপ্রিয় নায়ক আর আসেনি। ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাত অভিনেতা মনে করা হয় তাকে।
উত্তম কুমারের বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, মা চপলা দেবী। তিন ভাইয়ের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন সবার বড়। তার প্রকৃত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, সিনেমায় গিয়ে যা পরিণত হয় উত্তম কুমারে। তার ছোট ভাই তরুণ কুমারও ছিলেন একজন শক্তিশালী অভিনেতা, চরিত্রাভিনেতা হিসেবে যার জুড়ি মেলা ভার।
কলকাতার চক্রবেড়িয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু উত্তম কুমারের। পরে কলকতার সাউথ সাব-আরবান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন গোয়েংকা কলেজ থেকে। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের ঝোঁক থাকলেও পারিবারিক অনটনের কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের পরই কলকাতা পোর্টে চাকরি নিতে হয় তাকে। কাজের চাপে স্নাতকও শেষ করতে পারেননি, ছেড়ে দিতে হয়েছে শেষ বর্ষে।
উত্তম কুমার ও সুচিত্র সেন, বাংলার জনপ্রিয়তম রোমান্টিক জুটি।
চাকরি চালিয়ে গেলেও অভিনয়ের নেশা উত্তম কুমারকে ছেড়ে যায়নি। ১৯৪৭ সালে ‘মায়াডোর’ নামে এক হিন্দি ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রের জগতে যাত্রা শুরু তার। তবে সে সিনেমা আলোর মুখ দেখেনি। তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ‘দৃষ্টিদান’, যা মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। পরের বছর মুক্তি পায় ‘কামনা’।
১৯৫১ সাল পর্যন্ত একে একে সাতটি ছবি মুক্তি পায় উত্তম কুমারের। এর মধ্যে তিনি নিজের প্রকৃত নাম অরুণ কুমার ছাড়াও উত্তম চ্যাটার্জি ও অরূপ কুমার স্ক্রিননেম ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ সিনেমা ‘সহযাত্রী’তে প্রথম ব্যবহার করেন উত্তম কুমার নামটি। এ নামে করেন সপ্তম ছবি ‘সঞ্জীবনী’ও। কিন্তু সাতটি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই ফ্লপ হয়। উত্তম কুমারের কপালে জোটে ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ তকমা।
অবস্থাদৃষ্টে চলচ্চিত্রের ‘ভূত’ মাথা থেকে নামিয়ে চাকরিতে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্তই করে ফেলেছিলেন অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় তথা উত্তম কুমার। কিন্তু পরের তিন দশক ধরে যিনি চলচ্চিত্র জগতে রাজত্ব করবেন, তাকে থামিয়ে রাখে সাধ্য কার!
চলচ্চিত্র ছেড়ে দেবো করতে করতেই পাহাড়ি সান্যালের হাত ধরে অভিনয় করেন ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। ১৯৫২ সালের সে ছবিটি বেশ নজর কাড়ে অনেকের। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। সুচিত্রা সেনের বিপরীতে উত্তমের এই ছবিটি বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার! উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠারও সূচনা তার সঙ্গে।
উত্তম কুমার, ডানে নায়ক ছবির পোস্টার।
যে উত্তম-সুচিত্রা জুটি বাঙালিকে রোমান্টিসিজমে মাতিয়ে রেখেছে দশকের পর দশক, এমনকি এখনো, তারও যাত্রা শুরু সে সিনেমা দিয়েই। এরপর দুজনে মিলে একে একে উপহার দিয়ে গেছেন ‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সাগরিকা’র মতো হিট-সুপার হিট-মেগা হিট ছবি। উত্তমের শ দুয়েক ছবির মধ্যে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে সব মিলিয়ে ছবির সংখ্যা ৩১।
ষাটের দশক ছিল উত্তম কুমারের জন্য সাফল্যে মোড়ানো একটি দশক। ততদিনে তার অভিনয় সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আর অবকাশ নেই। বক্স অফিসেও তিনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এ দশকেই ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ দিয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-সমালোচকদের। ভুবন ভোলানো হাসি আর প্রেমিকসুলভ আচরণের বাইরে নিজের অভিনয়সত্ত্বাকে তুলে ধরেন এ ছবিতে। ‘চিড়িয়াখানা’য় ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্র আরও এক নতুন মাত্রা যোগ করে তার ক্যারিয়ারে।
এর মধ্যেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন এক অভিনয়শিল্পীর ব্যক্তিগত ও সিনেম্যাটিক জীবনের বাস্তবতা আর মনস্তাত্ত্বিক লড়াই নিয়ে ‘নায়ক’। এই সিনেমার মুখ্য চরিত্র অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের জন্য তিনি উত্তম কুমারকে বেছে নেন। উত্তমও যেন এই ছবিতে অভিয়ন করতে গিয়ে খুঁজে পান নিজের অন্তর্গত সত্তাকেই। সত্যজিৎ-উত্তম জুটির এই যজ্ঞ পরিণত হয় বাংলা সিনেমার এক মাস্টারপিসে।
সময় যত গড়িয়েছে, উত্তম কুমারও নিজের অভিনয়সত্তাকে ততই ভেঙেছেন, প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন নানাদিকে। ‘দেয়া নেয়া’ রোমান্টিক কমেডি দিয়েও যেমন মাতিয়েছেন দর্শকদের। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি ১৫টির মতো হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি।
স্ত্রী গৌরী দেবী ও সন্তান গৌতমের সঙ্গে উত্তম কুমার।
কেবল অভিনয় নয়, পরিচালক-প্রযোজক হিসেবেও উত্তম কুমার সফল। যে পাঁচবার তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, তার চারবারই ছিল প্রযোজক হিসেবে! ‘উত্তর ফাল্গুনী’ প্রযোজনা করে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার। তার প্রযোজিত ‘হারানো সুর’ তৃতীয়, ‘সপ্তপদী’ দ্বিতীয়, আর ‘জতুগৃহ’ তৃতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পেয়েছে জাতীয় পুরস্কার। অন্যদিকে অভিনয়শিল্পী উত্তম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৬৭ সালে, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ আর ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমার জন্য।
এর বাইরে অন্যান্য পুরস্কারের সংখ্যা গুনে শেষ করা কঠিন। ১৯৭৫ সালে পান ‘মহানায়ক’ উপাধি, যা সংসদে ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে সম্মানি হিসেবে পেয়েছিলেন ৫০ হাজার রুপিও।
এ তো গেল পর্দার উত্তম কুমারের গল্প। কিন্তু উত্তম কুমার নামের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবন কেমন ছিল? মাত্র ২১ বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন গৌরী গাঙ্গুলীর সঙ্গে। ১৯৫১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মে নেয় তার একমাত্র ছেলে গৌতম।
উত্তম কুমারের সঙ্গে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে যেসব নায়ির অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন— সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, সাবিত্রী চট্র্যোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, বৈজয়ন্তি মালা, তনুজা, সন্ধ্যা রায়, সুমিত্রা মুখাজী।
পর্দায় নানা ভূমিকায় উত্তম কুমার।
জনপ্রিয়তম এসব নায়িকাদের সঙ্গে উত্তম কুমারকে ঘিরে একটি কার্টুন প্রকাশ করেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা। সেখানে গোল একটি ছবিতে দেখানো হয়েছিল— মহানায়ক উত্তম কুমার একটি বৃত্তের মাঝখানে এবং এর মাঝখানে গোলাকৃতিতে নায়িকারা ঘুরছে। এতে লেখা ছিল ‘যৌবনে যারা সুন্দর, গগনে জ্বলিত তারার মতো/ উত্তমের সাথে নায়িকা সাজিয়া হরিত সবার চিত্ত। বিগত যৌবনে আজিকে তারা মনিহারা সব ফনি/ বিধির বিধান অজিও উত্তম নায়কের শিরোমণি।’
গ্ল্যামার জগতের আরও অনেক তারকার মতো উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত জীবনও খুব একটা স্থির ছিল না। অবিসংবাদিত সেরা রোমান্টিক হিরো হওয়ায় নায়িকাদের নিয়ে গুঞ্জনের শেষ ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। এই জুটির ১৯৫৪ সালের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার পোস্টার ঝড় তোলের দুজনেরই ব্যক্তিজীবনে। সেই পোস্টারে লেখা ছিল— ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা’। সেই প্রণয় পর্দার বাইরে বাস্তবেও মূর্ত ছিল— এমন বিশ্বাস করার মতো মানুষের অভাব ছিল না।
তবে উত্তম কুমার যার পর্দার সম্পর্ককে বাস্তবে টেনে এনেছিলেন, তিনি সুপ্রিয়া দেবী। তিনি ঘর বেঁধেছিলেন বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জির সঙ্গে। কিন্তু সংসার জীবনে সুখি ছিলেন না সুপ্রিয়া। ১৯৫৪ সালে বিশ্বজিতের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। এদিকে উত্তম কুমার একদিকে বিচ্ছেদ করতে পারছিলেন না গৌরীর সঙ্গে, অন্যদিকে ছাড়তে পারছিলেন না সুপ্রিয়া দেবীকেও।
এমন উভয় সংকটের মধ্যে গৌরী গাঙ্গুলির সঙ্গে বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিকতা না চুকিয়েই ১৯৬২ সালে সুপ্রিয়া দেবীতে বিয়ে করেন উত্তম কুমার। সামাজিক ও ধর্মীয় সব প্রথা অনুসরণ করলেও গৌরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ না হওয়ায় এ সম্পর্ককে রেজিস্ট্রি তথা কাগজে-কলমে বাঁধা যায়নি। এ নিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গে ঝড় বয়ে গেলেও তাতে কান দেননি উত্তম-সুপ্রিয়ার কেউই। তারা নিজেদের মতো করে সংসার করে গেছেন।
সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমার, শেষ জীবনে প্রায় ১৭ বছর সংসার করেছেন তারা।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মহানায়ক মাত্র ৫৩ বছর বয়সে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। একাধিকবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার উত্তম কুমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৮০ সালে ২৪ জুলাই। রেখে যান দুই স্ত্রী গৌরী গাঙ্গুলী ও সুপ্রিয়া দেবী, একপুত্র গৌতম, এক কন্যা সোমা ও একমাত্র নাতি গৌরবকে।
বেঁচে থাকলে আজকের জন্মদিনে ৯৯ বছর পার করে শতবর্ষে পা রাখতেন মহানায়ক উত্তম কুমার। তবে তিনি না থাকলেও রেখে গেছেন তার চলচ্চিত্রের ভাণ্ডার, যার একেকটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মণি-মুক্তার সমতুল্য। জন্মদিনে সেই মহানায়ককে জানাই অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনির্ভাসিটি; সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি ঢাকা
চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ২২ বছর বয়সে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যখন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যান তখন তার বয়স ৫৩ বছর। মাঝের তিন দশক চুটিয়ে কাজ করেছেন, অভিনয় করেছেন প্রায় দুই শ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন, পরিচালনাও করেছেন। সব ধরনের চরিত্র তো বটেই, বিশেষ করে হয়ে উঠেছিলেন রোমান্টিক চরিত্রের সমার্থক। ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে থাকতেই তাই তিনি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক।
আজ ৩ সেপ্টেম্বর, সেই মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্মদিন। ১৯২৬ সালের এই দিনে কলকাতায় আহিরীটোলায় জন্ম হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পীর। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে তার মতো জনপ্রিয় নায়ক আর আসেনি। ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাত অভিনেতা মনে করা হয় তাকে।
উত্তম কুমারের বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, মা চপলা দেবী। তিন ভাইয়ের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন সবার বড়। তার প্রকৃত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, সিনেমায় গিয়ে যা পরিণত হয় উত্তম কুমারে। তার ছোট ভাই তরুণ কুমারও ছিলেন একজন শক্তিশালী অভিনেতা, চরিত্রাভিনেতা হিসেবে যার জুড়ি মেলা ভার।
কলকাতার চক্রবেড়িয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু উত্তম কুমারের। পরে কলকতার সাউথ সাব-আরবান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন গোয়েংকা কলেজ থেকে। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের ঝোঁক থাকলেও পারিবারিক অনটনের কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের পরই কলকাতা পোর্টে চাকরি নিতে হয় তাকে। কাজের চাপে স্নাতকও শেষ করতে পারেননি, ছেড়ে দিতে হয়েছে শেষ বর্ষে।
উত্তম কুমার ও সুচিত্র সেন, বাংলার জনপ্রিয়তম রোমান্টিক জুটি।
চাকরি চালিয়ে গেলেও অভিনয়ের নেশা উত্তম কুমারকে ছেড়ে যায়নি। ১৯৪৭ সালে ‘মায়াডোর’ নামে এক হিন্দি ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রের জগতে যাত্রা শুরু তার। তবে সে সিনেমা আলোর মুখ দেখেনি। তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ‘দৃষ্টিদান’, যা মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। পরের বছর মুক্তি পায় ‘কামনা’।
১৯৫১ সাল পর্যন্ত একে একে সাতটি ছবি মুক্তি পায় উত্তম কুমারের। এর মধ্যে তিনি নিজের প্রকৃত নাম অরুণ কুমার ছাড়াও উত্তম চ্যাটার্জি ও অরূপ কুমার স্ক্রিননেম ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ সিনেমা ‘সহযাত্রী’তে প্রথম ব্যবহার করেন উত্তম কুমার নামটি। এ নামে করেন সপ্তম ছবি ‘সঞ্জীবনী’ও। কিন্তু সাতটি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই ফ্লপ হয়। উত্তম কুমারের কপালে জোটে ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ তকমা।
অবস্থাদৃষ্টে চলচ্চিত্রের ‘ভূত’ মাথা থেকে নামিয়ে চাকরিতে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্তই করে ফেলেছিলেন অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় তথা উত্তম কুমার। কিন্তু পরের তিন দশক ধরে যিনি চলচ্চিত্র জগতে রাজত্ব করবেন, তাকে থামিয়ে রাখে সাধ্য কার!
চলচ্চিত্র ছেড়ে দেবো করতে করতেই পাহাড়ি সান্যালের হাত ধরে অভিনয় করেন ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। ১৯৫২ সালের সে ছবিটি বেশ নজর কাড়ে অনেকের। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। সুচিত্রা সেনের বিপরীতে উত্তমের এই ছবিটি বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার! উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠারও সূচনা তার সঙ্গে।
উত্তম কুমার, ডানে নায়ক ছবির পোস্টার।
যে উত্তম-সুচিত্রা জুটি বাঙালিকে রোমান্টিসিজমে মাতিয়ে রেখেছে দশকের পর দশক, এমনকি এখনো, তারও যাত্রা শুরু সে সিনেমা দিয়েই। এরপর দুজনে মিলে একে একে উপহার দিয়ে গেছেন ‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সাগরিকা’র মতো হিট-সুপার হিট-মেগা হিট ছবি। উত্তমের শ দুয়েক ছবির মধ্যে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে সব মিলিয়ে ছবির সংখ্যা ৩১।
ষাটের দশক ছিল উত্তম কুমারের জন্য সাফল্যে মোড়ানো একটি দশক। ততদিনে তার অভিনয় সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আর অবকাশ নেই। বক্স অফিসেও তিনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এ দশকেই ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ দিয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-সমালোচকদের। ভুবন ভোলানো হাসি আর প্রেমিকসুলভ আচরণের বাইরে নিজের অভিনয়সত্ত্বাকে তুলে ধরেন এ ছবিতে। ‘চিড়িয়াখানা’য় ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্র আরও এক নতুন মাত্রা যোগ করে তার ক্যারিয়ারে।
এর মধ্যেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন এক অভিনয়শিল্পীর ব্যক্তিগত ও সিনেম্যাটিক জীবনের বাস্তবতা আর মনস্তাত্ত্বিক লড়াই নিয়ে ‘নায়ক’। এই সিনেমার মুখ্য চরিত্র অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের জন্য তিনি উত্তম কুমারকে বেছে নেন। উত্তমও যেন এই ছবিতে অভিয়ন করতে গিয়ে খুঁজে পান নিজের অন্তর্গত সত্তাকেই। সত্যজিৎ-উত্তম জুটির এই যজ্ঞ পরিণত হয় বাংলা সিনেমার এক মাস্টারপিসে।
সময় যত গড়িয়েছে, উত্তম কুমারও নিজের অভিনয়সত্তাকে ততই ভেঙেছেন, প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন নানাদিকে। ‘দেয়া নেয়া’ রোমান্টিক কমেডি দিয়েও যেমন মাতিয়েছেন দর্শকদের। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি ১৫টির মতো হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি।
স্ত্রী গৌরী দেবী ও সন্তান গৌতমের সঙ্গে উত্তম কুমার।
কেবল অভিনয় নয়, পরিচালক-প্রযোজক হিসেবেও উত্তম কুমার সফল। যে পাঁচবার তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, তার চারবারই ছিল প্রযোজক হিসেবে! ‘উত্তর ফাল্গুনী’ প্রযোজনা করে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার। তার প্রযোজিত ‘হারানো সুর’ তৃতীয়, ‘সপ্তপদী’ দ্বিতীয়, আর ‘জতুগৃহ’ তৃতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পেয়েছে জাতীয় পুরস্কার। অন্যদিকে অভিনয়শিল্পী উত্তম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৬৭ সালে, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ আর ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমার জন্য।
এর বাইরে অন্যান্য পুরস্কারের সংখ্যা গুনে শেষ করা কঠিন। ১৯৭৫ সালে পান ‘মহানায়ক’ উপাধি, যা সংসদে ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে সম্মানি হিসেবে পেয়েছিলেন ৫০ হাজার রুপিও।
এ তো গেল পর্দার উত্তম কুমারের গল্প। কিন্তু উত্তম কুমার নামের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবন কেমন ছিল? মাত্র ২১ বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন গৌরী গাঙ্গুলীর সঙ্গে। ১৯৫১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মে নেয় তার একমাত্র ছেলে গৌতম।
উত্তম কুমারের সঙ্গে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে যেসব নায়ির অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন— সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, সাবিত্রী চট্র্যোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, বৈজয়ন্তি মালা, তনুজা, সন্ধ্যা রায়, সুমিত্রা মুখাজী।
পর্দায় নানা ভূমিকায় উত্তম কুমার।
জনপ্রিয়তম এসব নায়িকাদের সঙ্গে উত্তম কুমারকে ঘিরে একটি কার্টুন প্রকাশ করেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা। সেখানে গোল একটি ছবিতে দেখানো হয়েছিল— মহানায়ক উত্তম কুমার একটি বৃত্তের মাঝখানে এবং এর মাঝখানে গোলাকৃতিতে নায়িকারা ঘুরছে। এতে লেখা ছিল ‘যৌবনে যারা সুন্দর, গগনে জ্বলিত তারার মতো/ উত্তমের সাথে নায়িকা সাজিয়া হরিত সবার চিত্ত। বিগত যৌবনে আজিকে তারা মনিহারা সব ফনি/ বিধির বিধান অজিও উত্তম নায়কের শিরোমণি।’
গ্ল্যামার জগতের আরও অনেক তারকার মতো উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত জীবনও খুব একটা স্থির ছিল না। অবিসংবাদিত সেরা রোমান্টিক হিরো হওয়ায় নায়িকাদের নিয়ে গুঞ্জনের শেষ ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। এই জুটির ১৯৫৪ সালের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার পোস্টার ঝড় তোলের দুজনেরই ব্যক্তিজীবনে। সেই পোস্টারে লেখা ছিল— ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা’। সেই প্রণয় পর্দার বাইরে বাস্তবেও মূর্ত ছিল— এমন বিশ্বাস করার মতো মানুষের অভাব ছিল না।
তবে উত্তম কুমার যার পর্দার সম্পর্ককে বাস্তবে টেনে এনেছিলেন, তিনি সুপ্রিয়া দেবী। তিনি ঘর বেঁধেছিলেন বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জির সঙ্গে। কিন্তু সংসার জীবনে সুখি ছিলেন না সুপ্রিয়া। ১৯৫৪ সালে বিশ্বজিতের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। এদিকে উত্তম কুমার একদিকে বিচ্ছেদ করতে পারছিলেন না গৌরীর সঙ্গে, অন্যদিকে ছাড়তে পারছিলেন না সুপ্রিয়া দেবীকেও।
এমন উভয় সংকটের মধ্যে গৌরী গাঙ্গুলির সঙ্গে বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিকতা না চুকিয়েই ১৯৬২ সালে সুপ্রিয়া দেবীতে বিয়ে করেন উত্তম কুমার। সামাজিক ও ধর্মীয় সব প্রথা অনুসরণ করলেও গৌরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ না হওয়ায় এ সম্পর্ককে রেজিস্ট্রি তথা কাগজে-কলমে বাঁধা যায়নি। এ নিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গে ঝড় বয়ে গেলেও তাতে কান দেননি উত্তম-সুপ্রিয়ার কেউই। তারা নিজেদের মতো করে সংসার করে গেছেন।
সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমার, শেষ জীবনে প্রায় ১৭ বছর সংসার করেছেন তারা।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মহানায়ক মাত্র ৫৩ বছর বয়সে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। একাধিকবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার উত্তম কুমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৮০ সালে ২৪ জুলাই। রেখে যান দুই স্ত্রী গৌরী গাঙ্গুলী ও সুপ্রিয়া দেবী, একপুত্র গৌতম, এক কন্যা সোমা ও একমাত্র নাতি গৌরবকে।
বেঁচে থাকলে আজকের জন্মদিনে ৯৯ বছর পার করে শতবর্ষে পা রাখতেন মহানায়ক উত্তম কুমার। তবে তিনি না থাকলেও রেখে গেছেন তার চলচ্চিত্রের ভাণ্ডার, যার একেকটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মণি-মুক্তার সমতুল্য। জন্মদিনে সেই মহানায়ককে জানাই অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনির্ভাসিটি; সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি ঢাকা
কলার মোঁচা, বা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় “banana peel”, আমাদের জীবনে অনেক সময়ই অবহেলিত একটি জিনিস। আমরা কলা খেয়ে মোঁচাটা সাধারণত ফেলে দিই। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কলার মোঁচায় রয়েছে চমকপ্রদ অনেক উপকারিতা, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি। এই মোঁচা শুধুমাত্র একটি বর্জ্য নয়, বরং এটি অনেক
৩ দিন আগেভাবুন তো, ঘরের কোণে রাখা টবে একগুচ্ছ গাছ, আর রাত নামতেই হালকা নীল, সবুজ, লাল কিংবা বেগুনি আলো ছড়িয়ে পুরো ঘরটাকে আলোকিত করে তুলল। বিদ্যুতের বাল্ব নয়, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক গাছের ভেতর থেকেই বের হচ্ছে সেই আলো। এমন স্বপ্নময় কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন চীনের একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা তৈরি করেছেন পৃথিবীর প্রথম ব
৩ দিন আগেমানুষের খাদ্যাভ্যাসে মধু আর রসুন দুটোই বহুকাল ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। দুটো উপাদান আলাদাভাবে যেমন ভেষজ গুণে ভরপুর, একসাথে খাওয়ার বিষয়টিও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছে। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেমন আয়ুর্বেদ বা ইউনানি চিকিৎসায় রসুনকে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক, তেমনি মধুকে ধরা হয় দেহশক্তি বৃ
৩ দিন আগেটিকটক এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ নিজের পছন্দের জিনিস আবিষ্কার করে, নতুন কমিউনিটি গড়ে তোলে এবং নিজের ভাবনা বা প্রতিভা প্রকাশ করে। আমাদের লক্ষ্য খুবই সহজ—মানুষকে সৃজনশীলতায় অনুপ্রাণিত করা এবং আনন্দ দেওয়া।
৩ দিন আগে