ধর্মীয় চরমপন্থা উত্থানের মহড়া!

শাহরিয়ার শরীফ
সম্প্রতি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল টিমের খেলা আয়োজন করায় ঘেরাও করা টিনের বেড়া ভাঙচুর করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি বাংলাদেশে একের পর এক জনতা-উত্তেজিত হামলার ঘটনা ঘটছে, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে নারীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শোবিজ তারকাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।

এসব ঘটনায় প্রশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলছে।

গত কয়েক মাসে চট্টগ্রামে অভিনেত্রী মেহজাবীন, টাঙ্গাইলে পরীমনি ও ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে অপু বিশ্বাস শোরুম বা রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করতে পারেননি।

জয়পুরহাট ও দিনাজপুরে নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করা হয়েছে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের চাপে। বিশ্ব সুফী সংস্থা অভিযোগ করেছে, গত ছয় মাসে ৮০টিরও বেশি মাজার ও দরবারে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পেছনে ‘তৌহিদী জনতা’ বা বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের নাম উঠে আসছে, কিন্তু তারা কোনো সংগঠনের সদস্য কিনা, সে বিষয়ে প্রশাসন স্পষ্টভাবে কিছু বলছে না।

স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, হামলাকারীরা সাধারণত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য বা সমর্থক।

নারীদের খেলাধুলাকে বারবার টার্গেট করা হচ্ছে। জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ফুটবল ম্যাচগুলোতে হামলাকারীরা ‘পর্দার বিধান’ লঙ্ঘনের অজুহাত দেখিয়েছে। এই মানসিকতা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণের জন্য এক বড় বাধা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, যা দেশের জন্য গর্বের বিষয়। অথচ এই খেলোয়াড়দের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে। প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আরও কমে যাবে।

বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও বিনোদন জগতেও ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রভাব বাড়ছে। সম্প্রতি অপু বিশ্বাস, পরীমনি ও মেহজাবীনের বিরুদ্ধে হওয়া বাধাগুলো প্রমাণ করে যে, মৌলবাদীরা এখন বিনোদন জগতের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

এর আগে হেফাজতে ইসলাম বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বইমেলা ও মাজারসংক্রান্ত উৎসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এখন তারা সিনেমা, নাটক ও শোবিজ তারকাদের কার্যক্রমকেও ‘অনৈতিক’ বলে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ।

- নারী ফুটবল ম্যাচে হামলার পর জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের পুলিশ এখনও কোনো মামলা নেয়নি।

- কামরাঙ্গীরচরে অপু বিশ্বাসের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে পুলিশ হামলাকারীদের দমনের বদলে উদ্বোধন অনুষ্ঠান থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেয়।

- মাজার ও দরবারে হামলার ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা মৌলবাদীদের আরও উৎসাহিত করছে।

এই নিষ্ক্রিয়তা মৌলবাদী শক্তিকে আরও উৎসাহিত করছে। তারা বুঝতে পারছে যে, চাপ সৃষ্টি করলেই প্রশাসন পিছু হটবে এবং তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে।

রাষ্ট্রের উচিত এসব হামলার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা। বিশেষত, নারীদের খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।

নারীদের খেলাধুলা, সিনেমা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা উচিত। বড় খেলাধুলার ইভেন্ট বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলাদা নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো দরকার। বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রকৃত চেহারা জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে।

বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের স্বাধীনতা খর্ব করছে, তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

নারীদের খেলাধুলা ও বিনোদন জগতে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মেয়েদের জন্য আরও বেশি ক্রীড়া একাডেমি ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মৌলবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য বড় হুমকি। প্রশাসন যদি এসব হামলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে নারীদের আরও বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হবে।

রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে ধর্মীয় গোঁড়ামির নামে নারীদের অধিকার খর্ব করার অপচেষ্টা সফল না হয়। নারীদের স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এতদিন প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে উগ্রপন্থীরা লাগাতার সন্ত্রাস চালিয়ে গেলেও, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে সরকার অবশেষে কিছু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং যারা বাধা দিয়েছে, তাদের কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছে।

প্রফেসর ইউনূস দীর্ঘদিন ধরেই নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ৯০ শতাংশেরও বেশি মালিকানা ছিল নারীদের হাতে, যা দেখিয়েছে যে সমাজে নারীদের ক্ষমতায়ন সম্ভব।

“নারীরা বাংলাদেশের নাগরিক এবং পুরুষদের মতোই সমানভাবে মানবিক ও নাগরিক অধিকার ভোগ করে,”—এক বিবৃতিতে বলেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ইতোমধ্যে দিনাজপুর এবং জয়পুরহাট জেলা প্রশাসনকে স্থগিত ফুটবল ম্যাচ পুনরায় চালুর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই নির্দেশ কি বাস্তবায়িত হবে, নাকি প্রশাসন আবারও চরমপন্থীদের চাপের সামনে নতি স্বীকার করবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে এ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর, বটতলা, সিএসই ভবনসংলগ্ন সড়ক ঘুরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

এ সময় জাবি শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ন হাবীব হিরন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো রকম সংস্কার ছাড়া তারা জাকসু নির্বাচনের আয়োজন করছে।

এখন পর্যন্ত আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের দোসরদের ক্ষমতায় রেখে তারা জাকসু নির্বাচন করতে চায়। আমরা তাদের হুঁশিয়ার করে বলতে চাই জাকসু নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করুন। নতুবা ছাত্রদল আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, ‘আমরা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সংস্কার কমিটি গঠন করে জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংস্কারকাজ শেষ করার আহ্বান জানাই।’

এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান জাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জরুরি সংস্কারকাজ করার বিষয়ে প্রশাসন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৬ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে