স ম গোলাম কিবরিয়া
কয়েক বছর ধরে তিনি দলের নেতাদের সতর্ক করে বলছেন, সহসই বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও বক্তব্য রাখছেন। যুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছেন। বলছেন, স্বাধীনতার জন্য এটাই সঠিক সময়। কিন্তু দলের নেতারা এ নিয়ে কোনো কথা বলছেন না, কথা বলছেন না সহযোদ্ধারাও। হয়তো যুদ্ধ নিয়ে তাঁরা কোনো খোঁজ-খবর রাখছেন না। তাঁদের ধারণা নেই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে। যুদ্ধ বাঁধলে তার মধ্যে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি- এ বিষয়েও নেতারা একমত নন। যুদ্ধের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার বিষয়ে শীর্ষ নেতারা তীব্র বিরোধী। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন, স্বাধীনতা ভিক্ষে করে পাওয়ার বিষয় নয়, এটা অর্জন করতে হয়। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হয়, লড়াই করতে হয়, রক্ত দিতে হয়, জীবন দিতে হয়। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব।’
হ্যাঁ, সুভাষ চন্দ্র বসুর কথাই বলছি। যিনি নেতাজী নামে সমাধিক পরিচিত। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭। উড়িষ্যার কটক তার জন্মস্থান। বাবা ছিলেন আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবী। পারিবারিক চাপে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ হন সুভাষ। কিন্তু যোগদান করেননি। ভাইয়ের কাছে দীক্ষা পান রাজনীতির, জড়িয়ে যান রাজনীতিতে। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান না হয়েও তিনি উপমহাদেশে অতি পরিচিত একটি নাম। তাঁর মতো আলোচিত নেতা উপমহাদেশে দ্বিতীয় কেউ নেই। যুদ্ধকালে যেমন আলোচিত ছিলেন, যুদ্ধের পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন মিত্রশক্তির অন্যতম চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ব্রিটিশরা তাঁকে সবসময় তীক্ষ্ম নজরদারিতে রেখেছে। তাই অজ্ঞাত কারণে যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় তাঁর স্থান। বিশ্বযুদ্ধের পর ৭৬বছর জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধী তালিকায় তাঁর নাম ছিলো। স্বাভাবিকভাবেও এতদিন একজন মানুষের বাঁচার কথা নয়। তবুও তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, তাঁকে যেখানে, যে অবস্থায় পাওয়া যাবে, জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এই সময়ে তাঁর কোনো লেখা বা গোপন দলিল ভারত সরকার বা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নেতাজির প্রথম মেয়াদ ছিলো ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু বলা তো যায় না, যদি তিনি বেঁচে থাকেন! তাই মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সাল নির্ধারণ করে জাতিসংঘ।
বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যু নিয়ে যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে অনেক তদন্ত হয়েছে। একাধিক কমিশন গঠন কিয়া হয়েছে, তদন্তের জন্য। কিন্তু কোনো কূলকিনারা করা যায়নি। মৃত্যুঘটনা আরো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। আগেও তিনি ব্রিটিশদের রহস্যের মধ্যে ফেলেছেন। কখন, কিভাবে শতাধিক গোয়েন্দার চোখ ফাঁকি দিয়ে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বের হলেন। যেখানে তাঁকে খারার দিতো গোয়েন্দারা! কীভাবে, কোন পথে, কী উপায়ে কলকাতা থেকে পাড়ি জমালেন জার্মানিতে! এটাও ব্রিটিশ-ভারতের সরকারের কাছে রহস্য! তারা জানতেন সুভাষ এলগিন রোডের বাড়িতেই আছে। কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন জার্মানিতে থেকে ইথারে ভেসে এলো- "আমি সুভাষ বলছি..."! যে ব্যক্তি এতো দুঃসাধ্য সাধন করতে পারে, সে হয়তো বিমান দুর্ঘটনার মাঝেও কোনো উপায়ে বেঁচে যেতে পারে। তাই হয়তো ব্রিটিশ- আমেরিকা মনে করছে সুভাষ হয়তো বেচেঁ আছেন।
সত্যি কি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ মারা যায়নি? দুর্ঘটনা থেকে কিভাবে রক্ষা পেলেন? সত্যি কি তিনি এখনও বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে তিনি কোথায় আছেন? তার প্রিয় জন্মভুমি ভারতে? নাকি মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন? নাকি আবারো জার্মানিতে? জার্মানিতে তো এখন নাজি বাহিনী নেই, কিভাবে সেখানে থাকবেন? সবার চোখে ধুলো দিয়ে ব্যাংকক ছাড়লেন কিভাবে? বেঁচে থাকলে সেখান থেকে কোথায় গেলেন? বিমান দুর্ঘটনার রহস্য কী? এমন হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু কোনো সদুত্তর নেই, উত্তর নেই মিত্রশক্তির কাছে, উত্তর নেই জাতিসংঘের কাছে। মৃত্যু নিয়ে অকাট্য প্রমাণও নেই। যদিও জাপান বিমান দুর্ঘটনার বিষয়ে নানা কথা বলছে, নানা প্রমাণ তুলে ধরছে। কিন্তু তাতে আস্থা রাখতে পারছে না কেউ। এমন কি সুভাষের আত্মীয়রাও নন।
জাতিসংঘের তালিকায় নেতাজি যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু কেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য কি সুভাষ দায়ী? তিনি কি কোনো দেশ দখল করেছিলেন? কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন? তিনি কোনো গণহত্যা করেছিলেন? কোনো দেশে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন? এসবের কোনোটাই সুভাষ করেননি। তিনি মাতৃভুমির স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করিলেন। কারণ, ব্রিটিশরা কথা রাখে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তারা স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলো। কথা রাখেনি। সুভাষ জানতেন আবারো একই কাজ করবে ব্রিটিশরা। যতই বলুক, এবারেও স্বাধীনতা দেবে না। যুদ্ধের পর সে প্রমাণ রেখেছে ব্রিটিশরা। তাই সুভাষ যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। এটাই তাঁর দোষ। তিনি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনতে চেয়েছিলেন। তাই সুভাষ আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করে বলেছিলেন, আপনারা রক্ত দিন, আমি স্বাধীনতা দিবো। এই রক্ত দিতেই তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ব্রিটিশদের যুদ্ধে নেমেছিলেন। নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা কী অপরাধ?
সুভাষ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেবে না। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে লাগাতার। এ নিয়ে কংগ্রেসের অনেক শীর্ষ নেতাদের সাথে মতদ্বৈতা ছিলো আগাগোড়াই। হরিপুরা কংগ্রেসে ১৯৩৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি সুভাষ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। সম্মেলনে তিনি ইউরোপে যুদ্ধের ঘনঘটা, শিল্পোন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, বুনিয়াদি শিক্ষা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে বক্তৃতা করেন। পরবর্তী সম্মেলনে তিনি পুনরায় সভাপতি পদের প্রার্থী হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী তা সমর্থন করেছিলেন না। ১৯৩৯ সালে গান্ধীজির প্রচণ্ড আপত্তির মুখেও নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ। গান্ধীজির সাথে চ্যালেঞ্জ দিয়েই তিনি আবারও কংগ্রেস সভাপতি হন। তাই দলের ভেতরে পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হন তিনি। তবুও থেমে যাওয়ার পত্র নন নেতাজি। অবশেষে কংগ্রেস থেকে বহিস্কার করা হয় সুভাষকে।
সুভাষ যে আদর্শ লালন করতেন, যে আদর্শ বিশ্বাস করতেন, সেই আদর্শের দল গঠনের অনেকটা প্রস্তুতি ছিলো আগে থেকেই। সেই প্রস্তুতির চূড়ান্ত মহড়া হয় ১৯২৮ সালে। এ বছর কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের শৃংখলা রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পান সুভাষ। এ জন্য তিনি গঠন করেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স। বাঙালিরাও যে সুসজ্জিত বাহিনী গড়ে তুলতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেখালেন সুভাষ। যদিও এই বাহিনী ও সার্বিক শৃংখলা দেখে গান্ধীজি বিরূপ মন্তব্য করে বলেছিলেন, পার্কসার্কাসে নতুন সার্কাস দেখালো সুভাষ। কংগ্রেস ছেড়ে আসার পর সেই ভলেন্টিয়ার্সদের দিয়েই সুভাষ গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল- ফরোয়ার্ড ব্লক। #
যুদ্ধ বেঁধে গেছে ইউরোপজুড়ে। এটাই ব্রিটিশদের হটানোর মোক্ষম সুযোগ। কিন্তু ব্রিটিশ হটানোর আন্দোলন-সংগ্রাম কোথায়? কংগ্রেস নেতারা চুপশে গেছেন, কিংকর্তব্যবিমুড়! কী করতে হবে এ সময়, যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না তাঁরা। এমন পরিস্থিতিতে দর্শক হয়ে বসে থাকার মানুষ নন সুভাষ। যুদ্ধ শুরু হলে কী করতে হবে, আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিলো তাঁর। একবার যা চিন্তা করনে, তা থেকে সুভাষকে সরানো কঠিন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করবেন তিনি? তিনি যে ভারতের আর সব নেতাদের মত মুক্ত স্বাধীন নন। ব্রিটিশরা এটা ভালো করেই জানে। তাই গৃহবন্দি তিনি। শতাধিক গোয়েন্দার নজরদারিতে সুভাষ। তাঁর বাড়ির ভেতরেও পাহারা বসানো হয়েছে। এমনকি সুভাষকে খাবার পরিবেশন করে গোয়েন্দা। এমন অবস্থায় নতুন করে চিন্তা করতে হয় সুভাষকে।
বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে যেকোন মূল্যে স্বাধীনতা চাই। সময় ক্ষেপনের কোন সুযোগ নেই। সুভাষ বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এজন্য চাই আধুনিক অস্ত্রসম্ভার, চাই সুদক্ষ সেনাবাহিনী। ব্রিটিশ-ভারতে বসে তা কীভাবে সম্ভব? তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জার্মানীতে যাবেন। সেখানে গিয়ে হিটলারের সাথে কথা বলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। যুদ্ধে ব্রিটিশরা জার্মানির শত্রু। স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটিশরা আমাদেরও শত্রু। শত্রুর শত্রু মিত্র- এটি সাধারণ সূত্র। কিন্তু জার্মানিতে যাওয়া তো সহজ কথা নয়। কথাটি তিনি জানালেন তার ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা সর্দার নিরঞ্জন সিং তালিবকে। জানালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। দেশ থেকে বের হওয়ার জন্য নিরঞ্জন সিংয়ের সহযোগিতাও চাইলেন। সর্দারজি ভাল করেই জানেন সুভাষ যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন রুখনেওয়ালা নেই। ঠিক হলো পেশোয়ার থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে কাবুল হয়ে দেশের বাইরে যাবেন সুভাষ।
১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারি। রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। কোলকাতার এলগিন রোড নিস্তব্দ, নিস্তব্দ ৩৮-২ নম্বর বাড়ি। রোডের আলো নেই, জনমানব নেই। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন সুভাষ। এবার বেড়িয়ে পড়তে হবে। সুভাষ এখন পাঠান যুবক বেশে। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বের হলেন। বসলেন ওয়ান্ডার বিএলএ ৭১৬৯ গাড়িতে। গাড়ির চালক ভাইপো ড. শিশির কুমার বসু। বাড়ি থেকে বিদ্যুত গতিতে ট্রাঙ্ক রোড ধরে এগিয়ে চলছে। আসানসোল হয়ে ধানবাদের কাছাকাছি এক বাংলো বাড়িতে গাড়িটি থামলো। বাড়িটির বাইরের এক ঘরে তার যাত্রা বিরতি। পাঠানবেশি সুভাষকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি চলে গেলো। ভাবখানা যেন ভাড়া করা গাড়িতে এসেছেন পাঠান সাহেব। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। সেখান থেকে গোমে স্টেশন। বাংলো বাড়িটি সুভাষের আরেক ভাইপো আশোক বসুর। গোমে স্টেশন থেকে পেশোয়ার। তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ হয়ে কাবুল যেতে হবে। এই বাসাতেও গোয়েন্দা নজরদারি! তাই আপন ভাইপোর স্ত্রীকেও বুঝতে দেননি যে, তিনি সুভাষ! গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুভাষ পৌঁছে যান সীমান্ত প্রদেশ। সেখান থেকে দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দিয়ে পরিকল্পনা মতো কবুল পৌঁছে যান। কবুলের ইটালি দূতাবাস থেকে কৌশলে ইতালির নাগরিকের পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। যুদ্ধে জার্মানি আর ইতালি বন্ধু। ইতালি নাগরিকের পরিচয়পত্রে নেতাজি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রবেশ করেন। তখনও জার্মানীরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেনি, বরং দুই দেশের মধ্যে রয়েছে অনাক্রমণ চুক্তি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নেতাজি পৌঁছে যান জার্মানিতে।
জার্মানিতে গিয়ে সুভাষ তার পরিকল্পনার কথা নাজি নেতাদের জানালেন। তারপর হিটলারের সাথে দেখা। হিটলারের সাথে আলোচনা করে গড়ে তোলেন "আজাদ হিন্দ ফৌজ"। অনেক ভারতীয় ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ইউরোপ ও আফ্রিকায় যুদ্ধে পরাজিত অনেকেই জার্মানিতে আটক রয়েছে। পরাজিত বন্দি ভারতীয়দের নিয়ে সুভাষ গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। এই যোদ্ধাদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারত স্বাধীন করতে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এই বাহিনী নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করবেন। এখানেই তিনি গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ রেডিও, বার্লিন। আজাদ হিন্দ রেডিও থেকেই একদিন ইথারে ভেসে এলো, , ‘আমি সুভাষ বলছি…’। চমকে উঠে ব্রিটিশ সরকার। কীভাবে সম্ভব এটা। ৬২ জন গোয়েন্দার সদাসতর্ক চোখ সুভাষের ওপর। সবার চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষ জার্মানিতে!!
স্বাধীনচেতা সুভাষ কখনই কোন শক্তির প্রতি নির্লজ্জ সমর্থন বা দায়বদ্ধ হননি। মিউনিখে অবস্থানকালে নাৎসিবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় সুভাষকে সংবর্ধনা দেবে। কিন্তু তার আগের দিন হিটলার বেতার ভাষণে ভারতে বৃটিশ শাসনের সুখ্যাতি করে। এ পরিস্থিতিতে কী সুভাষ সংবর্ধনা নিতে পারে? কোন দ্বিধা না করেই সুভাষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাতিল করে দেন। একই সাথে তিনি ঘোষণা করেন, Hitler is a liberty to lick British boot. সুভাষের মুখে একথা শুনে ইউরোপ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আশ্চর্য! হিটলার এই দুঃসাহসী বক্তব্যের জন্য হিটলার কিন্তু সুভাষের প্রতি ক্ষিপ্ত হননি। বরং সুভাষকে সম্মান দেখিয়ে ভুল স্বীকার করে পরদিন হিটলার তার বেতার ভাষণ প্রত্যাহার করেন। জার্মানীতে সুভাষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্যক অবহিত হন ভারতের স্বাধীনতার আরেক নেতা রাস বিহারী বসু। স্বাধীনতার জন্য তিনি দেশ ছাড়া। রাশ বিহারী বসু তখন জাপানে। ব্রিটিশদের তালিকায় তিনিও শত্রু। বয়সের ভারে তিনি ক্লান্ত, তাই বলে ভারতের স্বাধীনতার জন্য তার জীবনী শক্তি তখনও উন্মত্ত। তিনি মনে করলেন, সুভাষ তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন। জার্মানীতে খবর পাঠালেন সুভাষকে সিঙ্গাপুরে আসার জন্য। জানালেন সুভাষ এসে তার ন্যাশনাল লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করুক।
কিন্তু কিভাবে সিঙ্গাপুর যাবেন সুভাষ? যুদ্ধ মারাত্মক পরিস্থিতি ধারণ করেছে। সুদূর জার্মানি থেকে বিমানে সিঙ্গাপুর যাওয়া কোনোভাবেই নিরাপদ হবে না। সমুদ্রপথে ব্রিটিশ জাহাজের উপস্থিতি রয়েছে। জাহাজে যাওয়াটাও বিপদসংকুল! ২২ শে জুন ১৯৪১। হঠাৎ করেই হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণ সুভাষকেও চিন্তায় ফেলে দিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশের ছক আর থাকলো না। উপায় কী? সুভাষ ভাবলেন সিঙ্গাপুর থেকে সহজেই ভারতে প্রবেশ করা যাবে। তাই যেকোনো উপায়ে সিঙ্গাপুর যেতে পারলে বিষয়টি সহজ হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন, যেকোনো উপায়ে সিঙ্গাপুর যেতেই হবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো সাবমেরিনে করে সুভাষকে সিঙ্গাপুর পৌঁছে দেবে জার্মান সরকার।
সাবমেরিনে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কি নিরাপদ হবে? ইংলিশ চ্যানেল, উত্তর সাগর, ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর- সব খানেই মিত্রবাহিনীর উপস্থিতি। পথে টর্পেডো, মাইন বা ভারী কামানের আওতায় পড়তে হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও অন্য পথের চেয়ে সাবমেরিন যাত্রায় বিপদ কিছুটা কম। যাত্রাপথের প্রথমাংশ বেশি বিপদসঙ্কুল। ঠিক হলো পথের এ অংশের দায়িত্ব নেবে জার্মান সরকার। তারা নেতাজিকে মাদাগাস্কারের কাছাকাছি একটি স্থানে পৌঁছে দেবে। বাকি অংশের দায়িত্ব জাপান সরকারের।
যাত্রা শুরুর আগে সুভাষের কয়েকটি বক্তৃতা রেকর্ড করা হলো। বার্লিন ত্যাগের পর রেকর্ডগুলো আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে প্রচার করা হবে। ব্রিটিশ-মার্কিন শক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ পরিকল্পনা করা হলো। তারা যাতে মনে করে যে, নেতাজি জার্মানিতেই আছেন। সাবমেরিনে সুভাষের একজন সঙ্গী, তিনি হলেন আবিদ হাসান। হায়দ্রাবাদের এই তরুণ ছাত্র বার্লিনে অধ্যয়নরত এবং সুভাষের একান্ত সচিব। U-180 সাবমেরিনটি সুভাষের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। চরম বিপর্যয়ের মুখে জার্মানির পক্ষে ভিন্ন দেশের এক রাষ্ট্রনায়কের জন্য সাবমেরিনের ব্যবস্থা করা সত্যিই অভাবনীয়। নেতাজিকে সেই অভাবনীয় সম্মান দিলেন জার্মানি।
৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। জার্মানির ‘কিল’ নৌ বন্দর থেকে সুভাষ বোসকে নিয়ে সাবমেরিন যাত্রা শুরু করে। ডিজেল ইঞ্জিনের পুরানা ধরনের সাবমেরিনটি সমুদ্রগভীরে একটানা আটচল্লিশ ঘন্টার বেশি চলতে পারে না। তারপর ব্যাটারিতে চার্জ দেয়ার জন্যে মাঝে মাঝেই জলের উপরে উঠতে হয়। জলের উপর ভেসে ওঠা সবচেয়ে বিপজ্জনক। যেকোনো মুহূর্তে শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই।
উপরে উত্তাল সমুদ্র। অবিরাম ঢেউ গড়ছে আর ভাঙছে। নীচে চলমান সাবমেরিন সুভাষকে নিয়ে এগিয়ে চলছে মন্থর গতিতে। ভাসমান অবস্থায় এর গতি ঘন্টায় বিশ নটিক্যাল মাইল। জলের নীচে ঠিক তার অর্ধেক। মাঝে মাঝে আরও কম। যাত্রাপথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সুভাষ ভাবছেন বিপদসঙ্কুল এই পথ বোধ হয় শেষ হবে না। এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে তাঁর ‘প্রিয় মেজদাদা’ শরৎচন্দ্র বোসকে চিঠি লিখলেন। তাঁর চিন্তা জার্মানি হঠাৎ রাশিয়া আক্রমণ করায় যুদ্ধ নানাদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই অবস্থায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ হানার উপযুক্ত জায়গা হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। তাই সেখানে তাঁকে পৌঁছাতেই হবে।
চারপাশে শত্রুপক্ষের বেড়াজাল। যুদ্ধজাহাজ, ডেস্ট্রয়ার, ক্রুজার বিমান বহর, ডেপথচার্জ, টর্পেডো সবকিছু যেন বসে আছে হিংস্র হায়েনার মতো। একটু টের পেলে আর রক্ষা নেই। তাই যেতে হবে খুব সন্তর্পনে। সবচেয়ে মারাত্মক হলো ডুবন্ত মাইনগুলো। হাজার, হাজার শক্তিশালী ডুবন্ত মাইন পোতা আছে উপকূল ঘিরে। কোনো একটার সাথে সামান্য সংঘর্ষ হলেই মৃত্যু অনিবার্য।
ঘুম নেই, সদা সতর্ক সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন মুসেমবার্গ। সারা চোখে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি। যেভাবেই হোক সুভাষ বোসকে পৌঁছে দিতে হবে তার কাঙ্খিত গন্তব্যে। দিনের পর দিন চলে যায়। সাবমেরিনের চলার বিরাম নেই। এদিকে কেবিনে সুভাষ তার আগামী দিনের সংগ্রামের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে এই লড়াই চালিযে যেতে হবে।
ছোট্ট কেবিন। সোজা হয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই। দু’পা হেঁটে চলার মতো জায়গা নেই। সেদিকে নেতাজির কোনো নজর নেই। দেহের ওজন প্রায় ১৬ পাউন্ড কমে গেছে। মুখ দাড়িতে ঢাকা। গায়ে জার্মান নৌবিভাগের পোশাক। মুখে নির্ভুল জার্মান ভাষা। সুভাষের এই ছদ্মবেশের আড়াল থেকে আসল মানুষকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। চারদিকে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর কড়া নজরদারি। যেকোনো মুহূর্তে সাবমেরিনটি শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সুভাষের এ সতর্কতা। এখানে তিনি সাবমেরিনের এক জার্মান অফিসার মাত্র।
নেতাজি তিন-চার ঘন্টার বেশি ঘুমান না। বাকি সময়টায় শুধু কাজ আর কাজ। নানা ধরনের পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরিতে তিনি ব্যস্ত। সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে বিভিন্ন বক্তৃতার খসড়া প্রস্তুত করা, নারীবাহিনী গঠনের ভাবনা, জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার নীতি স্থির করা, তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’-এর সংশোধন ইত্যাদি তার নিয়মিত কাজ। সেক্রেটারি আবিদ হাসান নোট নিচ্ছেন। পরে তা টাইপ করে সংরক্ষণ করছেন। সিঙ্গাপুর আর মালয়ে দেওয়া সুভাষের সারা জাগানো বক্তৃতার খসড়া সাবমেরিনে বসে তৈরি করা হয়।
ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চ। সাবমেরিন এগিয়ে চলছে একইভাবে। নেতাজি ব্যস্ত তার পরিকল্পনা সাজাতে। মেয়েদের নিয়ে তিনি একটি বাহিনী করতে চান। এ বাহিনীর নাম হবে ঝাঁসির রানী বাহিনী। এ সংগ্রামে মেয়েদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। লক্ষ্ণীবাঈ, মতিবাঈয়ের মতো কতো মহিয়সী নারীর জন্ম হয়েছে এই ভারতবর্ষে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জন্য এ বীরাঙ্গনারা নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছেন। তাই আজাদ হিন্দ ফৌজে অবশ্যই মহিলাদের ইউনিট খোলা হবে- সিদ্ধান্ত নিলেন সুভাষ। আবিদ হাসান নোট লিখে চলেছেন নিজের মনে।
হঠাৎ মাইক্রোফোনে কমান্ডারের উত্তেজিত কন্ঠস্বর, সাবমেরিন শত্রুর জালে আটকা পড়েছে। সবার মধ্যে উৎকন্ঠা, ব্যতিক্রম নেতাজি। কিছুক্ষণ চারপাশে চোখ বুলিয়ে তিনি আবার কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন। কিন্তু আবিদ হাসানের মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বয়ে চলেছে। শত্রুর জালে আটকা পড়লে হয় মৃত্যু, নয়তো বন্দী জীবন। কিন্তু সুভাষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি আবিদ হাসানকে কিছু নোট নিতে বললেন। কিন্তু আশু বিপদের চিন্তায় আবিদ অন্যমনস্ক। নেতাজি ধমকে উঠলেন, “আমি দু দুবার বললাম, এখনও কি না নোট নিলে না।” সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন আবিদ হাসান।
আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। কমান্ডার নির্দেশ দিলেন, “চার্জ টর্পেডো“। কিন্তু কন্ট্রোল রুমের মারাত্মক ভুলে টর্পেডো চার্জের পরিবর্তে সাবমেরিনটাই পানির উপর ভেসে উঠলো। বিপক্ষের যুদ্ধজাহাজটা গতি পরিবর্তন করে সাবমেরিনটা লক্ষ্য করে ঝড়ের মতো ছুটে আসছে। গোটা সাবমেরিনটা বন্দী করা তাদের লক্ষ্য। বিপদ দেখে কমান্ডার উত্তেজিতভাবে নির্দেশ দিলেন, “ডাইভ, ডাইভ!” ফাইটার জাহাজটি সাবমেরিনের প্রায় কাছে চলে এসেছে। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে সাবমেরিনটি কাত হয়ে গেলো। সব শেষ, এবার মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু না, এবার আর কন্ট্রোলরুমের ভুল হয়নি। ধাক্কা লেগে ব্রিজের রেলিংযের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। সাবমেরিনটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল সমুদ্রের গভীরে। এবারের মতো রক্ষা পাওয়া গেলো। সাবমেরিনটি আবার আগের মতোই নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চলতে লাগলো। বিপদমুক্ত হয়ে সাবমেরিন কমান্ডার কর্মরত ক্রুদের ধন্যবাদ জানালেন। তারপর বললেন, “আমি আমার সহকর্মীদের বলছি, আপনারা অবশ্যই ভবিষ্যতের পথচলায় আমাদের সহযাত্রী এই ভারতীয় নেতা ও তার সেক্রেটারির কাছ থেকে ঘোর বিপদে শান্ত আর অবিচলিত থাকার শিক্ষাটি গ্রহণ করবেন।
জার্মানি থেকে রওনা হওয়ার ঠিক দু’মাস পরে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে মাদাগাস্কার উপকূলে একটি পেরিস্কোপ দেখা গেলো। স্পষ্ট সংকেত। জার্মান সাবমেরিনের পেরিস্কোপও মাথা উঁচু করলো। একটু পরে জাপানি সাবমেরিন I-29 ভেসে উঠলো। তারপর জার্মানদেরটা। সাগরে বেশ ঢেউ আছে। সেই ঢেউয়ে ভাসানো হলো ভেলা। ভেলায় চেপে নেতাজি ও তার সেক্রেটারি জাপানি সাবমেরিনে উঠলেন। তারপর আবার জলে ডুব দিলো দুই সাবমেরিন। দুর্গম অভিযানের বড় পর্যায়টি শেষ।
জাপানি সাবমেরিন আকারে বেশ বড়। বড় কেবিন। হাঁটাচলার সুযোগ আছে। এটায় ওঠার পর নেতাজি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন, বেশ খুশি। আরো একমাস চলার পর সুমাত্রার সবংয়ে নামলেন নেতাজি আর আবিদ হাসান। মোট নব্বইদিন সাবমেরিন যাত্রা শেষে মাটিতে পা রাখলেন, সেই মাটি আবার এশিয়ার।
সিঙ্গাপুরে এসে রাস বিহারী বসুর ন্যাশনাল লীগের দায়িত্ব নেন। সিঙ্গাপুর এসে সুভাষ পুরো যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। গঠন করেন 'আজাদ হিন্দ সরকার'। সেটাই ছিল ভারতের বাইরে দেশটির প্রথম অস্থায়ী স্বাধীন সরকার। সুভাষ বসু হলেন সেই সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান এবং ৪৫ হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা আত্মসমর্পণ করলেন। তাদের নিয়ে গঠিত হল ভারতের মুক্তি বাহিনী- ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি (আইএনএ)। তিনি হলেন তার সুপ্রিম কমাণ্ডার।" এখানেও গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী। একইভাবে এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও চৌকষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। যুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য তার প্রয়োজন অনেক অর্থের। এ অঞ্চলে প্রচুর ভারতীয় বসবাস করে। সুভাষ অর্থের জন্য হাত বাড়ালেন। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, সায়গন, কুয়ালালামপুর, রেঙ্গুন, পেনাং, সাংহাই, ক্যান্টনে সভা-সমাবেশ করে ভারতীয়দের কাছে অর্থ চাইলেন। নেতাজির এ আহ্বান মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্ন জন্ম দেয়। তারা বিপুলভাবে সুভাষকে সহযোগিতা করে। যার কতটুকু সম্পদ ছিলো তা ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজির কাছে সমর্পণ করে।
সুভাষ নিজ বিশ্বাস, দর্শন ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন। তিনি আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তাই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসে, সবই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সিঙ্গাপুরের চেটিয়া সম্প্রদায় বিপুলভাবে ধনী। সম্পদের অভাব নেই তাঁদের। চেটিয়া সম্প্রদায় ঘোষণা করলেন যে, সুভাষের ভাণ্ডার পূর্ণ করে দেবে যদি তিনি তাদের মন্দিরে যান। সুভাষ রাজী হলেন এবং বললেন, তাঁর সহকর্মীদে নিয়ে সময় করে যাবেন। এতে চেটিয়ারা চমকে উঠলেন। কারণ, সুভাষের সহকর্মীদের মধ্যে আছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ নানা ধর্মের মানুষ। তারা সবাই মন্দিরে গেলে জাত-ধর্ম সবই তো শেষ হয়ে যাবে। তাই সবাইকে নিয়ে মন্দিরে যাওয়ার বিষয়ে ছেটিয়া সম্প্রদায় আপত্তি জানায়। জবাবে সুভাষও বলেন, আমার সহকর্মীরা যেখানে যেতে পারবে না, সেখানে আমিও যেতে পারি না। ওই অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। আমার কাছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই ভারতবাসী। অবশেষে চেটিয়া সম্প্রদায় রাজি হন এবং সবাইকে নিয়ে সুভাষ মন্দিরে যান।
সুভাষ সিঙ্গাপুরে এসে গঠন করা আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে এবার দিল্লি দখলের পরিকল্পনা করেন সুভাষ। শুরু হলো যুদ্ধ। আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে মিয়ানমার। পথে পথে লড়াই। প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে মণিপুরের ইম্পাল পৌঁছে যায় তাঁর বাহিনী। ইম্পাল পৌঁছার পর জাপানের পক্ষ থেকে বিমান আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। একইসাথে খাদ্য-রসদ সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। সুভাষ প্রত্যক্ষভাবেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তখন জরুরিভিত্তিতে তাঁকে সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। এ সময়ে হঠাৎ করেই জাপান আত্মসমর্পনের ঘোষণা দেয়। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে সুভাষ সিঙ্গাপুর ফিরে আসেন। মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে প্রবল চাপের মুখে সুভাষ সিঙ্গাপুর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
১৬ই আগস্ট ১৯৪৫ সকাল সাড়ে নয়টায় বিমানে চেপে বসেন সুভাষ। বিমান কোথায় যাবে উপস্থিত কেউ জানে না। শুধু বুঝা গেলো প্রকৃত যাত্রা শুরু হবে ব্যাংকক থেকে। যাবার আগে তিনি এক হুকুম নামায় লিখে গেলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে আজাদ হিন্দ প্রভেন্সিয়াল সরকারের প্রধান হবেন মেজর জেনারেল এম জেড কিয়ানি। বিকেল তিনটায় ব্যাংকক পৌঁছালেন। সেখান থেকে ১৭ই আগস্ট সহকর্মী আয়ার, কর্নেল হাবিবুর রহমান, প্রীতম সিং, গুলজার সিং, আবিদ হাসান এবং দেবনাথ দাসসহ সাইগনের উদ্দেশে যাত্রা। একটি বিমানেই যাওয়া যেতে, কিন্তু জাপান সরকারের নির্দেশে একই সাথে আরো একটি বিমান রওনা হলো। একটি বিমানে সুভাষ, কর্নেল হাবিবুর রহমান, প্রীতম সিং, আয়ার এবং জাপানি কর্নেল কিয়ানো। অন্যটিতে জেনারেল ইসোদা, মি. হাচাইয়া, গুলজার সিং, আবিদ হাসান এবং দেবনাথ দাস। বেলা ১০টায় সাইগন পৌছালেন। হঠাৎ করে জাপানি লিয়াজোঁ অফিসার এসে জানালেন, এই মুহূর্তে বিমানবন্দর থেকে একটি জাপানি বিমান ছাড়বে। একটি সিট খালি আছে। এখনই নেতাজিকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। তার সহকর্মীদের ডেকে দড়জা বন্ধ করে বৈঠক করলেন। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলেন। বিমান কোথায় যাচ্ছে, তা কেউ জানে না। নেতাজিও না। অনুরোধ করে আরেকটি সিট পাওয়া গেলো।
নেতাজি ও কর্নেল হাবিবুর বিমানে চেপে বসলেন। সাইগন থেকে হাইতো। তার আগে যাত্রবিরতি ঘটলো তুরান বিমানবন্দরে। তুরানে রাত্রি যাপন। পরদিন ১৮ই আগস্ট তুরান থেকে দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট স্যালি ৯৭.২ মডেলের বোমারু বিমানে যাত্রা। লক্ষ্য হাইতো। কিন্তু হাইতো বিমানবন্দরে নামা হলো না। সেখান থেকে ফরমোজা দ্বীপের তাইহোকু বিমানবন্দর। তাইহোকু থেকে দাইরেন। তারপর সবই ধুয়াশা। বিমানটি দুইশত ফুট উপরে ওঠার পর বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাসমূহের মধ্যে আর কোন মিল পাওয়া যায় না। তাহলে নেতাজি কী বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন? হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু সঠিক উত্তর মেলে না।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এখনও বেঁচে আছেন? নিশ্চিত হওয়ার মত অকাট্য প্রমাণ নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ১৯৪৫ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যদি মুত্যুবরণ করে থাকেন, তবে জাতিসংঘ তাঁর বিচারের জন্য ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিলো এবং পরে তা বৃদ্ধি করলো কেন? শুধু তাই নয়, ব্রিটেন-আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে, ২০২১ সালের আগে ভারত বা কারো কাছে থাকা নেতাজী সংক্রান্ত কোন নথি প্রকাশও করতে পারবে না। এমন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নেতাজীকে নিয়ে কেন এত ভয়? ব্রিটেন-আমেরিকার এমন সিদ্ধান্তে কথিত ক্ষমতাধর ভারতের কোন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রতিবাদ করেননি। তাহলে ভয়টা কি নেতাজীর প্রিয় জন্মস্থান ভারতের নেতাদের মধ্যেও রয়েছে?
হ্যাঁ, নেতাজীকে নিয়ে ভারতের নেতাদের আগাগোড়াই ভয় ছিলো। তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। ১৯৩৯ সালের কথা। ১২ই জুলাই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কংগ্রেসের সভাপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লিখিতভাবে সুভাষকে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেন। অভিযোগ, বোম্বে এআইসিসির মদ্যপান নিষিদ্ধ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন নেতাজী। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের প্রতিবাদে এ কারণ দর্শানোর নির্দেশ খরিজ হয়ে যায়।
স্বাধীনের পরও নেতাজি বিহীন ভারতে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে সুভাষ বিরোধী অনেক ঘটনা রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নির্দেশ দেন যে, ভারতের কোন থানায় নেতাজীর ছবি টাঙানো যাবে না। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর লোকসভায় প্রশ্ন উঠে, নেতাজীর আজাদ হিন্দ সরকারের বিপুল সম্পদ কোথায় গেলো? নেতাজীর আজাদ হিন্দ সরকারের কাছে বিপুল সম্পদ গোচ্ছিত ছিলো। পূর্বএশিয়ার ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দ সরকারকে তাদের সর্বস্ব তুলে দেয়। নেতাজীর অন্তর্ধানের পর সেইসব সম্পদ কোথায় গেল? কে তা ভোগদখল করছে? নাকি এসব সম্পদ ব্রিটিশ বা ভারত সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে?
আজাদ হিন্দ সরকারের ব্যাংক গভর্নর ছিলেন ইয়েলাপ্পা। যুদ্ধ শেষে নেতাজীর নির্দেশে ইয়েলাপ্পা ব্যাংকের টাকা-পয়সা, স্বর্ণ কয়েকটি বাক্সে ভরে বিমানে করে নিয়ে মিয়ানমারের (বার্মা) নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে যাচ্ছিলেন।ইয়েলাপ্পাকে বহনকারী বিমানে ব্রিটিশ বোমারু বিমান হামলা চালায়। হমালায় ইয়েলাপ্পা মারা যান এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গী গ্রেফতার হন। জানা যায়, ইয়েলাপ্পার সাথে যে সম্পদ ছিলো, তখনকার বাজার দরে তার মূল্য ছিলো সাত কোটি সাঁইত্রিশ হাজার টাকা। সব সম্পদ ব্রিটিশ জেনারেল হিউ টয়ের হাত ঘুরে নেহেরুর দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে আত্মগ্লানিতে হোক আর ভাগে কম পেয়েই হোক, জেনালের হিউ টয় নেতাজীর জীবনী রচনায় এ ঘটনা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও আরও অনেক স্থানে আজাদ হিন্দ সরকারের অর্থসম্পদ গচ্ছিত রাখা ছিলো। সে সব সম্পদও পরে বিভিন্ন উপায়ে ভারত সরকারের হাতে চলে আসে।
বিভিন্ন সময়ে ভারতের রাজনীতিতে নেতাজী আলোচনায় এসেছেন। তিনি জীবিত না মৃত তা যেমন অজানা, তেমনই অজানা থেকেছে তাঁর সরকারের সম্পদের পরিমাণ ও অবস্থান। সেই সব সম্পদ এখন ভারত সরকারের কাছে, নাকি অন্য কোন দেশে- এ নিয়ে সময়ে সময়ে ভারতের লোকসভায়ও বিতর্ক উঠেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। এমন এক বিতর্কে ১৯৮৭ সালের ৩রা আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় যে, Assets of Netaji Subhas Chandra Bose worth Rs.114 cores transferred to the Govt. of India by the Govt. of Japan, Burma and Singapore. অর্থাৎ জেনারেল হিউ টয়ের মাধ্যমে লুটপাটের পরও জাপান, মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকারের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুকানো ছিলো। স্বাধীনতার পর ওই সান তা ভারত সরকারের হাতে তুলে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এ অর্থ-সম্পদ দিয়ে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হবে। কিন্তু তা না করে নেহেরু সেই অর্থ ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংকে নিজের নামে রাখেন। ব্যাংকে রাখা এই সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়, এক লক্ষ ৪৭ হাজার ১৬৩ পাউন্ড এবং পাঁচ কিলো স্বর্ণ। লোক দেখানোর জন্য কিছু স্বর্ণ ও মাত্র ২০০ টাকা জাতীয় সংগ্রহশালায় রাখা হয়।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এই বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন দেশ স্বাধীন করার জন্য। নিজেদের রাজপরিবার পরিচয় দেওয়া একটি পরিবারও নেতাজির কিছু সম্পদ ভোগদখল করেছে। অথচ এই সম্পদের ওপর অধিকার রয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের শহিদ পরিবারগুলো। আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিবারের সৈন্যরা ভারত সরকারের কাছে বার বার পেনশনের দাবি জানিয়ে আসছে। নেতাজীর গড়ে তোলা সম্পদ থেকেই এ পেনসন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ভারত সরকার সেই পেনশনের দাবিও ফিরিয়ে দিয়েছে বার বার।
নেতাজীকে নিয়ে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের যেমন ভয় ছিল, তেমনি ভয় ছিল ব্রিটিশ শাসকদের। স্বাধীনতার পরও সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে কংগ্র্রেস নেতাদের। এখনও ভারতের শাসকদের ভয়, যদি নেতাজীর মৃত্যু না হয়ে থাকে, যদি তিনি আবার ফিরে আসেন আত্মগোপন জীবন থেকে? নেতাজী ফিরে এলেই ভারতের জনগণের কাছে তাদের মুখোশ খুলে যাবে। একইভাবে এতদিন পরও ভয় পায় বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। উন্মোচন হবে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনের ইতিহাস। ভারতের স্বাধীনতার বর্তমান নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কী ছিলো, সেই বিষয়টিও খোলাসা হয় যাবে। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের দাবির মুখে ব্রিটিশরা কি ভারত ছেড়েছে? ভরত ছেড়ে যাওয়ার জন্য কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কার্যত তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বরং কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছে। ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত দলিলের ষষ্ঠখণ্ডে ভারত স্বাধীনতার কিছু প্রমাণ রয়েছে। এ দলিলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি লিখেছেন, ‘আজাদ হিন্দ সরকার, আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধবন্দি ও বিচারকে কেন্দ্র করে সারাদেশের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনা, রাজকীয় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো, এই পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যাতীত বিকল্প পথ ছিলো না।’ ভারতের স্বাধীনতার সময়ে ক্লিমেন্ট এটলির এ লেখা সম্পর্কে ভারতবাসী জানতে পারেনি। এটলির এই বিবরণ থেকে সহজেই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ফুটে ওঠে।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সাল পর্য়ন্ত। ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট নেতাজী ঘোষণা করেছিলেন, ‘কারও দাক্ষিণ্যের ওপর ভরসা আমি কোনদিন করিনি, করবোও না। যখন আসবো, সেজন্য কারও সম্মতি, অনুমতি-এসব দরকার হবে না। ঝড়ের মতো আসবো’। এ কারণেই ভয়টা থেকেই যাচ্ছে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা ও বিশ্ব শক্তির।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বেঁচে আছেন কিনা এ বিতর্ক যুগ যুগ সজিব থাক। নেতাজী আসবে, মূর্ত না হোক, বিমূর্ত নেতাজী যুগে যুগে ফিরে আসবে মানবের মুক্তির আকাঙ্খায়। নেতাজীরা মরে না, তাঁদের হত্যা করা যায় না। তাঁরা যুগে যুগে ফিরে আসেন মানুষের মুক্তির দিসারী হয়ে।
লেখক : চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
কয়েক বছর ধরে তিনি দলের নেতাদের সতর্ক করে বলছেন, সহসই বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও বক্তব্য রাখছেন। যুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছেন। বলছেন, স্বাধীনতার জন্য এটাই সঠিক সময়। কিন্তু দলের নেতারা এ নিয়ে কোনো কথা বলছেন না, কথা বলছেন না সহযোদ্ধারাও। হয়তো যুদ্ধ নিয়ে তাঁরা কোনো খোঁজ-খবর রাখছেন না। তাঁদের ধারণা নেই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে। যুদ্ধ বাঁধলে তার মধ্যে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি- এ বিষয়েও নেতারা একমত নন। যুদ্ধের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার বিষয়ে শীর্ষ নেতারা তীব্র বিরোধী। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন, স্বাধীনতা ভিক্ষে করে পাওয়ার বিষয় নয়, এটা অর্জন করতে হয়। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হয়, লড়াই করতে হয়, রক্ত দিতে হয়, জীবন দিতে হয়। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব।’
হ্যাঁ, সুভাষ চন্দ্র বসুর কথাই বলছি। যিনি নেতাজী নামে সমাধিক পরিচিত। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭। উড়িষ্যার কটক তার জন্মস্থান। বাবা ছিলেন আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবী। পারিবারিক চাপে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ হন সুভাষ। কিন্তু যোগদান করেননি। ভাইয়ের কাছে দীক্ষা পান রাজনীতির, জড়িয়ে যান রাজনীতিতে। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান না হয়েও তিনি উপমহাদেশে অতি পরিচিত একটি নাম। তাঁর মতো আলোচিত নেতা উপমহাদেশে দ্বিতীয় কেউ নেই। যুদ্ধকালে যেমন আলোচিত ছিলেন, যুদ্ধের পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন মিত্রশক্তির অন্যতম চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ব্রিটিশরা তাঁকে সবসময় তীক্ষ্ম নজরদারিতে রেখেছে। তাই অজ্ঞাত কারণে যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় তাঁর স্থান। বিশ্বযুদ্ধের পর ৭৬বছর জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধী তালিকায় তাঁর নাম ছিলো। স্বাভাবিকভাবেও এতদিন একজন মানুষের বাঁচার কথা নয়। তবুও তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, তাঁকে যেখানে, যে অবস্থায় পাওয়া যাবে, জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এই সময়ে তাঁর কোনো লেখা বা গোপন দলিল ভারত সরকার বা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নেতাজির প্রথম মেয়াদ ছিলো ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু বলা তো যায় না, যদি তিনি বেঁচে থাকেন! তাই মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সাল নির্ধারণ করে জাতিসংঘ।
বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যু নিয়ে যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে অনেক তদন্ত হয়েছে। একাধিক কমিশন গঠন কিয়া হয়েছে, তদন্তের জন্য। কিন্তু কোনো কূলকিনারা করা যায়নি। মৃত্যুঘটনা আরো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। আগেও তিনি ব্রিটিশদের রহস্যের মধ্যে ফেলেছেন। কখন, কিভাবে শতাধিক গোয়েন্দার চোখ ফাঁকি দিয়ে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বের হলেন। যেখানে তাঁকে খারার দিতো গোয়েন্দারা! কীভাবে, কোন পথে, কী উপায়ে কলকাতা থেকে পাড়ি জমালেন জার্মানিতে! এটাও ব্রিটিশ-ভারতের সরকারের কাছে রহস্য! তারা জানতেন সুভাষ এলগিন রোডের বাড়িতেই আছে। কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন জার্মানিতে থেকে ইথারে ভেসে এলো- "আমি সুভাষ বলছি..."! যে ব্যক্তি এতো দুঃসাধ্য সাধন করতে পারে, সে হয়তো বিমান দুর্ঘটনার মাঝেও কোনো উপায়ে বেঁচে যেতে পারে। তাই হয়তো ব্রিটিশ- আমেরিকা মনে করছে সুভাষ হয়তো বেচেঁ আছেন।
সত্যি কি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ মারা যায়নি? দুর্ঘটনা থেকে কিভাবে রক্ষা পেলেন? সত্যি কি তিনি এখনও বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে তিনি কোথায় আছেন? তার প্রিয় জন্মভুমি ভারতে? নাকি মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন? নাকি আবারো জার্মানিতে? জার্মানিতে তো এখন নাজি বাহিনী নেই, কিভাবে সেখানে থাকবেন? সবার চোখে ধুলো দিয়ে ব্যাংকক ছাড়লেন কিভাবে? বেঁচে থাকলে সেখান থেকে কোথায় গেলেন? বিমান দুর্ঘটনার রহস্য কী? এমন হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু কোনো সদুত্তর নেই, উত্তর নেই মিত্রশক্তির কাছে, উত্তর নেই জাতিসংঘের কাছে। মৃত্যু নিয়ে অকাট্য প্রমাণও নেই। যদিও জাপান বিমান দুর্ঘটনার বিষয়ে নানা কথা বলছে, নানা প্রমাণ তুলে ধরছে। কিন্তু তাতে আস্থা রাখতে পারছে না কেউ। এমন কি সুভাষের আত্মীয়রাও নন।
জাতিসংঘের তালিকায় নেতাজি যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু কেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য কি সুভাষ দায়ী? তিনি কি কোনো দেশ দখল করেছিলেন? কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন? তিনি কোনো গণহত্যা করেছিলেন? কোনো দেশে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন? এসবের কোনোটাই সুভাষ করেননি। তিনি মাতৃভুমির স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করিলেন। কারণ, ব্রিটিশরা কথা রাখে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তারা স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলো। কথা রাখেনি। সুভাষ জানতেন আবারো একই কাজ করবে ব্রিটিশরা। যতই বলুক, এবারেও স্বাধীনতা দেবে না। যুদ্ধের পর সে প্রমাণ রেখেছে ব্রিটিশরা। তাই সুভাষ যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। এটাই তাঁর দোষ। তিনি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনতে চেয়েছিলেন। তাই সুভাষ আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করে বলেছিলেন, আপনারা রক্ত দিন, আমি স্বাধীনতা দিবো। এই রক্ত দিতেই তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ব্রিটিশদের যুদ্ধে নেমেছিলেন। নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা কী অপরাধ?
সুভাষ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেবে না। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে লাগাতার। এ নিয়ে কংগ্রেসের অনেক শীর্ষ নেতাদের সাথে মতদ্বৈতা ছিলো আগাগোড়াই। হরিপুরা কংগ্রেসে ১৯৩৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি সুভাষ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। সম্মেলনে তিনি ইউরোপে যুদ্ধের ঘনঘটা, শিল্পোন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, বুনিয়াদি শিক্ষা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে বক্তৃতা করেন। পরবর্তী সম্মেলনে তিনি পুনরায় সভাপতি পদের প্রার্থী হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী তা সমর্থন করেছিলেন না। ১৯৩৯ সালে গান্ধীজির প্রচণ্ড আপত্তির মুখেও নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ। গান্ধীজির সাথে চ্যালেঞ্জ দিয়েই তিনি আবারও কংগ্রেস সভাপতি হন। তাই দলের ভেতরে পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হন তিনি। তবুও থেমে যাওয়ার পত্র নন নেতাজি। অবশেষে কংগ্রেস থেকে বহিস্কার করা হয় সুভাষকে।
সুভাষ যে আদর্শ লালন করতেন, যে আদর্শ বিশ্বাস করতেন, সেই আদর্শের দল গঠনের অনেকটা প্রস্তুতি ছিলো আগে থেকেই। সেই প্রস্তুতির চূড়ান্ত মহড়া হয় ১৯২৮ সালে। এ বছর কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের শৃংখলা রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পান সুভাষ। এ জন্য তিনি গঠন করেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স। বাঙালিরাও যে সুসজ্জিত বাহিনী গড়ে তুলতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেখালেন সুভাষ। যদিও এই বাহিনী ও সার্বিক শৃংখলা দেখে গান্ধীজি বিরূপ মন্তব্য করে বলেছিলেন, পার্কসার্কাসে নতুন সার্কাস দেখালো সুভাষ। কংগ্রেস ছেড়ে আসার পর সেই ভলেন্টিয়ার্সদের দিয়েই সুভাষ গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল- ফরোয়ার্ড ব্লক। #
যুদ্ধ বেঁধে গেছে ইউরোপজুড়ে। এটাই ব্রিটিশদের হটানোর মোক্ষম সুযোগ। কিন্তু ব্রিটিশ হটানোর আন্দোলন-সংগ্রাম কোথায়? কংগ্রেস নেতারা চুপশে গেছেন, কিংকর্তব্যবিমুড়! কী করতে হবে এ সময়, যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না তাঁরা। এমন পরিস্থিতিতে দর্শক হয়ে বসে থাকার মানুষ নন সুভাষ। যুদ্ধ শুরু হলে কী করতে হবে, আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিলো তাঁর। একবার যা চিন্তা করনে, তা থেকে সুভাষকে সরানো কঠিন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করবেন তিনি? তিনি যে ভারতের আর সব নেতাদের মত মুক্ত স্বাধীন নন। ব্রিটিশরা এটা ভালো করেই জানে। তাই গৃহবন্দি তিনি। শতাধিক গোয়েন্দার নজরদারিতে সুভাষ। তাঁর বাড়ির ভেতরেও পাহারা বসানো হয়েছে। এমনকি সুভাষকে খাবার পরিবেশন করে গোয়েন্দা। এমন অবস্থায় নতুন করে চিন্তা করতে হয় সুভাষকে।
বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে যেকোন মূল্যে স্বাধীনতা চাই। সময় ক্ষেপনের কোন সুযোগ নেই। সুভাষ বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এজন্য চাই আধুনিক অস্ত্রসম্ভার, চাই সুদক্ষ সেনাবাহিনী। ব্রিটিশ-ভারতে বসে তা কীভাবে সম্ভব? তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জার্মানীতে যাবেন। সেখানে গিয়ে হিটলারের সাথে কথা বলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। যুদ্ধে ব্রিটিশরা জার্মানির শত্রু। স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটিশরা আমাদেরও শত্রু। শত্রুর শত্রু মিত্র- এটি সাধারণ সূত্র। কিন্তু জার্মানিতে যাওয়া তো সহজ কথা নয়। কথাটি তিনি জানালেন তার ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা সর্দার নিরঞ্জন সিং তালিবকে। জানালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। দেশ থেকে বের হওয়ার জন্য নিরঞ্জন সিংয়ের সহযোগিতাও চাইলেন। সর্দারজি ভাল করেই জানেন সুভাষ যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন রুখনেওয়ালা নেই। ঠিক হলো পেশোয়ার থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে কাবুল হয়ে দেশের বাইরে যাবেন সুভাষ।
১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারি। রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। কোলকাতার এলগিন রোড নিস্তব্দ, নিস্তব্দ ৩৮-২ নম্বর বাড়ি। রোডের আলো নেই, জনমানব নেই। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন সুভাষ। এবার বেড়িয়ে পড়তে হবে। সুভাষ এখন পাঠান যুবক বেশে। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বের হলেন। বসলেন ওয়ান্ডার বিএলএ ৭১৬৯ গাড়িতে। গাড়ির চালক ভাইপো ড. শিশির কুমার বসু। বাড়ি থেকে বিদ্যুত গতিতে ট্রাঙ্ক রোড ধরে এগিয়ে চলছে। আসানসোল হয়ে ধানবাদের কাছাকাছি এক বাংলো বাড়িতে গাড়িটি থামলো। বাড়িটির বাইরের এক ঘরে তার যাত্রা বিরতি। পাঠানবেশি সুভাষকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি চলে গেলো। ভাবখানা যেন ভাড়া করা গাড়িতে এসেছেন পাঠান সাহেব। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। সেখান থেকে গোমে স্টেশন। বাংলো বাড়িটি সুভাষের আরেক ভাইপো আশোক বসুর। গোমে স্টেশন থেকে পেশোয়ার। তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ হয়ে কাবুল যেতে হবে। এই বাসাতেও গোয়েন্দা নজরদারি! তাই আপন ভাইপোর স্ত্রীকেও বুঝতে দেননি যে, তিনি সুভাষ! গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুভাষ পৌঁছে যান সীমান্ত প্রদেশ। সেখান থেকে দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দিয়ে পরিকল্পনা মতো কবুল পৌঁছে যান। কবুলের ইটালি দূতাবাস থেকে কৌশলে ইতালির নাগরিকের পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। যুদ্ধে জার্মানি আর ইতালি বন্ধু। ইতালি নাগরিকের পরিচয়পত্রে নেতাজি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রবেশ করেন। তখনও জার্মানীরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেনি, বরং দুই দেশের মধ্যে রয়েছে অনাক্রমণ চুক্তি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নেতাজি পৌঁছে যান জার্মানিতে।
জার্মানিতে গিয়ে সুভাষ তার পরিকল্পনার কথা নাজি নেতাদের জানালেন। তারপর হিটলারের সাথে দেখা। হিটলারের সাথে আলোচনা করে গড়ে তোলেন "আজাদ হিন্দ ফৌজ"। অনেক ভারতীয় ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ইউরোপ ও আফ্রিকায় যুদ্ধে পরাজিত অনেকেই জার্মানিতে আটক রয়েছে। পরাজিত বন্দি ভারতীয়দের নিয়ে সুভাষ গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। এই যোদ্ধাদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারত স্বাধীন করতে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এই বাহিনী নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করবেন। এখানেই তিনি গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ রেডিও, বার্লিন। আজাদ হিন্দ রেডিও থেকেই একদিন ইথারে ভেসে এলো, , ‘আমি সুভাষ বলছি…’। চমকে উঠে ব্রিটিশ সরকার। কীভাবে সম্ভব এটা। ৬২ জন গোয়েন্দার সদাসতর্ক চোখ সুভাষের ওপর। সবার চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষ জার্মানিতে!!
স্বাধীনচেতা সুভাষ কখনই কোন শক্তির প্রতি নির্লজ্জ সমর্থন বা দায়বদ্ধ হননি। মিউনিখে অবস্থানকালে নাৎসিবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় সুভাষকে সংবর্ধনা দেবে। কিন্তু তার আগের দিন হিটলার বেতার ভাষণে ভারতে বৃটিশ শাসনের সুখ্যাতি করে। এ পরিস্থিতিতে কী সুভাষ সংবর্ধনা নিতে পারে? কোন দ্বিধা না করেই সুভাষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাতিল করে দেন। একই সাথে তিনি ঘোষণা করেন, Hitler is a liberty to lick British boot. সুভাষের মুখে একথা শুনে ইউরোপ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আশ্চর্য! হিটলার এই দুঃসাহসী বক্তব্যের জন্য হিটলার কিন্তু সুভাষের প্রতি ক্ষিপ্ত হননি। বরং সুভাষকে সম্মান দেখিয়ে ভুল স্বীকার করে পরদিন হিটলার তার বেতার ভাষণ প্রত্যাহার করেন। জার্মানীতে সুভাষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্যক অবহিত হন ভারতের স্বাধীনতার আরেক নেতা রাস বিহারী বসু। স্বাধীনতার জন্য তিনি দেশ ছাড়া। রাশ বিহারী বসু তখন জাপানে। ব্রিটিশদের তালিকায় তিনিও শত্রু। বয়সের ভারে তিনি ক্লান্ত, তাই বলে ভারতের স্বাধীনতার জন্য তার জীবনী শক্তি তখনও উন্মত্ত। তিনি মনে করলেন, সুভাষ তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন। জার্মানীতে খবর পাঠালেন সুভাষকে সিঙ্গাপুরে আসার জন্য। জানালেন সুভাষ এসে তার ন্যাশনাল লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করুক।
কিন্তু কিভাবে সিঙ্গাপুর যাবেন সুভাষ? যুদ্ধ মারাত্মক পরিস্থিতি ধারণ করেছে। সুদূর জার্মানি থেকে বিমানে সিঙ্গাপুর যাওয়া কোনোভাবেই নিরাপদ হবে না। সমুদ্রপথে ব্রিটিশ জাহাজের উপস্থিতি রয়েছে। জাহাজে যাওয়াটাও বিপদসংকুল! ২২ শে জুন ১৯৪১। হঠাৎ করেই হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণ সুভাষকেও চিন্তায় ফেলে দিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশের ছক আর থাকলো না। উপায় কী? সুভাষ ভাবলেন সিঙ্গাপুর থেকে সহজেই ভারতে প্রবেশ করা যাবে। তাই যেকোনো উপায়ে সিঙ্গাপুর যেতে পারলে বিষয়টি সহজ হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন, যেকোনো উপায়ে সিঙ্গাপুর যেতেই হবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো সাবমেরিনে করে সুভাষকে সিঙ্গাপুর পৌঁছে দেবে জার্মান সরকার।
সাবমেরিনে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কি নিরাপদ হবে? ইংলিশ চ্যানেল, উত্তর সাগর, ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর- সব খানেই মিত্রবাহিনীর উপস্থিতি। পথে টর্পেডো, মাইন বা ভারী কামানের আওতায় পড়তে হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও অন্য পথের চেয়ে সাবমেরিন যাত্রায় বিপদ কিছুটা কম। যাত্রাপথের প্রথমাংশ বেশি বিপদসঙ্কুল। ঠিক হলো পথের এ অংশের দায়িত্ব নেবে জার্মান সরকার। তারা নেতাজিকে মাদাগাস্কারের কাছাকাছি একটি স্থানে পৌঁছে দেবে। বাকি অংশের দায়িত্ব জাপান সরকারের।
যাত্রা শুরুর আগে সুভাষের কয়েকটি বক্তৃতা রেকর্ড করা হলো। বার্লিন ত্যাগের পর রেকর্ডগুলো আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে প্রচার করা হবে। ব্রিটিশ-মার্কিন শক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ পরিকল্পনা করা হলো। তারা যাতে মনে করে যে, নেতাজি জার্মানিতেই আছেন। সাবমেরিনে সুভাষের একজন সঙ্গী, তিনি হলেন আবিদ হাসান। হায়দ্রাবাদের এই তরুণ ছাত্র বার্লিনে অধ্যয়নরত এবং সুভাষের একান্ত সচিব। U-180 সাবমেরিনটি সুভাষের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। চরম বিপর্যয়ের মুখে জার্মানির পক্ষে ভিন্ন দেশের এক রাষ্ট্রনায়কের জন্য সাবমেরিনের ব্যবস্থা করা সত্যিই অভাবনীয়। নেতাজিকে সেই অভাবনীয় সম্মান দিলেন জার্মানি।
৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। জার্মানির ‘কিল’ নৌ বন্দর থেকে সুভাষ বোসকে নিয়ে সাবমেরিন যাত্রা শুরু করে। ডিজেল ইঞ্জিনের পুরানা ধরনের সাবমেরিনটি সমুদ্রগভীরে একটানা আটচল্লিশ ঘন্টার বেশি চলতে পারে না। তারপর ব্যাটারিতে চার্জ দেয়ার জন্যে মাঝে মাঝেই জলের উপরে উঠতে হয়। জলের উপর ভেসে ওঠা সবচেয়ে বিপজ্জনক। যেকোনো মুহূর্তে শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই।
উপরে উত্তাল সমুদ্র। অবিরাম ঢেউ গড়ছে আর ভাঙছে। নীচে চলমান সাবমেরিন সুভাষকে নিয়ে এগিয়ে চলছে মন্থর গতিতে। ভাসমান অবস্থায় এর গতি ঘন্টায় বিশ নটিক্যাল মাইল। জলের নীচে ঠিক তার অর্ধেক। মাঝে মাঝে আরও কম। যাত্রাপথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সুভাষ ভাবছেন বিপদসঙ্কুল এই পথ বোধ হয় শেষ হবে না। এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে তাঁর ‘প্রিয় মেজদাদা’ শরৎচন্দ্র বোসকে চিঠি লিখলেন। তাঁর চিন্তা জার্মানি হঠাৎ রাশিয়া আক্রমণ করায় যুদ্ধ নানাদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই অবস্থায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ হানার উপযুক্ত জায়গা হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। তাই সেখানে তাঁকে পৌঁছাতেই হবে।
চারপাশে শত্রুপক্ষের বেড়াজাল। যুদ্ধজাহাজ, ডেস্ট্রয়ার, ক্রুজার বিমান বহর, ডেপথচার্জ, টর্পেডো সবকিছু যেন বসে আছে হিংস্র হায়েনার মতো। একটু টের পেলে আর রক্ষা নেই। তাই যেতে হবে খুব সন্তর্পনে। সবচেয়ে মারাত্মক হলো ডুবন্ত মাইনগুলো। হাজার, হাজার শক্তিশালী ডুবন্ত মাইন পোতা আছে উপকূল ঘিরে। কোনো একটার সাথে সামান্য সংঘর্ষ হলেই মৃত্যু অনিবার্য।
ঘুম নেই, সদা সতর্ক সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন মুসেমবার্গ। সারা চোখে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি। যেভাবেই হোক সুভাষ বোসকে পৌঁছে দিতে হবে তার কাঙ্খিত গন্তব্যে। দিনের পর দিন চলে যায়। সাবমেরিনের চলার বিরাম নেই। এদিকে কেবিনে সুভাষ তার আগামী দিনের সংগ্রামের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে এই লড়াই চালিযে যেতে হবে।
ছোট্ট কেবিন। সোজা হয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই। দু’পা হেঁটে চলার মতো জায়গা নেই। সেদিকে নেতাজির কোনো নজর নেই। দেহের ওজন প্রায় ১৬ পাউন্ড কমে গেছে। মুখ দাড়িতে ঢাকা। গায়ে জার্মান নৌবিভাগের পোশাক। মুখে নির্ভুল জার্মান ভাষা। সুভাষের এই ছদ্মবেশের আড়াল থেকে আসল মানুষকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। চারদিকে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর কড়া নজরদারি। যেকোনো মুহূর্তে সাবমেরিনটি শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সুভাষের এ সতর্কতা। এখানে তিনি সাবমেরিনের এক জার্মান অফিসার মাত্র।
নেতাজি তিন-চার ঘন্টার বেশি ঘুমান না। বাকি সময়টায় শুধু কাজ আর কাজ। নানা ধরনের পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরিতে তিনি ব্যস্ত। সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে বিভিন্ন বক্তৃতার খসড়া প্রস্তুত করা, নারীবাহিনী গঠনের ভাবনা, জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার নীতি স্থির করা, তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’-এর সংশোধন ইত্যাদি তার নিয়মিত কাজ। সেক্রেটারি আবিদ হাসান নোট নিচ্ছেন। পরে তা টাইপ করে সংরক্ষণ করছেন। সিঙ্গাপুর আর মালয়ে দেওয়া সুভাষের সারা জাগানো বক্তৃতার খসড়া সাবমেরিনে বসে তৈরি করা হয়।
ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চ। সাবমেরিন এগিয়ে চলছে একইভাবে। নেতাজি ব্যস্ত তার পরিকল্পনা সাজাতে। মেয়েদের নিয়ে তিনি একটি বাহিনী করতে চান। এ বাহিনীর নাম হবে ঝাঁসির রানী বাহিনী। এ সংগ্রামে মেয়েদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। লক্ষ্ণীবাঈ, মতিবাঈয়ের মতো কতো মহিয়সী নারীর জন্ম হয়েছে এই ভারতবর্ষে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জন্য এ বীরাঙ্গনারা নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছেন। তাই আজাদ হিন্দ ফৌজে অবশ্যই মহিলাদের ইউনিট খোলা হবে- সিদ্ধান্ত নিলেন সুভাষ। আবিদ হাসান নোট লিখে চলেছেন নিজের মনে।
হঠাৎ মাইক্রোফোনে কমান্ডারের উত্তেজিত কন্ঠস্বর, সাবমেরিন শত্রুর জালে আটকা পড়েছে। সবার মধ্যে উৎকন্ঠা, ব্যতিক্রম নেতাজি। কিছুক্ষণ চারপাশে চোখ বুলিয়ে তিনি আবার কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন। কিন্তু আবিদ হাসানের মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বয়ে চলেছে। শত্রুর জালে আটকা পড়লে হয় মৃত্যু, নয়তো বন্দী জীবন। কিন্তু সুভাষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি আবিদ হাসানকে কিছু নোট নিতে বললেন। কিন্তু আশু বিপদের চিন্তায় আবিদ অন্যমনস্ক। নেতাজি ধমকে উঠলেন, “আমি দু দুবার বললাম, এখনও কি না নোট নিলে না।” সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন আবিদ হাসান।
আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। কমান্ডার নির্দেশ দিলেন, “চার্জ টর্পেডো“। কিন্তু কন্ট্রোল রুমের মারাত্মক ভুলে টর্পেডো চার্জের পরিবর্তে সাবমেরিনটাই পানির উপর ভেসে উঠলো। বিপক্ষের যুদ্ধজাহাজটা গতি পরিবর্তন করে সাবমেরিনটা লক্ষ্য করে ঝড়ের মতো ছুটে আসছে। গোটা সাবমেরিনটা বন্দী করা তাদের লক্ষ্য। বিপদ দেখে কমান্ডার উত্তেজিতভাবে নির্দেশ দিলেন, “ডাইভ, ডাইভ!” ফাইটার জাহাজটি সাবমেরিনের প্রায় কাছে চলে এসেছে। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে সাবমেরিনটি কাত হয়ে গেলো। সব শেষ, এবার মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু না, এবার আর কন্ট্রোলরুমের ভুল হয়নি। ধাক্কা লেগে ব্রিজের রেলিংযের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। সাবমেরিনটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল সমুদ্রের গভীরে। এবারের মতো রক্ষা পাওয়া গেলো। সাবমেরিনটি আবার আগের মতোই নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চলতে লাগলো। বিপদমুক্ত হয়ে সাবমেরিন কমান্ডার কর্মরত ক্রুদের ধন্যবাদ জানালেন। তারপর বললেন, “আমি আমার সহকর্মীদের বলছি, আপনারা অবশ্যই ভবিষ্যতের পথচলায় আমাদের সহযাত্রী এই ভারতীয় নেতা ও তার সেক্রেটারির কাছ থেকে ঘোর বিপদে শান্ত আর অবিচলিত থাকার শিক্ষাটি গ্রহণ করবেন।
জার্মানি থেকে রওনা হওয়ার ঠিক দু’মাস পরে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে মাদাগাস্কার উপকূলে একটি পেরিস্কোপ দেখা গেলো। স্পষ্ট সংকেত। জার্মান সাবমেরিনের পেরিস্কোপও মাথা উঁচু করলো। একটু পরে জাপানি সাবমেরিন I-29 ভেসে উঠলো। তারপর জার্মানদেরটা। সাগরে বেশ ঢেউ আছে। সেই ঢেউয়ে ভাসানো হলো ভেলা। ভেলায় চেপে নেতাজি ও তার সেক্রেটারি জাপানি সাবমেরিনে উঠলেন। তারপর আবার জলে ডুব দিলো দুই সাবমেরিন। দুর্গম অভিযানের বড় পর্যায়টি শেষ।
জাপানি সাবমেরিন আকারে বেশ বড়। বড় কেবিন। হাঁটাচলার সুযোগ আছে। এটায় ওঠার পর নেতাজি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন, বেশ খুশি। আরো একমাস চলার পর সুমাত্রার সবংয়ে নামলেন নেতাজি আর আবিদ হাসান। মোট নব্বইদিন সাবমেরিন যাত্রা শেষে মাটিতে পা রাখলেন, সেই মাটি আবার এশিয়ার।
সিঙ্গাপুরে এসে রাস বিহারী বসুর ন্যাশনাল লীগের দায়িত্ব নেন। সিঙ্গাপুর এসে সুভাষ পুরো যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। গঠন করেন 'আজাদ হিন্দ সরকার'। সেটাই ছিল ভারতের বাইরে দেশটির প্রথম অস্থায়ী স্বাধীন সরকার। সুভাষ বসু হলেন সেই সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান এবং ৪৫ হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা আত্মসমর্পণ করলেন। তাদের নিয়ে গঠিত হল ভারতের মুক্তি বাহিনী- ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি (আইএনএ)। তিনি হলেন তার সুপ্রিম কমাণ্ডার।" এখানেও গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী। একইভাবে এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও চৌকষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। যুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য তার প্রয়োজন অনেক অর্থের। এ অঞ্চলে প্রচুর ভারতীয় বসবাস করে। সুভাষ অর্থের জন্য হাত বাড়ালেন। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, সায়গন, কুয়ালালামপুর, রেঙ্গুন, পেনাং, সাংহাই, ক্যান্টনে সভা-সমাবেশ করে ভারতীয়দের কাছে অর্থ চাইলেন। নেতাজির এ আহ্বান মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্ন জন্ম দেয়। তারা বিপুলভাবে সুভাষকে সহযোগিতা করে। যার কতটুকু সম্পদ ছিলো তা ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজির কাছে সমর্পণ করে।
সুভাষ নিজ বিশ্বাস, দর্শন ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন। তিনি আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তাই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসে, সবই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সিঙ্গাপুরের চেটিয়া সম্প্রদায় বিপুলভাবে ধনী। সম্পদের অভাব নেই তাঁদের। চেটিয়া সম্প্রদায় ঘোষণা করলেন যে, সুভাষের ভাণ্ডার পূর্ণ করে দেবে যদি তিনি তাদের মন্দিরে যান। সুভাষ রাজী হলেন এবং বললেন, তাঁর সহকর্মীদে নিয়ে সময় করে যাবেন। এতে চেটিয়ারা চমকে উঠলেন। কারণ, সুভাষের সহকর্মীদের মধ্যে আছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ নানা ধর্মের মানুষ। তারা সবাই মন্দিরে গেলে জাত-ধর্ম সবই তো শেষ হয়ে যাবে। তাই সবাইকে নিয়ে মন্দিরে যাওয়ার বিষয়ে ছেটিয়া সম্প্রদায় আপত্তি জানায়। জবাবে সুভাষও বলেন, আমার সহকর্মীরা যেখানে যেতে পারবে না, সেখানে আমিও যেতে পারি না। ওই অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। আমার কাছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই ভারতবাসী। অবশেষে চেটিয়া সম্প্রদায় রাজি হন এবং সবাইকে নিয়ে সুভাষ মন্দিরে যান।
সুভাষ সিঙ্গাপুরে এসে গঠন করা আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে এবার দিল্লি দখলের পরিকল্পনা করেন সুভাষ। শুরু হলো যুদ্ধ। আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে মিয়ানমার। পথে পথে লড়াই। প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে মণিপুরের ইম্পাল পৌঁছে যায় তাঁর বাহিনী। ইম্পাল পৌঁছার পর জাপানের পক্ষ থেকে বিমান আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। একইসাথে খাদ্য-রসদ সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। সুভাষ প্রত্যক্ষভাবেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তখন জরুরিভিত্তিতে তাঁকে সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। এ সময়ে হঠাৎ করেই জাপান আত্মসমর্পনের ঘোষণা দেয়। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে সুভাষ সিঙ্গাপুর ফিরে আসেন। মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে প্রবল চাপের মুখে সুভাষ সিঙ্গাপুর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
১৬ই আগস্ট ১৯৪৫ সকাল সাড়ে নয়টায় বিমানে চেপে বসেন সুভাষ। বিমান কোথায় যাবে উপস্থিত কেউ জানে না। শুধু বুঝা গেলো প্রকৃত যাত্রা শুরু হবে ব্যাংকক থেকে। যাবার আগে তিনি এক হুকুম নামায় লিখে গেলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে আজাদ হিন্দ প্রভেন্সিয়াল সরকারের প্রধান হবেন মেজর জেনারেল এম জেড কিয়ানি। বিকেল তিনটায় ব্যাংকক পৌঁছালেন। সেখান থেকে ১৭ই আগস্ট সহকর্মী আয়ার, কর্নেল হাবিবুর রহমান, প্রীতম সিং, গুলজার সিং, আবিদ হাসান এবং দেবনাথ দাসসহ সাইগনের উদ্দেশে যাত্রা। একটি বিমানেই যাওয়া যেতে, কিন্তু জাপান সরকারের নির্দেশে একই সাথে আরো একটি বিমান রওনা হলো। একটি বিমানে সুভাষ, কর্নেল হাবিবুর রহমান, প্রীতম সিং, আয়ার এবং জাপানি কর্নেল কিয়ানো। অন্যটিতে জেনারেল ইসোদা, মি. হাচাইয়া, গুলজার সিং, আবিদ হাসান এবং দেবনাথ দাস। বেলা ১০টায় সাইগন পৌছালেন। হঠাৎ করে জাপানি লিয়াজোঁ অফিসার এসে জানালেন, এই মুহূর্তে বিমানবন্দর থেকে একটি জাপানি বিমান ছাড়বে। একটি সিট খালি আছে। এখনই নেতাজিকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। তার সহকর্মীদের ডেকে দড়জা বন্ধ করে বৈঠক করলেন। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলেন। বিমান কোথায় যাচ্ছে, তা কেউ জানে না। নেতাজিও না। অনুরোধ করে আরেকটি সিট পাওয়া গেলো।
নেতাজি ও কর্নেল হাবিবুর বিমানে চেপে বসলেন। সাইগন থেকে হাইতো। তার আগে যাত্রবিরতি ঘটলো তুরান বিমানবন্দরে। তুরানে রাত্রি যাপন। পরদিন ১৮ই আগস্ট তুরান থেকে দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট স্যালি ৯৭.২ মডেলের বোমারু বিমানে যাত্রা। লক্ষ্য হাইতো। কিন্তু হাইতো বিমানবন্দরে নামা হলো না। সেখান থেকে ফরমোজা দ্বীপের তাইহোকু বিমানবন্দর। তাইহোকু থেকে দাইরেন। তারপর সবই ধুয়াশা। বিমানটি দুইশত ফুট উপরে ওঠার পর বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাসমূহের মধ্যে আর কোন মিল পাওয়া যায় না। তাহলে নেতাজি কী বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন? হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু সঠিক উত্তর মেলে না।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এখনও বেঁচে আছেন? নিশ্চিত হওয়ার মত অকাট্য প্রমাণ নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ১৯৪৫ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যদি মুত্যুবরণ করে থাকেন, তবে জাতিসংঘ তাঁর বিচারের জন্য ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিলো এবং পরে তা বৃদ্ধি করলো কেন? শুধু তাই নয়, ব্রিটেন-আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে, ২০২১ সালের আগে ভারত বা কারো কাছে থাকা নেতাজী সংক্রান্ত কোন নথি প্রকাশও করতে পারবে না। এমন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নেতাজীকে নিয়ে কেন এত ভয়? ব্রিটেন-আমেরিকার এমন সিদ্ধান্তে কথিত ক্ষমতাধর ভারতের কোন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রতিবাদ করেননি। তাহলে ভয়টা কি নেতাজীর প্রিয় জন্মস্থান ভারতের নেতাদের মধ্যেও রয়েছে?
হ্যাঁ, নেতাজীকে নিয়ে ভারতের নেতাদের আগাগোড়াই ভয় ছিলো। তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। ১৯৩৯ সালের কথা। ১২ই জুলাই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কংগ্রেসের সভাপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লিখিতভাবে সুভাষকে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেন। অভিযোগ, বোম্বে এআইসিসির মদ্যপান নিষিদ্ধ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন নেতাজী। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের প্রতিবাদে এ কারণ দর্শানোর নির্দেশ খরিজ হয়ে যায়।
স্বাধীনের পরও নেতাজি বিহীন ভারতে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে সুভাষ বিরোধী অনেক ঘটনা রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নির্দেশ দেন যে, ভারতের কোন থানায় নেতাজীর ছবি টাঙানো যাবে না। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর লোকসভায় প্রশ্ন উঠে, নেতাজীর আজাদ হিন্দ সরকারের বিপুল সম্পদ কোথায় গেলো? নেতাজীর আজাদ হিন্দ সরকারের কাছে বিপুল সম্পদ গোচ্ছিত ছিলো। পূর্বএশিয়ার ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দ সরকারকে তাদের সর্বস্ব তুলে দেয়। নেতাজীর অন্তর্ধানের পর সেইসব সম্পদ কোথায় গেল? কে তা ভোগদখল করছে? নাকি এসব সম্পদ ব্রিটিশ বা ভারত সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে?
আজাদ হিন্দ সরকারের ব্যাংক গভর্নর ছিলেন ইয়েলাপ্পা। যুদ্ধ শেষে নেতাজীর নির্দেশে ইয়েলাপ্পা ব্যাংকের টাকা-পয়সা, স্বর্ণ কয়েকটি বাক্সে ভরে বিমানে করে নিয়ে মিয়ানমারের (বার্মা) নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে যাচ্ছিলেন।ইয়েলাপ্পাকে বহনকারী বিমানে ব্রিটিশ বোমারু বিমান হামলা চালায়। হমালায় ইয়েলাপ্পা মারা যান এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গী গ্রেফতার হন। জানা যায়, ইয়েলাপ্পার সাথে যে সম্পদ ছিলো, তখনকার বাজার দরে তার মূল্য ছিলো সাত কোটি সাঁইত্রিশ হাজার টাকা। সব সম্পদ ব্রিটিশ জেনারেল হিউ টয়ের হাত ঘুরে নেহেরুর দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে আত্মগ্লানিতে হোক আর ভাগে কম পেয়েই হোক, জেনালের হিউ টয় নেতাজীর জীবনী রচনায় এ ঘটনা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও আরও অনেক স্থানে আজাদ হিন্দ সরকারের অর্থসম্পদ গচ্ছিত রাখা ছিলো। সে সব সম্পদও পরে বিভিন্ন উপায়ে ভারত সরকারের হাতে চলে আসে।
বিভিন্ন সময়ে ভারতের রাজনীতিতে নেতাজী আলোচনায় এসেছেন। তিনি জীবিত না মৃত তা যেমন অজানা, তেমনই অজানা থেকেছে তাঁর সরকারের সম্পদের পরিমাণ ও অবস্থান। সেই সব সম্পদ এখন ভারত সরকারের কাছে, নাকি অন্য কোন দেশে- এ নিয়ে সময়ে সময়ে ভারতের লোকসভায়ও বিতর্ক উঠেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। এমন এক বিতর্কে ১৯৮৭ সালের ৩রা আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় যে, Assets of Netaji Subhas Chandra Bose worth Rs.114 cores transferred to the Govt. of India by the Govt. of Japan, Burma and Singapore. অর্থাৎ জেনারেল হিউ টয়ের মাধ্যমে লুটপাটের পরও জাপান, মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকারের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুকানো ছিলো। স্বাধীনতার পর ওই সান তা ভারত সরকারের হাতে তুলে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এ অর্থ-সম্পদ দিয়ে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হবে। কিন্তু তা না করে নেহেরু সেই অর্থ ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংকে নিজের নামে রাখেন। ব্যাংকে রাখা এই সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়, এক লক্ষ ৪৭ হাজার ১৬৩ পাউন্ড এবং পাঁচ কিলো স্বর্ণ। লোক দেখানোর জন্য কিছু স্বর্ণ ও মাত্র ২০০ টাকা জাতীয় সংগ্রহশালায় রাখা হয়।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এই বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন দেশ স্বাধীন করার জন্য। নিজেদের রাজপরিবার পরিচয় দেওয়া একটি পরিবারও নেতাজির কিছু সম্পদ ভোগদখল করেছে। অথচ এই সম্পদের ওপর অধিকার রয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের শহিদ পরিবারগুলো। আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিবারের সৈন্যরা ভারত সরকারের কাছে বার বার পেনশনের দাবি জানিয়ে আসছে। নেতাজীর গড়ে তোলা সম্পদ থেকেই এ পেনসন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ভারত সরকার সেই পেনশনের দাবিও ফিরিয়ে দিয়েছে বার বার।
নেতাজীকে নিয়ে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের যেমন ভয় ছিল, তেমনি ভয় ছিল ব্রিটিশ শাসকদের। স্বাধীনতার পরও সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে কংগ্র্রেস নেতাদের। এখনও ভারতের শাসকদের ভয়, যদি নেতাজীর মৃত্যু না হয়ে থাকে, যদি তিনি আবার ফিরে আসেন আত্মগোপন জীবন থেকে? নেতাজী ফিরে এলেই ভারতের জনগণের কাছে তাদের মুখোশ খুলে যাবে। একইভাবে এতদিন পরও ভয় পায় বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। উন্মোচন হবে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনের ইতিহাস। ভারতের স্বাধীনতার বর্তমান নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কী ছিলো, সেই বিষয়টিও খোলাসা হয় যাবে। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের দাবির মুখে ব্রিটিশরা কি ভারত ছেড়েছে? ভরত ছেড়ে যাওয়ার জন্য কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কার্যত তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বরং কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছে। ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত দলিলের ষষ্ঠখণ্ডে ভারত স্বাধীনতার কিছু প্রমাণ রয়েছে। এ দলিলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি লিখেছেন, ‘আজাদ হিন্দ সরকার, আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধবন্দি ও বিচারকে কেন্দ্র করে সারাদেশের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনা, রাজকীয় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো, এই পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যাতীত বিকল্প পথ ছিলো না।’ ভারতের স্বাধীনতার সময়ে ক্লিমেন্ট এটলির এ লেখা সম্পর্কে ভারতবাসী জানতে পারেনি। এটলির এই বিবরণ থেকে সহজেই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ফুটে ওঠে।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সাল পর্য়ন্ত। ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট নেতাজী ঘোষণা করেছিলেন, ‘কারও দাক্ষিণ্যের ওপর ভরসা আমি কোনদিন করিনি, করবোও না। যখন আসবো, সেজন্য কারও সম্মতি, অনুমতি-এসব দরকার হবে না। ঝড়ের মতো আসবো’। এ কারণেই ভয়টা থেকেই যাচ্ছে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা ও বিশ্ব শক্তির।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বেঁচে আছেন কিনা এ বিতর্ক যুগ যুগ সজিব থাক। নেতাজী আসবে, মূর্ত না হোক, বিমূর্ত নেতাজী যুগে যুগে ফিরে আসবে মানবের মুক্তির আকাঙ্খায়। নেতাজীরা মরে না, তাঁদের হত্যা করা যায় না। তাঁরা যুগে যুগে ফিরে আসেন মানুষের মুক্তির দিসারী হয়ে।
লেখক : চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন
৪ দিন আগে২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।
৫ দিন আগেভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।
৫ দিন আগেবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা
৯ দিন আগে