রহস্য

অ্যালি কেম্প হত্যাকাণ্ড : এক বাবার আর ফাউন্ডেশনের গল্প

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ০৪
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস অঙ্গরাজ্যের ছিমছাম সুন্দর শহর লিউড (Leawood)। শান্ত, নিরাপদ আর পরিবারিক আবহে ভরা এ শহরেই বসবাস করতেন কেম্প পরিবার। পরিবারের সবচেয়ে আদরের সদস্য ছিলেন ১৯ বছরের প্রাণবন্ত তরুণী অ্যালেক্সান্দ্রা ‘অ্যালি’ কেম্প। অ্যালি ছিলেন মেধাবী, হাসিখুশি এবং ভীষণ স্বপ্নবাজ। ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল তার। বিশেষ করে, অসহায় শিশুদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে চাইতেন তিনি। অ্যালির চোখে ছিল ভবিষ্যতের অসংখ্য রঙিন স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন এক নির্মম ঘটনায় চিরতরে থেমে যায় ২০০২ সালের এক গুমোট দিনে।

অ্যালি পড়ালেখার পাশাপাশি স্থানীয় এক সুইমিং পুলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেন। তার সঙ্গে ছোট ভাইও একই কাজ করত। বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে তিন-চার মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। ২০০২ সালের ১৮ জুনও প্রতিদিনের মতো কাজে গিয়েছিলেন অ্যালি। সেদিন আবহাওয়া ভালো ছিল না, তাই খুব বেশি লোক সাঁতার কাটতে আসেননি। ফলে কাজও কম ছিল। বেলা তিনটার দিকে অ্যালি তার বান্ধবী লরেলকে ফোন করে বলেছিলেন, একসাথে গল্প করে শিফটের বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে। আরেক বন্ধু ফিলকেও ফোন করেছিলেন তিনি, কিন্তু সে ধরতে পারেনি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লরেল পুলে চলে আসে। চারপাশ ছিল নিরিবিলি, শুধু একজন মানুষকে বের হয়ে যেতে দেখেছিল সে। লরেল টেরও পাননি যে চোখের সামনে দিয়েই অ্যালির খুনিকে চলে যেতে দেখছেন তিনি। বান্ধবীকে না পেয়ে ধরে নিয়েছিলেন, হয়তো অ্যালি হঠাৎ জরুরি কোনো কাজে বাইরে গেছেন। তাই আর খোঁজ না নিয়ে বাড়ি ফিরে যান লরেল।

অন্যদিকে, কিছুক্ষণ পর শিফটে আসেন অ্যালির ছোট ভাই। তিনি দেখেন, টেবিলে বোনের ব্যাগ আর ফোন রাখা আছে, কিন্তু অ্যালি নেই। মা-বাবাকে জানালে বাবা রজার কেম্প তড়িঘড়ি করে চলে আসেন। একসাথে তারা অ্যালিকে খুঁজতে থাকেন। প্রথমে রজার ভেবেছিলেন হয়তো দুর্ঘটনাক্রমে পুলে পড়ে গেছে মেয়েটি। কিন্তু পাম্প ঘরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলেন, তা কোনো বাবার সহ্য করার মতো নয়—নীল তারপুলিনের নিচে পড়ে আছে অ্যালির ক্ষতবিক্ষত দেহ।

এমন ঘটনা লিউড শহরের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। পুলিশ দ্রুত তদন্ত শুরু করে। জায়গাটি ঘেঁটে দেখা যায়, সেখানে প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি হয়েছিল। অর্থাৎ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার জন্য লড়েছিলেন অ্যালি। পুলিশ জানতে পারে, হত্যার পরপরই সেখানকার পার্কিং থেকে উধাও হয়ে যায় একটি ফোর্ড পিকআপ ট্রাক। লরেল যে লোকটিকে দেখেছিলেন, তার বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজনের একটি ছবি আঁকা হয়।

অ্যালির পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে চারদিকে ছড়িয়ে দেন সেই ছবি। রজার টেলিভিশনেও প্রচারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি হয় না। এরপর অ্যালির বাবা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন—যে তথ্য হত্যাকারী ধরতে সাহায্য করবে, তাকে দেওয়া হবে পুরস্কার। প্রথমে ১,০০০ ডলার ঘোষণা করা হলেও পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০,০০০ ডলারে।

এক পর্যায়ে জেমস স্ট্রেইটার নামে একজনের দিকে সন্দেহ যায়, কারণ ছবির সঙ্গে তার মিল ছিল। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষায় সে নির্দোষ প্রমাণিত হয়।

হতাশ রজার কেম্প একদিন গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার পাশে একটি বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দেখতে পান। তখনই তার মাথায় আসে নতুন পরিকল্পনা—সন্দেহভাজনের ছবি যদি বিলবোর্ডে দেওয়া যায়, তাহলে প্রতিদিন হাজারো মানুষ সেটা দেখবে, আর কেউ না কেউ হয়তো চিনে ফেলবে লোকটিকে।

বিলবোর্ড কোম্পানি লামার অ্যাডভার্টাইজিং কেম্প পরিবারকে বিনামূল্যে সাহায্য করে। ফলাফল এলো হাতেনাতে। অচেনা এক ব্যক্তি ফোন করে জানালেন—ছবির লোকটি টেডি হুভার নামে একজন। জানা গেল, সে-ও সুইমিং পুলে কাজ করত এবং অ্যালির সাথেই দায়িত্বে ছিল। কিন্তু হত্যার দিন পুলিশ তার সঙ্গে কথা বললেও আচরণে তেমন কিছু সন্দেহজনক মনে হয়নি বলে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

পরে তার ডিএনএ চাইলে উকিলের পরামর্শে পালিয়ে যায় হুভার। প্রায় এক বছর সে পলাতক ছিল। পরে পুলিশ জানতে পারে, সে কানেকটিকাটে বান্ধবীর সঙ্গে নতুন নাম বেনজামিন অ্যাপলবি পরিচয়ে বসবাস করছে। শেষমেশ ধরা পড়ে যায় সে।

পুলিশি জেরায় হুভার স্বীকার করে অ্যালিকে হত্যার কথা। তার ভাষ্যমতে, অ্যালির প্রতি আকৃষ্ট ছিল সে। সেদিন অযাচিত প্রস্তাব দিলে অ্যালি তা প্রত্যাখ্যান করে। হুভার তখন তাকে অনুসরণ করে পাম্প ঘরে যায়। নানা উত্যক্তের পর পরিস্থিতি ধস্তাধস্তিতে গড়ায়। রাগের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে অ্যালিকে, অচেতন অবস্থায় তাকে তারপুলিন দিয়ে ঢেকে রেখে পালায়। সেই সময়ই লরেল তাকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে দেখেছিল।

অবশেষে আদালতে হুভারকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগও যুক্ত হয়। দীর্ঘ শুনানির পর বিচারক তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫০ বছরের সাজা দেন। অর্থাৎ, এই সময়ের আগে সে মুক্তির আবেদন করতে পারবে না। আপিল করলেও তা খারিজ হয়ে যায়।

অ্যালিকে হারানোর পর কেম্প পরিবার শোকে ভেঙে পড়লেও তারা সিদ্ধান্ত নেন—এই মৃত্যু যেন বৃথা না যায়। তাই গড়ে তোলেন অ্যালি কেম্প ফাউন্ডেশন। এর অন্যতম কাজ হলো তরুণীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো, যাতে তারা বিপদের মুখে অন্তত লড়াই করতে পারে। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নারী এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—যে ব্যক্তি হত্যাকারীর ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলেন, তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। আর পুরস্কারের পুরো টাকাটাই দিয়ে দিয়েছিলেন ফাউন্ডেশনের কাজে।

অ্যালি কেম্পের গল্প শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের নয়, বরং এক বাবার দৃঢ়তার প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছেন—ন্যায়বিচারের জন্য হাল ছাড়া যায় না। একই সঙ্গে তার গড়ে তোলা ফাউন্ডেশন আজও তরুণীদের আত্মরক্ষা শেখাচ্ছে। অ্যালির স্বপ্ন হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু তার স্মৃতি হয়ে উঠেছে হাজারো মেয়ের বেঁচে থাকার প্রেরণা।

ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

বিয়ে ও বাবা হওয়ার খবর জানালেন জেমস

গত ৮ জুন নিউইয়র্কের হান্টিংটন হাসপাতালে ভোর সাড়ে তিনটায় জন্ম হয় জিবরান আনামের। জেমসসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যও তখন উপস্থিত ছিলেন।

১২ দিন আগে

জেনে নিন সেন্টমার্টিন ভ্রমণের এক ডজন নিয়মকানুন

নভেম্বর মাসে শুধু দিনে ভ্রমণ, রাত যাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে সীমিত রাত যাপন।

১২ দিন আগে

চোখে ইমপ্লান্ট প্রতিস্থাপনে দেখতে পাচ্ছেন দৃষ্টিহীনেরা

সত্তর বছর বয়সী দৃষ্টিহীন রোগী শিলা আরভিন, এই প্রযুক্তির সাহায্যে আবার বই পড়তে এবং ক্রসওয়ার্ড মেলাতে পারছেন। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এটিকে ‘অভূতপূর্ব’ এক অভিজ্ঞতা বলে বর্ণনা করেন।

১৩ দিন আগে

সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করার নির্দেশ

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান ঢালিউড তারকা সালমান শাহ। তার মৃত্যুকে প্রথমে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করেন সাবেক স্ত্রী সামিরা হক, যা শুরু থেকেই মেনে নেয়নি অভিনেতার পরিবার। পরের বছর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন।

১৪ দিন আগে