আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হবে কবে?

এইচ এম মশিউর রহমান
এইচ এম মশিউর রহমান

ঢাকার কেরানীগঞ্জে গত বৃহস্পতিবার ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা কয়েক ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় রেখেছিল মানুষকে। বিনা রক্তপাতে ব্যাংকটিতে জিম্মি ঘটনার অবসান হয়। এ ঘটনায় মানুষ স্বস্তি পেলেও দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ভয়-আতঙ্ক কাটছে না।

একের পর এক খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির ঘটনা মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চিত্র তা আমাদের সবার মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আতঙ্কে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে কেউ কেউ।

সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি দোকানে অস্ত্রধারীরা ঢুকে ডাকাতি করে, এক তরুণীকে চাপাতি হাতে দৌড়ানোর ঘটনাসহ একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসীর বিক্ষোভের পর সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে আটক করা হয়। মাঝেমধ্যে অভিযান চলছে।

৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার অপরাধ-প্রবণ শরণার্থী শিবির “জেনেভা ক্যাম্প” ভিত্তিক অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে চলা সহিংসতা মারাত্নক রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন চলছে গোলাগুলি, হানাহানি, সহিংসতা এমনকি প্রাণহানি। প্রতিপক্ষের হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে সাতজনের প্রাণাহানি ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নামে যারা মোহাম্মদপুর এলাকায় মাদক ব্যবসাসহ অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতো তারা পালিয়ে গেলে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সেই শূন্যতা পূরণ করতে চার সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘাত, সহিংসতা হয়েছে।

ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকার অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম এবং প্রকাশ্যে চাপাতি রামদা নিয়ে আক্রমণ কিংবা দৌড়াদৌড়ির মতো বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বেশি আলোচিত ঘটনার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় হচ্ছে আরেকটি ঘটনা আসার পর সেগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন বা মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছে- এমন দৃশ্য আঁতকে ওঠার মতো।

সাম্প্রতিক এই দুটি ঘটনাই মোহাম্মদপুর এলাকার। ওই এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খলিল বলছেন, ৫ আগস্টের পর কয়েকদিন ছিলো ডাকাতির আতঙ্ক। আর এখন কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধভাবে কিশোর তরুণরা ঘোরাঘুরি করছে, একে ওকে হামলা করছে এবং ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না।

ফয়েজুর মোল্যার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর এলাকায়। তেলের পাম্পে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালান ফয়েজুর, পাশাপাশি গরু পালন করেন। সকালে দেখেন খামারে একটা গরুও নাই। তিনি বলেন, ‘ঋণের টাকায় গরু কিনে পাইলে-পুইষে বড় বানালাম। চোরেরা গরুগুলো নিয়ে আমারে পথে বসায় দিয়ে গেল। পাম্পের গাড়ি চালাইয়ে যা আয় করতাম, তা দিয়ে খাইয়ে-পইরে বাকি সব খরচ করতাম ওই গরুর পিছনে। চার বছর ধরে কষ্ট করে বানানো খামারডা ধ্বংস করে দেল। আমারে একেবারর পঙ্গু কইরে দিয়ে গেল।’

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের চর এলাকায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।

নীলফামারীর সৈয়দপুরে ক্ষুদ্রঋণের ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হতেই ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক ব্যক্তি।

ফরিদপুর শহরের ব্রাক্ষ্মণকান্দা এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে কনস্টেবলসহ দুজনকে পিটুনি দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা ছিনতাই করতে রিফাত মিয়া নামের অটোরিকশা চালককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশি ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে চলছে। সারাদেশে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো মারাত্মক অপরাধ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অপরাধের বিবরণ ও ধরণ এমন যে কোনো সুস্থ্য এবং বিবেকবান মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। গা শিউরে ওঠা একেকটি ঘটনা মানুষের মনোজগতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

প্রায় প্রতিদিনই হত্যা, খুন, দুর্ঘটনা, মারামারিসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির খবর আসছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বেড়েছে চাঁদাবাজি ও ছিনতাই। একশ্রেণির মানুষের বর্বরতা ও নৃশংসতা মধ্যযুগকেও হার মানাচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব ঘটনার গ্রাফ ক্রমেই উর্ধ্বমুখী। অনেক ক্ষেত্রে আইন তার যথার্থ কার্যকারিতা হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। সবার মনে এক অদৃশ্য আতঙ্ক।

আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি দ্রুত মানুষের মনের এই আতঙ্ক দূর করতে সক্ষম না হয়ে উঠতে পারে তাহলে মানুষ ধীরে ধীরে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়তে পারে। যার ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য সকল সেক্টরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারণে এই মুহুর্তে সকলে মিলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার। সমাজের বিশিষ্টজনদের সাথে নিয়মিত বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা করে দিক নির্দেশনা দেয়া উচিত।

সংশ্লিষ্ট থানা এলাকায় কারা কোন অপরাধের সাথে জড়িত তার তালিকা নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। এ তালিকা ধরে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।

আমরা জানি, পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় নয়, যা সরকার বা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কথায় বারবার এসেছে। নতুন পুলিশ প্রধান পুলিশ সদস্যদের সক্রিয় করতে নানা পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট এর আগে পুলিশ ও ছাত্র-জনতা যেভাবে মুখোমুখি হয়েছে, সেই পরিস্থিতির অবসান এখনো হয়নি, মানসিক দূরত্ব এখনও ঘুচেনি।

অপরাধী যেই হোক, তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ অটুট রাখতে এবং অবক্ষয় ঠেকাতে এলাকার অভিভাবকদের সক্রিয় হওয়া বাঞ্চনীয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আচার-আচরণের দিকে অভিভাবকদের যথাযথ দৃষ্টি রাখতে হবে। তবেই আমরা এই মুহূর্তের এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবো বলে আশা রাখি।

এইচ এম  মশিউর রহমান: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে