জান্নাতুল বাকেয়া কেকা
যেকোনো কোটা ব্যবহার করা হয় অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ভাগ্য উন্নয়নে। তা হতে পারে অঞ্চলভিক্তিক সমতা আনতে কিংবা নারী ও পুরুষ সমতার ভিত্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য ও বঞ্চনা কমাতে। সেই ধারায় সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি চালু করে শহীদ, যুদ্ধাহত, অসহায়, বিশেষ করে শহরের সুবিধাবঞ্চিত নাগরিক সমাজের তুলনায় পিছিয়ে পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমানের উন্নয়নে তাদের সন্তানদের খানিক এগিয়ে নিতেই কোটার ব্যবস্থা করা হয়।
সময়ের পরিক্রমায় শহরের নানান সুযোগসুবিধার বাইরে দেশের ৬৮ হাজার গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্তের কজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান স্বাধীনতার ৫২ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে দিনভর মুক্তিযুদ্ধ কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে তাদের কেউই সেই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে পারেননি। বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে গো ধরেছেন।
তাদের যখন বলা হলো, ১৯৭১-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিকসের মতো কঠিন সাবজেক্টে তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী যুদ্ধে গেলেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসারির যুদ্ধে বাম হাতের কবজি হারিয়ে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইতে জিতে ফেরেন। পরবর্তীতে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গ ছাড়াই লেখাপড়া সম্পন্ন করেন, স্থানীয় কলেজে শিক্ষকতা করে জীবন পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পাওয়া সেই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন সেটা কী তার প্রাপ্য না বরং এটাকে বৈষম্য বলবেন তিনি? এই প্রশ্নের কোনো জবাব আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দিতে পারেননি।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগে মেধাশূন্য প্রশাসন?
মুক্তিযুদ্ধ কোটাবিরোধীরা এবারের আন্দোলনে আরেকটি জোর অভিযোগ তুলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ নাকি প্রশাসনকে মেধাশূন্য করে তুলেছে। তাদের একথাটির মানে দাঁড়ায় প্রশাসনের বেশির ভাগই মেধাহীন। তবে মজার বিষয়, আজকের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যারা চালাচ্ছেন তাদের সবাই কী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত? কী অদ্ভুত একপেশে মগজ ধোলাই করা তথ্য না!
মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োগ প্রযোজ্য হয় কখন?
এবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতির বাস্তবিত প্রয়োগ প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করি। বলা হচ্ছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক বিসিএস (ক্যাডার, নন-ক্যাডার) ছাড়াও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার তরুণ চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পায় চরম যোগ্যতার মাপকাঠিকে পাস করেই। এদের মধ্যে বিসিএস (ক্যাডার) দিয়ে বিভিন্ন পদে চাকরির আবেদনকারীদের সবাইকেই পরীক্ষায় প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়ার নির্বাচিত হতে হয়। শিক্ষার্থীরা এরপর মুখোমুখি হন লিখিত পরীক্ষার। এভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে প্রাথমিক বাছাই, লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যদিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে সর্বশেষ ভাইভার মুখোমুখি হন। তবেই চূড়ান্ত ধাপে সরকারি ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
এক্ষেত্রে সব সাধারণ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীর মতই একজন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদনকারীকেও প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়া-‘প্রিলিমিনারিতে’ টিকে তবেই লিখিত পরীক্ষায় বসতে হয়। সেই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীরা ভাইভার যাবার সুযোগ পান এবং প্রস্তুতি নেন। আর এই ভাইভার পরে গিয়েই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদনকারী চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীর জন্য সংরক্ষিত কোটার প্রায়োগিক ব্যবহার প্রযোজ্য হয়। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রশাসনে যদি কোনো চাকরিপ্রাথী শিক্ষার্থী/আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পান তবে তিনি কী ভিন্ন বা আলাদা কোনো প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাচ্ছেন? তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ ‘প্রশাসকে কিভাবে মেধাহীন প্রশাসনের’ জন্ম দিচ্ছে সেই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গের অবতাড়না করেছেন আজকের আন্দোলনকারীরা? মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা মেধাহীন আর এই কোটায় নিয়োগ মেধাশূন্য করছে এই বক্তব্যের উত্থান হলো কীভাবে? কারা করলেন সেই তারা কারা ? তাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে এতটা অ্যালার্জি কেন? তাদের শনাক্ত করা আজ খুবই জরুরি।
এক্ষেত্রে আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দাবি করা সুশীলসমাজ কেন নিরব ও নিশ্চুপ? যারা ত্যাগ ও শ্রম দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করলেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের মেধাহীন তকমা দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে কী বার্তা দিতে চাই সেই বিষয়টি পরিষ্কার করার দায় কী স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির কোনো তাগিদ নেই কেন?
মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুললে কী বেকারত্ব ঘুচবে?
আবার ধরেই নিলাম ক্যাডার, নন-ক্যাডার, স্বায়ত্তশাসিত মিলিয়ে যে ৫ হাজার শিক্ষার্থী চাকরি পেলেন এর মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির সুযোগ পেলেন-সেই হিসেবটা যদি ৩০ শতাংশ কোটা ধরেই করি তাহলে সাড়ে ৩ হাজার চাকিরি পেলেন তথাকথিত মেধাবী তরুণ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা। বাবি দেড় হাজার জন আসলেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। তারপরও তো দেশে ৫ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী-প্রার্থীর মধ্যে চাকরিবঞ্চিত থাকলেন ৪ লাখ ৯৫ হাজার জন। এখন যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলেই দেওয়া হয় তাতে কী এই বিপুল সংখ্যক বেকার চাকরিপ্রার্থীর রাতারাতি চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে?
দেশে বেকারত্ব ঘোচাতে এই বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী তরুণদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে কার্যকর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দায় কাদের? সেই তারা এদেশে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের নতুন ব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্র, সরকার ও সংশ্লিষ্টরা কী করছে সেই কল্যাণকর দাবি ও জবাবদিহিতা কেন চাইছে না আজকের কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী তরুণেরা। বরং যে ভিত্তির ওপর এদেশ স্বাধীন হলো সেই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মত পবিত্র শব্দগুলোকে যখন তখন যেখানে সেখাবে ব্যবহার করে নতুন প্রজন্ম ও স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধ দিনে ভয়াবহতা দেখেনি শোনেনি, যারা শহরের নানান নাগরিক সুযোগ সুবিধায় বেড়ে উঠেছেন সেই তরুণদের পথভ্রষ্ট করছে। এতে কারা লাভবান হচ্ছেন-? তারাতো সেই পুরোনো পাপি একাত্তরের পরাজিত শক্তিই।
যে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি ক্ষমতায় আসার পর উল্লেখিত শব্দগুলোকে যেনতেনভাবে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে বিষিয়ে তুলেছে। এরই ফলাফল আজকের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নিয়ে গা-জ্বলুনির আজকের অবস্থান।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে অপদস্থ হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা!
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শব্দগুলো আজ অক্কা পেয়ে নিরবে নয়, সরোবেই কাঁদছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে স্বাধীনতা অর্জনের সেই বীরসেনানি ১৯৭১’র মুক্তিকামী মূল্যবোধের বলে বলীয়ান কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পিষ্ট সাধারণ আমজনতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে খুব অবুঝ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে। সেই ২০১৮ সালে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলন করে আগেই জাতীয় নেতা বনেছেন। এবারের আন্দোলনেও নতুন কয়েক মুখ নেতা হবার দৌড়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে শামিল হয়েছেন।
যে পাতি নেতারা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তার বিচার বিশ্লেষণ করার সুযোগ না দিয়েই স্বাধীনতাবিরোধী ৭১’র পরাজিত শক্তির পুরোনো মনোভাবে ধাবিত করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের নানান অপশক্তির অপচেষ্টাও। তবে হালের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের দুর্নীতি পরায়ন এক অপশক্তির অন্ধকারের খেলা যেন জমে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ কোটাবিরোধী এবারের আন্দোলনে। কারণ কদিন আগেও গণমাধ্যমে মূল ইস্যুই ছিল দুর্নীতিতে অঢেল সহায়সম্পদ ও মুখরোচক গল্পগাঁথা। দুর্নীতির হালচালের চালচিত্রে বেরিয়ে পড়েছিল থলের বিড়ালের কালো থাবা।
এসবই আড়াল করে ইস্যু বদলের পরিক্রমায় হঠাৎ সামনে আসে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি। এখনো তো এই কোটাবিরোধী বিষয়টি হট ইস্যু। মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টির অসম্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম। এর পেছনে রাষ্ট্রীয় ইন্ধনও যে রয়েছে তা স্পষ্ট। কেননা রাষ্ট্র পরিচালক ও ক্ষমতাসীন একটি দল যখন তাদের মেয়াদে তাদেরই মদদপুষ্ট লোকদের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয় তখন লজ্জার দায় এড়ানো নতুন ইস্যুতে মাঠ গরম করার কোনো বিকল্প আছে কী? এমন অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের স্বরুপ উন্মোচিত হয় তখন রাষ্ট্রেরও প্রয়োজন হয় ইস্যু বদলের। আর তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে বীরদের অপদস্থ করছে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীরা।
জান্নাতুল বাকেয়া কেকা, সিনিয়র সাংবাদিক
যেকোনো কোটা ব্যবহার করা হয় অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ভাগ্য উন্নয়নে। তা হতে পারে অঞ্চলভিক্তিক সমতা আনতে কিংবা নারী ও পুরুষ সমতার ভিত্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য ও বঞ্চনা কমাতে। সেই ধারায় সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি চালু করে শহীদ, যুদ্ধাহত, অসহায়, বিশেষ করে শহরের সুবিধাবঞ্চিত নাগরিক সমাজের তুলনায় পিছিয়ে পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমানের উন্নয়নে তাদের সন্তানদের খানিক এগিয়ে নিতেই কোটার ব্যবস্থা করা হয়।
সময়ের পরিক্রমায় শহরের নানান সুযোগসুবিধার বাইরে দেশের ৬৮ হাজার গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্তের কজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান স্বাধীনতার ৫২ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে দিনভর মুক্তিযুদ্ধ কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে তাদের কেউই সেই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে পারেননি। বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে গো ধরেছেন।
তাদের যখন বলা হলো, ১৯৭১-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিকসের মতো কঠিন সাবজেক্টে তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী যুদ্ধে গেলেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসারির যুদ্ধে বাম হাতের কবজি হারিয়ে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইতে জিতে ফেরেন। পরবর্তীতে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গ ছাড়াই লেখাপড়া সম্পন্ন করেন, স্থানীয় কলেজে শিক্ষকতা করে জীবন পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পাওয়া সেই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন সেটা কী তার প্রাপ্য না বরং এটাকে বৈষম্য বলবেন তিনি? এই প্রশ্নের কোনো জবাব আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দিতে পারেননি।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগে মেধাশূন্য প্রশাসন?
মুক্তিযুদ্ধ কোটাবিরোধীরা এবারের আন্দোলনে আরেকটি জোর অভিযোগ তুলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ নাকি প্রশাসনকে মেধাশূন্য করে তুলেছে। তাদের একথাটির মানে দাঁড়ায় প্রশাসনের বেশির ভাগই মেধাহীন। তবে মজার বিষয়, আজকের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যারা চালাচ্ছেন তাদের সবাই কী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত? কী অদ্ভুত একপেশে মগজ ধোলাই করা তথ্য না!
মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োগ প্রযোজ্য হয় কখন?
এবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতির বাস্তবিত প্রয়োগ প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করি। বলা হচ্ছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক বিসিএস (ক্যাডার, নন-ক্যাডার) ছাড়াও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার তরুণ চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পায় চরম যোগ্যতার মাপকাঠিকে পাস করেই। এদের মধ্যে বিসিএস (ক্যাডার) দিয়ে বিভিন্ন পদে চাকরির আবেদনকারীদের সবাইকেই পরীক্ষায় প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়ার নির্বাচিত হতে হয়। শিক্ষার্থীরা এরপর মুখোমুখি হন লিখিত পরীক্ষার। এভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে প্রাথমিক বাছাই, লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যদিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে সর্বশেষ ভাইভার মুখোমুখি হন। তবেই চূড়ান্ত ধাপে সরকারি ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
এক্ষেত্রে সব সাধারণ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীর মতই একজন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদনকারীকেও প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়া-‘প্রিলিমিনারিতে’ টিকে তবেই লিখিত পরীক্ষায় বসতে হয়। সেই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীরা ভাইভার যাবার সুযোগ পান এবং প্রস্তুতি নেন। আর এই ভাইভার পরে গিয়েই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদনকারী চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীর জন্য সংরক্ষিত কোটার প্রায়োগিক ব্যবহার প্রযোজ্য হয়। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রশাসনে যদি কোনো চাকরিপ্রাথী শিক্ষার্থী/আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পান তবে তিনি কী ভিন্ন বা আলাদা কোনো প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাচ্ছেন? তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ ‘প্রশাসকে কিভাবে মেধাহীন প্রশাসনের’ জন্ম দিচ্ছে সেই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গের অবতাড়না করেছেন আজকের আন্দোলনকারীরা? মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা মেধাহীন আর এই কোটায় নিয়োগ মেধাশূন্য করছে এই বক্তব্যের উত্থান হলো কীভাবে? কারা করলেন সেই তারা কারা ? তাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে এতটা অ্যালার্জি কেন? তাদের শনাক্ত করা আজ খুবই জরুরি।
এক্ষেত্রে আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দাবি করা সুশীলসমাজ কেন নিরব ও নিশ্চুপ? যারা ত্যাগ ও শ্রম দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করলেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের মেধাহীন তকমা দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে কী বার্তা দিতে চাই সেই বিষয়টি পরিষ্কার করার দায় কী স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির কোনো তাগিদ নেই কেন?
মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুললে কী বেকারত্ব ঘুচবে?
আবার ধরেই নিলাম ক্যাডার, নন-ক্যাডার, স্বায়ত্তশাসিত মিলিয়ে যে ৫ হাজার শিক্ষার্থী চাকরি পেলেন এর মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির সুযোগ পেলেন-সেই হিসেবটা যদি ৩০ শতাংশ কোটা ধরেই করি তাহলে সাড়ে ৩ হাজার চাকিরি পেলেন তথাকথিত মেধাবী তরুণ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা। বাবি দেড় হাজার জন আসলেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। তারপরও তো দেশে ৫ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী-প্রার্থীর মধ্যে চাকরিবঞ্চিত থাকলেন ৪ লাখ ৯৫ হাজার জন। এখন যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলেই দেওয়া হয় তাতে কী এই বিপুল সংখ্যক বেকার চাকরিপ্রার্থীর রাতারাতি চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে?
দেশে বেকারত্ব ঘোচাতে এই বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী তরুণদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে কার্যকর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দায় কাদের? সেই তারা এদেশে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের নতুন ব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্র, সরকার ও সংশ্লিষ্টরা কী করছে সেই কল্যাণকর দাবি ও জবাবদিহিতা কেন চাইছে না আজকের কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী তরুণেরা। বরং যে ভিত্তির ওপর এদেশ স্বাধীন হলো সেই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মত পবিত্র শব্দগুলোকে যখন তখন যেখানে সেখাবে ব্যবহার করে নতুন প্রজন্ম ও স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধ দিনে ভয়াবহতা দেখেনি শোনেনি, যারা শহরের নানান নাগরিক সুযোগ সুবিধায় বেড়ে উঠেছেন সেই তরুণদের পথভ্রষ্ট করছে। এতে কারা লাভবান হচ্ছেন-? তারাতো সেই পুরোনো পাপি একাত্তরের পরাজিত শক্তিই।
যে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি ক্ষমতায় আসার পর উল্লেখিত শব্দগুলোকে যেনতেনভাবে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে বিষিয়ে তুলেছে। এরই ফলাফল আজকের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নিয়ে গা-জ্বলুনির আজকের অবস্থান।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে অপদস্থ হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা!
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শব্দগুলো আজ অক্কা পেয়ে নিরবে নয়, সরোবেই কাঁদছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে স্বাধীনতা অর্জনের সেই বীরসেনানি ১৯৭১’র মুক্তিকামী মূল্যবোধের বলে বলীয়ান কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পিষ্ট সাধারণ আমজনতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে খুব অবুঝ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে। সেই ২০১৮ সালে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলন করে আগেই জাতীয় নেতা বনেছেন। এবারের আন্দোলনেও নতুন কয়েক মুখ নেতা হবার দৌড়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে শামিল হয়েছেন।
যে পাতি নেতারা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তার বিচার বিশ্লেষণ করার সুযোগ না দিয়েই স্বাধীনতাবিরোধী ৭১’র পরাজিত শক্তির পুরোনো মনোভাবে ধাবিত করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের নানান অপশক্তির অপচেষ্টাও। তবে হালের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের দুর্নীতি পরায়ন এক অপশক্তির অন্ধকারের খেলা যেন জমে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ কোটাবিরোধী এবারের আন্দোলনে। কারণ কদিন আগেও গণমাধ্যমে মূল ইস্যুই ছিল দুর্নীতিতে অঢেল সহায়সম্পদ ও মুখরোচক গল্পগাঁথা। দুর্নীতির হালচালের চালচিত্রে বেরিয়ে পড়েছিল থলের বিড়ালের কালো থাবা।
এসবই আড়াল করে ইস্যু বদলের পরিক্রমায় হঠাৎ সামনে আসে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি। এখনো তো এই কোটাবিরোধী বিষয়টি হট ইস্যু। মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টির অসম্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম। এর পেছনে রাষ্ট্রীয় ইন্ধনও যে রয়েছে তা স্পষ্ট। কেননা রাষ্ট্র পরিচালক ও ক্ষমতাসীন একটি দল যখন তাদের মেয়াদে তাদেরই মদদপুষ্ট লোকদের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয় তখন লজ্জার দায় এড়ানো নতুন ইস্যুতে মাঠ গরম করার কোনো বিকল্প আছে কী? এমন অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের স্বরুপ উন্মোচিত হয় তখন রাষ্ট্রেরও প্রয়োজন হয় ইস্যু বদলের। আর তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে বীরদের অপদস্থ করছে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীরা।
জান্নাতুল বাকেয়া কেকা, সিনিয়র সাংবাদিক
স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন
৪ দিন আগে২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।
৫ দিন আগেভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।
৫ দিন আগেবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা
৯ দিন আগে