বিজয়ের মাসে বীরের গলায় জুতার মালা!

শাহরিয়ার শরীফ

বিজয়ের মাসে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুর ওপর যা ঘটেছে, তা নিন্দনীয়। যারা জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, স্বাধীন দেশে তাদের এমন অপমান ও নির্যাতন খুবই কষ্টের।

এই মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার ঘটনার দেড় মিনিটের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই কাজ যারা করেছে তারা স্থানীয় জামায়াতের নেতাকর্মী বলে পরিচিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার দায় থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা বা চর্চা করছে। এর মধ্যে এমন কাণ্ড আবারও দলটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। যদিও একাধিক মাধ্যমে জামায়াত নেতারা বলেছেন, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দলটি।

৭৯ বছর বয়সী আব্দুল হাই বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিনি মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই তাকে ছুরি ধরে গলায় জুতার মালা দিয়ে অসম্মান করা হয়েছে।

“আমি এবং আমার ছেলে নয় বছর 'সাবেক এক মন্ত্রী'র কারণে এলাকায় থাকতে পারিনি। জামায়াতের কারও সাথে কখনো আমার কোনো ঝামেলা হয়নি। এরপরেও তারা আমাকে অসম্মান করেছে মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণেই,” বলছিলেন তিনি।

ভিডিওতে দেখা যায়, বিশ-পঁচিশজন লোক তাঁকে ঘিরে আছেন এবং কয়েকজন লোক তাঁকে পুরো গ্রামবাসীর কাছে মাফ চেয়ে এলাকা ছাড়ার দাবি তোলেন।

ব্যক্তি, গোষ্ঠী, এমনকি রাষ্ট্র-যে কোনো নাগরিকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার এখতিয়ার রাখে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্যক্তির মর্যাদার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এখন যখন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা এভাবে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত হতে পারেন, তখন সাধারণ নাগরিকের মর্যাদা কতটা সুরক্ষিত, বলাই বাহুল্য।

আবদুল হাই কানুউপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সদস্য। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলেও তিনি বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে তখন হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ছয়-সাত বছর গ্রামছাড়া ছিলেন।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এবং আওয়ামী লীগের পতনের পর–দুই আমলেই তিনি নির্যাতনের শিকার হলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হয়।

আওয়ামী লীগ আমলেও অনেকে, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ বিভিন্ন পর্যায়ে অত্যচার ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। বিরোধী নেতা-কর্মীদের অনেকে তো ঘরে থাকতে পারেননি। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা আওয়ামী লীগের পতনের পরও অব্যাহত থাকবে কেন?

আবদুল হাই কানুর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আমলে এলাকার অনেকের ওপর নির্যাতন ও জবরদস্তি চালানোর অভিযোগ রয়েছে। এগুলো যদি সত্যও হয়, সেজন্য আইন ও আদালত রয়েছে। ভুক্তভোগীরা আইনি প্রতিকারের জন্য পুলিশের কাছে বা আদালতে যেতে পারতেন। কিন্তু কেউ অপরাধ করলে তার বিচারের দায়িত্ব কোনো সাধারণ ব্যক্তি নিতে পারে না। রাষ্ট্র এ এখতিয়ার তাদের দেয়নি।

এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইকে লাঞ্ছনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।স্থানীয় পুলিশকে উদ্ধৃত করে প্রেস উইং জানায়, আব্দুল হাই হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি। পুলিশ বলেছে, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

আমরা দেখতে চাই, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা হয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করে, পুলিশ ও প্রশাসন আন্তরিক হলে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সদিচ্ছা থাকলে অপরাধীদের পালিয়ে বাঁচার সুযোগ নেই। বিজয়ের মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান দেখাতে না পারলেও অপমান করার অধিকার কারও নেই। আব্দুল হাইসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সশ্রদ্ধ সালাম। নিকৃষ্ট ও বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে যেনো শুভবুদ্ধির উদয় হয়।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে