বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নয় হত্যা?

শরিফুল হাসান
ভবনের আগুন নেভাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় আগুনে ৪৪ জন মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়ে যারা ঘুমাতে গিয়েছেন কিংবা সকালে ঘুম ভাঙার পর যারা ৪৪ জন মানুষের মৃত্যুর খবর শুনেছেন জানি না তাদের মনের অবস্থা কী! এতগুলো মানুষের মৃত্যুতে আমার মতোই হয়তো ছটফট করছেন। কিন্তু যে পরিবারগুলোর স্বজনেরা চলে গেলো তাদের মনের অবস্থাটা ভাবুন!

আমি তো স্তব্ধ হয়ে যাই। এই শহরের ৪৪ জন মানুষ, কেউ বুয়েটের ছাত্র, কেউ জগন্নাথের, কেউ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, কেউ বিদেশে থেকে ছুটিতে এসেছেন, নানা অয়োজনে যারা বৃহস্পতিবার রাতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাইরে খেতে গিয়েছিল, তাদের সেই আনন্দের রাতটা পরিণত হলো অনন্ত বিষাদের রাতে।

এই মৃত্যুর তালিকায় তো থাকতে পারতাম আমি, আপনি যে কেউ। কারণ এই শহরে বাইরে খেতে যাওয়া ছাড়া মধ্যবিত্তের জীবনে খুব বেশি বিকল্পও তো নেই! তাহলে এই রেস্তোরাঁগুলো কেন নিরাপদ হবে না? এগুলো যাদের দেখার কথা তারা কোথায় ঘুমাচ্ছিলেন এতদিন? এসব কারণেই আমি এগুলোকে আর এখন দুর্ঘটনা বলি না, এগুলো হত্যাকাণ্ড!

এই দেশে আপনি খেতে গিয়ে মরবেন, হাসপাতালে সুন্নতের খতনা করতে গিয়ে মরবে আপনার শিশু, এন্ডোসকপি করতে গিয়ে মরবে ভাই, বাস দুর্ঘটনা, ট্রেনে আগুন কিংবা ভবনের আগুনে মারা যাবে সাধারণ মানুষ, গার্মেন্ট বা কারখানায় মরবে শ্রমিক। এই দেশে প্রতিদিন কেউ না কেউ কোথাও নানা অবহেলায় মরবেই।

এই যে বেইলি রোডের ঘটনার পর এখন তদন্ত কমিটি থেকে শুরু করে নানা আলোচনা শুনবেন। ভীষণ কষ্ট লাগে। সাংবাদিক হিসেবে গত দুই যুগে কতো যে দুর্ঘটনা আর কতো যে লাশ দেখেছি!

সাভারের নিশ্চিন্তপুর মাঠে তাজরীন ফ্যাশনের পুড়ে যাওয়া ১১১ শ্রমিকের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশ সারি সারি করে রাখা ছিল। লাশ না কঙ্কাল, বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসম শরীরের কানে সোনার দুল দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজবাড়ীর মোহাম্মদ শোয়েব। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, এটাই তার স্ত্রী শিউলির লাশ। সোনার এই দুলটা তিনি স্ত্রীকে কিনে দিয়েছিলেন।

আমি সেই কান্না কখনো ভুলিনি। আজকেও ফের সেই আহাজারি! কতো যে মৃত্যু দেখলাম দুই যুগে! বহুবার লিখেছি এই দেশে বাস বা লঞ্চের যেকোনো দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে সন্তানের মৃত্যুর পর জানা যায় হাসপাতালের অনুমোদন নেই। আগুন লাগার পর জানা যায় ভবনের অনুমোদন নেই। আগামী কয়েকদিন আপনারা শুনবেন কীভাবে এক ভবনে এতোগুলো রেস্তোঁরা হলো? কীভাবে তারা অনুমোদন পেল? বারবার এমন হয়।

বাস্তবে হাসপাতালে অবহেলায় মৃত্যু বলেন, ভবনে আগুন, বাস দুর্ঘটনা কিংবা প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা! এগুলো দেখার জন্য নানা কর্তৃপক্ষ ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা বা মানুষ মরে যাওয়ার আগে কারো হুঁশ হয় না।

কিন্তু অনেকগ মানুষ মরে যাওয়ার পর শুনবেন তদন্ত কমিটি, শুনবেন ভবন নির্মাণে ত্রুটি, অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা নেই, এই অনুমোদন ছিলো না, সেই অনুমোদন ছিলো না আরো কী! অথচ এসব দেখার জন্য রাজউক বলেন, বিআরটিএ বলেন, ওয়াসা বলেন, তিতাস বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেন কতো যে সরকারি সংস্থা আর মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থার সবাই যেন ঘুমায়! সেখানে গড়ে ওঠে দুর্নীতির পাহাড়। তাই দায়িত্ব অবহেলায় কারো শাস্তি হয় না! বরং প্রতিবারই ঘটনার পর নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়, নানা আলোচনা হয়, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোনো দুর্ঘটনার!

আচ্ছা স্বাধীনতার তো ৫৩ বছর হলো! এভাবে আর কতদিন চলবে? স্বজন হারাদের এই আর্তনাদ আর কতোকাল চলবে? আর কতো মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে? আর কবে সুশাসন আসবে? আচ্ছা আর কতো শতো মানুষ মরলে, এই শহরটা কতোটা ধ্বংস হলে নীতি নির্ধারকদের বোধ জাগবে? আর কতো শত মানুষ মরলে তদারকি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা আসবে?

এই যে ঢাকা শহরটাকে আমরা মেরে ফেলছি, ধ্বংস করছি পুরো দেশ এর শেষ কোথায়? আমি বিশ্বাস করি, নীতি নির্ধারকের চাইলে, আমরা সবাই মিলে চাইলে এই দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন, প্রয়োজন জবাবদিহি।

আপনারা যারা দেশ চালান, আপনারা যারা ক্ষমতাবান, আপনারা যারা নীতি নির্ধারক, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলি, উন্নয়ন অনেক হয়েছে, এবার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন প্রতিটা খাতে। ভবন বলেন, রাউজক বলেন, লাখ লাখ সিলিন্ডার গাড়িতে বাড়িতে, পরিকল্পনাহীন শহর, ভবন এগুলো বন্ধ করুন। এই দেশটা আমাদের! যারা মারা যাচ্ছে তারা আমাদের স্বজন। কাজেই চলেন সবাই মিলে দেশটাকে ঠিক করি। আপনাদের দোহাই লাগে জেগে উঠুন! এই বোধ ছাড়া এই দেশকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই! কাজেই আল্লাহ তুমি আমাদের বোধ দাও, বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদের! [লেখকের ফেসবুক থেকে]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে