ড. মনমোহন : ভারতে আর্থিক পুনর্জাগরণের স্থপতি

শাহরিয়ার শরীফ
ড. মনমোহন সিং

ড. মনমোহন সিং এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যিনি ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন। একজন নিভৃতচারী, বিনয়ী এবং বিচক্ষণ নেতা হিসেবে তিনি শুধুমাত্র অর্থনীতিবিদ হিসেবেই নয়, একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও সমাদৃত হয়েছেন।

ড. মনমোহন ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ছিলেন। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের অর্থনৈতিক উদারীকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তাঁর মৃত্যুতে ভারত সরকার সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে এবং সব ধরনের সরকারি অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। ড. সিংয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হবে।

ড. মনমোহন বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। প্রধানমন্ত্রী পদে তারই উত্তরসূরি, দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাত ১০টা ৩৭ মিনিটে টুইট করে এ খবর জানান। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তার স্ত্রী গুরচরণ সিং এবং তিন কন্যা আছেন।

১৯৯১ সালে, যখন ভারত অর্থনৈতিকভাবে সংকটের সম্মুখীন, ড. সিং ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময়ে ভারত আর্থিকভাবে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা এতটাই ভারী হয়ে পড়েছিল যে দেশের সোনা বিদেশে বন্ধক রাখতে হয়।

এ অবস্থায় ড. সিংয়ের নেতৃত্বে গৃহীত আর্থিক সংস্কার পরিকল্পনা ভারতকে নতুন দিশা দেখিয়েছিল। কর হ্রাস, সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ, এবং বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করার মতো উদ্যোগ ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে।

তাঁর প্রথম বাজেট ভাষণে ভিক্টর হুগোর উদ্ধৃতি—“যদি একটি ভাবনার সময় এসে যায়, তাকে কোনো শক্তিই থামাতে পারে না”—শুধু একটি উক্তি নয়, বরং ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের দিশারী হিসেবে তাঁর সংকল্পের প্রকাশ।

২০০৪ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। শিক্ষাবিদ এবং আমলাতান্ত্রিক পটভূমি থাকা সত্ত্বেও, ড. সিং রাজনীতির মাঠে যোগদান করেন কংগ্রেসের নির্দেশনায়। তাঁর নেতৃত্বে ভারত বিশ্বের দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। বৈদ্যুতিক উৎপাদন, পরিকাঠামো উন্নয়ন, এবং কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি তাঁর সরকারের সফল উদ্যোগগুলির মধ্যে অন্যতম।

ড. সিংয়ের প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় ভারতের পারমাণবিক চুক্তি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তি ভারতকে একটি পারমাণবিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের মর্যাদা বাড়ায়।

ড. সিংয়ের শাসনামলে তাঁর ব্যক্তিগত সততা এবং পেশাদারিত্ব তাঁকে বিশেষ সম্মান এনে দেয়। তিনি সবসময় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। তবে, তাঁর নীরব এবং নম্র স্বভাবের জন্য তাঁকে সমালোচনা শুনতে হয়েছে, বিশেষত যখন দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদকালে সামনে আসে।

তাঁর সমালোচকদের দাবি ছিল, তিনি ‘নির্বাক’ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ড. সিং সবসময়ই কাজ দিয়ে তাঁর জবাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, "হাজার শব্দের চেয়ে নীরবতা অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে।"

ড. সিং একজন বাস্তববাদী আন্তর্জাতিক নীতি প্রণেতা ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেন এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক পথ খুলে দেন। মুম্বাই হামলার মতো ঘটনাগুলি তাঁর শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বাধাগ্রস্ত করলেও, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাঁর অবদান অমলিন।

ব্যক্তিজীবনে ড. সিং ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ এবং সাদামাটা। পরিবারের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং বিনয় তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। তাঁর কন্যার লেখনীতে উঠে এসেছে তাঁর কৃচ্ছ্রসাধনের গল্প। বিলাসিতা নয়, পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।

ড. মনমোহন সিংয়ের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, তাঁর অর্থনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব অস্বীকার করা অসম্ভব। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে ভারতের আর্থিক পুনর্জাগরণের একজন স্থপতি হিসেবে।

তাঁর নিজস্ব কথায়, ‘ইতিহাস হয়তো সমসাময়িক সমালোচনার তুলনায় আমার প্রতি সদয় হবে।’ এটি এক নিঃসন্দেহে সত্য যে ড. সিং ভারতের জন্য যে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

ড. মনমোহন সিং ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম। তাঁর দূরদর্শিতা এবং সততা দেশকে শুধু আর্থিক সংকট থেকে রক্ষা করেনি, বরং একটি শক্তিশালী, প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির ভিত তৈরি করেছে। তাঁর শান্ত স্বভাব এবং সিদ্ধান্তমূলক নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে যে সাহস সবসময় গলার জোরে মাপা যায় না; সেটি কাজের গভীরতায় প্রতিফলিত হয়।

যেখানে অনেক নেতা নিজেদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ গড়তে ব্যস্ত, সেখানে ড. সিং চুপচাপ দেশগড়ার কাজে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। হয়তো একদিন, ভবিষ্যতের আলোচনায় তাঁর অবদানকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করা হবে।

ড. সিংয়ের জীবন এবং কাজের এই মূর্ত গল্পটি আমাদের একটি বার্তা দিয়ে যায়—সফল নেতৃত্ব মানে শুধু ক্ষমতা নয়, তা হলো দায়িত্ব এবং দেশপ্রেম। আর এ কারণেই ইতিহাস ড. মনমোহন সিংকে এক অর্থনৈতিক বিপ্লবীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে