শরিফুজ্জামান পিন্টু
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইসহাক দার এক যুগ পর ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন। কূটনৈতিক সৌজন্য ছিল, নতুন চুক্তি হলো, সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা শোনা গেল। কিন্তু সব আলোচনার কেন্দ্রে এসে দাঁড়াল সেই পুরোনো প্রশ্ন— ১৯৭১।
সব ছাপিয়ে এ সফরে সামনে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যা, আর্থিক পাওনা ও আটকে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেরানোর প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র গঠনের মূল প্রেক্ষাপট ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে, প্রায় তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। এ গণহত্যা শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি জাতীয় স্মৃতি ও আত্মপরিচয়।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো সাধারণ ঐতিহাসিক অধ্যায় নয়— এটি বাংলাদেশের জন্মসনদ। তাই পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়, জাতির আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা।
কিন্তু ইসহাক দার যখন ঢাকায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন, কথা বললেন ভিন্ন সুরে। তার দাবি, ১৯৭৪ সালের চুক্তির মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান হয়ে গেছে। আরও বললেন, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ একসময় খোলাখুলি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, সেটিই যথেষ্ট। যেন পরিবারের ভেতরে কোনো কলহ একবার চাপা দেওয়া গেলে সেটি পুনরায় টেনে আনার প্রয়োজন নেই।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার করো।’
‘সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল,’— বলেন ইসহাক দার।
‘আমি মনে করি এখন ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদিসে যেমনটা বলা হয়েছে, সেভাবে আমাদের নতুন করে শুরু করে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা একটা পরিবার এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত,’— বলেন পাকিস্তানের মন্ত্রী।
বাংলাদেশের দিক থেকে উত্তর এলো স্পষ্ট ভাষায়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানালেন, ‘আমি অবশ্যই একমত না।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার ভাষ্য, যদি সমাধান হয়ে যেত, তাহলে আজ আর আলোচনার প্রয়োজন হতো না। একাত্তরের গণহত্যার প্রশ্ন বাংলাদেশের জন্য সমাপ্ত অধ্যায় নয়, বরং চলমান দাবি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই উঠে আসে সেই প্রশ্ন— দুইবার বললে তৃতীয়বার বলতে আপত্তি কী? যে দুবারের প্রসঙ্গ তিনি টেনেছেন, সেই দুবারই বা কী ঘটেছিল?
স্বাধীনতা অর্জনের দুই বছরের বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে পাকিস্তান। একই বছর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেই সফরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো গণহত্যার ঘটনায় অনুশোচনা প্রকাশ করে সেটির জন্য এককভাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দায়ী করেন তিনি।
বিষয়টিকে বেদনাদায়ক আখ্যা দিয়ে তখন দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বানও জানান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ভুট্টো বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।’
১৯৭৪ সালের এপ্রিলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
প্রায় তিন দশক পর ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে পুনরায় দুঃখ প্রকাশ করেন। অফিসিয়াল ভিজিটর বুকে বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে পারভেজ মোশাররফ লিখেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ব্যথা আপনাদের পাকিস্তানি ভাইবোনেরা ভাগ করে নিতে চায়। চলুন আমরা অতিত ভুলে একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যাই।’ সেখানে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রসঙ্গ ছিল না।
পাকিস্তান যদি স্বীকার করেই থাকে যে একাত্তরে কিছু ঘটেছে, তাহলে কেন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইছে না? দুবার ইঙ্গিত দিলে তৃতীয়বার সরাসরি বলা তাদের জন্য এত কঠিন কেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর গিয়ে ঠেকে রাজনৈতিক সাহসের প্রশ্নে। পাকিস্তানের নেতারা বারবার ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ ব্যক্তিগত হতে পারে, ক্ষমা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রিক। ‘দুঃখ’ দিয়ে অপরাধের দায় ঝেড়ে ফেলা যায় না।
আনুষ্ঠানিক ক্ষমা মানে হচ্ছে ইতিহাসকে স্বীকার করা, দায়িত্ব নেওয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। মোশাররফের দুঃখ প্রকাশ ইতিহাসের কাছে টেকেনি, কারণ সেটি ছিল এক ব্যক্তির বক্তব্য, রাষ্ট্রের নয়।
তাছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাওয়া হলেও পাকিস্তানের কোনো সরকারই সেটি বুঝিয়ে দেয়নি। এমনকি ১৯৭৪ সালে বিষয়গুলো নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু শুধু গণহত্যা নয়। বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তানের কাছে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাবে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেরানোর প্রশ্নও অমীমাংসিত। এ নিয়ে বারবার আলোচনা হলেও ইসলামাবাদ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারের সফরেও দার কোনো নিশ্চয়তা দিলেন না, কেবল আলোচনার দরজা খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের ধৈর্য প্রায় অর্ধশতক পেরিয়েও পরীক্ষার মুখে। একদিকে পাকিস্তান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার বার্তা দেয়, অন্যদিকে মূল সমস্যাগুলোকে পাশ কাটাতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এগুলো কেবল কূটনৈতিক ইস্যু নয়; এগুলো জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন।
দারের সফরের আরেকটি আলোচিত দিক হলো রাজনৈতিক যোগাযোগ। তিনি শুধু সরকারের সঙ্গেই নয়, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন। পাকিস্তান এটি স্বাভাবিক সৌজন্য হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর আলাদা তাৎপর্য আছে।
ইতিহাস বলছে, ইসলামাবাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ সব সময়ই বহুমাত্রিক বার্তা বহন করে। তাই এ ধরনের যোগাযোগ যেন ভারসাম্যপূর্ণ হয়, জাতীয় স্বার্থ যেন ক্ষুণ্ন না হয়— এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।
তবু সফরকে একেবারে অকার্যকর বলা যাবে না। সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা বিলোপ চুক্তি সই হয়েছে। আরও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এগুলো সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ইতিবাচক পদক্ষেপ। ব্যবসা-বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা— সব ক্ষেত্রেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই ছোট ছোট আলো কি ১৯৭১-এর অমীমাংসিত অন্ধকার ঢেকে দিতে পারবে? গণহত্যার ক্ষত যদি অস্বীকার করা হয়, তবে সহযোগিতার সব আলো শেষ পর্যন্ত ছায়ায় ঢাকা পড়বে।
বাংলাদেশ আজ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। পাকিস্তানও পরিবর্তনের বার্তা দিতে চাইছে। কিন্তু ইতিহাসের সত্যকে পাশ কাটিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কেবল অতীত নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় আত্মা। সেই আত্মাকে আহত রেখে সম্পর্কের সেতু মজবুত করা সম্ভব নয়।
ইসহাক দারের সফর তাই একসঙ্গে আশা ও হতাশার প্রতীক। আশা এই কারণে যে দুই দেশ আলোচনার টেবিলে বসছে, কিছু নতুন চুক্তি করছে, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা খুঁজছে। হতাশা এই কারণে যে, মূল সমস্যাগুলো এখনো যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বাংলাদেশের জন্য বার্তাটি পরিষ্কার— ক্ষমা প্রার্থনা, পাওনা নিষ্পত্তি এবং আটকে থাকা নাগরিকদের ফেরত নেওয়া ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইসহাক দার এক যুগ পর ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন। কূটনৈতিক সৌজন্য ছিল, নতুন চুক্তি হলো, সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা শোনা গেল। কিন্তু সব আলোচনার কেন্দ্রে এসে দাঁড়াল সেই পুরোনো প্রশ্ন— ১৯৭১।
সব ছাপিয়ে এ সফরে সামনে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যা, আর্থিক পাওনা ও আটকে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেরানোর প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র গঠনের মূল প্রেক্ষাপট ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে, প্রায় তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। এ গণহত্যা শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি জাতীয় স্মৃতি ও আত্মপরিচয়।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো সাধারণ ঐতিহাসিক অধ্যায় নয়— এটি বাংলাদেশের জন্মসনদ। তাই পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়, জাতির আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা।
কিন্তু ইসহাক দার যখন ঢাকায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন, কথা বললেন ভিন্ন সুরে। তার দাবি, ১৯৭৪ সালের চুক্তির মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান হয়ে গেছে। আরও বললেন, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ একসময় খোলাখুলি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, সেটিই যথেষ্ট। যেন পরিবারের ভেতরে কোনো কলহ একবার চাপা দেওয়া গেলে সেটি পুনরায় টেনে আনার প্রয়োজন নেই।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার করো।’
‘সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল,’— বলেন ইসহাক দার।
‘আমি মনে করি এখন ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদিসে যেমনটা বলা হয়েছে, সেভাবে আমাদের নতুন করে শুরু করে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা একটা পরিবার এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত,’— বলেন পাকিস্তানের মন্ত্রী।
বাংলাদেশের দিক থেকে উত্তর এলো স্পষ্ট ভাষায়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানালেন, ‘আমি অবশ্যই একমত না।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার ভাষ্য, যদি সমাধান হয়ে যেত, তাহলে আজ আর আলোচনার প্রয়োজন হতো না। একাত্তরের গণহত্যার প্রশ্ন বাংলাদেশের জন্য সমাপ্ত অধ্যায় নয়, বরং চলমান দাবি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই উঠে আসে সেই প্রশ্ন— দুইবার বললে তৃতীয়বার বলতে আপত্তি কী? যে দুবারের প্রসঙ্গ তিনি টেনেছেন, সেই দুবারই বা কী ঘটেছিল?
স্বাধীনতা অর্জনের দুই বছরের বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে পাকিস্তান। একই বছর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেই সফরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো গণহত্যার ঘটনায় অনুশোচনা প্রকাশ করে সেটির জন্য এককভাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দায়ী করেন তিনি।
বিষয়টিকে বেদনাদায়ক আখ্যা দিয়ে তখন দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বানও জানান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ভুট্টো বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।’
১৯৭৪ সালের এপ্রিলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
প্রায় তিন দশক পর ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে পুনরায় দুঃখ প্রকাশ করেন। অফিসিয়াল ভিজিটর বুকে বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে পারভেজ মোশাররফ লিখেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ব্যথা আপনাদের পাকিস্তানি ভাইবোনেরা ভাগ করে নিতে চায়। চলুন আমরা অতিত ভুলে একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যাই।’ সেখানে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রসঙ্গ ছিল না।
পাকিস্তান যদি স্বীকার করেই থাকে যে একাত্তরে কিছু ঘটেছে, তাহলে কেন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইছে না? দুবার ইঙ্গিত দিলে তৃতীয়বার সরাসরি বলা তাদের জন্য এত কঠিন কেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর গিয়ে ঠেকে রাজনৈতিক সাহসের প্রশ্নে। পাকিস্তানের নেতারা বারবার ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ ব্যক্তিগত হতে পারে, ক্ষমা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রিক। ‘দুঃখ’ দিয়ে অপরাধের দায় ঝেড়ে ফেলা যায় না।
আনুষ্ঠানিক ক্ষমা মানে হচ্ছে ইতিহাসকে স্বীকার করা, দায়িত্ব নেওয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। মোশাররফের দুঃখ প্রকাশ ইতিহাসের কাছে টেকেনি, কারণ সেটি ছিল এক ব্যক্তির বক্তব্য, রাষ্ট্রের নয়।
তাছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাওয়া হলেও পাকিস্তানের কোনো সরকারই সেটি বুঝিয়ে দেয়নি। এমনকি ১৯৭৪ সালে বিষয়গুলো নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু শুধু গণহত্যা নয়। বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তানের কাছে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাবে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেরানোর প্রশ্নও অমীমাংসিত। এ নিয়ে বারবার আলোচনা হলেও ইসলামাবাদ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারের সফরেও দার কোনো নিশ্চয়তা দিলেন না, কেবল আলোচনার দরজা খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের ধৈর্য প্রায় অর্ধশতক পেরিয়েও পরীক্ষার মুখে। একদিকে পাকিস্তান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার বার্তা দেয়, অন্যদিকে মূল সমস্যাগুলোকে পাশ কাটাতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এগুলো কেবল কূটনৈতিক ইস্যু নয়; এগুলো জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন।
দারের সফরের আরেকটি আলোচিত দিক হলো রাজনৈতিক যোগাযোগ। তিনি শুধু সরকারের সঙ্গেই নয়, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন। পাকিস্তান এটি স্বাভাবিক সৌজন্য হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর আলাদা তাৎপর্য আছে।
ইতিহাস বলছে, ইসলামাবাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ সব সময়ই বহুমাত্রিক বার্তা বহন করে। তাই এ ধরনের যোগাযোগ যেন ভারসাম্যপূর্ণ হয়, জাতীয় স্বার্থ যেন ক্ষুণ্ন না হয়— এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।
তবু সফরকে একেবারে অকার্যকর বলা যাবে না। সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা বিলোপ চুক্তি সই হয়েছে। আরও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এগুলো সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ইতিবাচক পদক্ষেপ। ব্যবসা-বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা— সব ক্ষেত্রেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই ছোট ছোট আলো কি ১৯৭১-এর অমীমাংসিত অন্ধকার ঢেকে দিতে পারবে? গণহত্যার ক্ষত যদি অস্বীকার করা হয়, তবে সহযোগিতার সব আলো শেষ পর্যন্ত ছায়ায় ঢাকা পড়বে।
বাংলাদেশ আজ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। পাকিস্তানও পরিবর্তনের বার্তা দিতে চাইছে। কিন্তু ইতিহাসের সত্যকে পাশ কাটিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কেবল অতীত নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় আত্মা। সেই আত্মাকে আহত রেখে সম্পর্কের সেতু মজবুত করা সম্ভব নয়।
ইসহাক দারের সফর তাই একসঙ্গে আশা ও হতাশার প্রতীক। আশা এই কারণে যে দুই দেশ আলোচনার টেবিলে বসছে, কিছু নতুন চুক্তি করছে, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা খুঁজছে। হতাশা এই কারণে যে, মূল সমস্যাগুলো এখনো যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বাংলাদেশের জন্য বার্তাটি পরিষ্কার— ক্ষমা প্রার্থনা, পাওনা নিষ্পত্তি এবং আটকে থাকা নাগরিকদের ফেরত নেওয়া ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব নয়।
অনেক মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী–শিক্ষক অনুপাত ২০:১, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মানের দ্বিগুণ। ২০২৪ সালের বিএমঅ্যান্ডডিসি জরিপে দেখা যায়, ৩৫% বেসরকারি কলেজে মৌলিক বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। দুর্বল বেডসাইড প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ তত্ত্বাবধানের অভাবে নতুন ডাক্তাররা বাস্তব অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে
৮ দিন আগেবিশ্বব্যাংক খাদ্য মূল্যস্ফীতির সূচক তৈরির ক্ষেত্রে কিছু ধাপ অনুসরণ করে। এর মধ্যে যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে গড়ে ২ শতাংশের কম বাড়ে ওইসব দেশকে সবুজ তালিকায় রাখে। অর্থাৎ কোনো ঝুঁকি নেই। যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে বাড়ে ওইসব দেশকে হলুদ তালিকায় রাখে।
৮ দিন আগেশিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রাক আলোচনায় কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা সুনিদির্ষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্তের ব্যাপক বিরোধিতা করে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেয়ার যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তা লক্ষণীয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কোনো শিক্ষার্থী পোষ্য ভর্তি ফের চালু করলে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ
৯ দিন আগেএই ছোট্ট ঢাকা শহর যেখানে ৪ কোটি মানুষের বাস এর অলিতে, গলিতে, ফুটপাতে, রিক্সাওয়ালা এমনকি কখনও কখনও রিক্সার যাত্রী, টেক্সি ওয়ালা, মোটর বাইক চালক,পিছনের সঙ্গী বা যাত্রী সিগারেট টানছে। বহু হাই অফিসিয়াল কর্পোরেট বস সুযোগ খুঁজে নেমে পড়েন নিচে।
১০ দিন আগে