আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল কি সম্ভব?

ডয়চে ভেলে
আদানি পাওয়ারের বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট প্রায় ১২ টাকা, যা ভারতের অন্যান্য বেসরকারি উৎপাদকদের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্লান্টের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি

ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আদানি পাওয়ার’ এর সঙ্গে সরকার চাইলেই কি চুক্তি বাতিল করতে পারবে? আবার এই চুক্তি টিকিয়ে রেখে কি সরকারের লাভ হচ্ছে? এখন সেই হিসাব নিকাশ চলছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আদানি পাওয়ারের সঙ্গে করা চুক্তিগুলো কতটুকু যৌক্তিক এবং জাতির স্বার্থের কথা কতটুকু চিন্তা করেছে, তা খতিয়ে দেখতে জাতীয় রিভিউ কমিটি করেছে সরকার। কমিটির রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ২০১০ সালের বিতর্কিত আইন নিয়ে তো আমরা কিছু করতে পারব না, কারণ সেটা আদালতের বিবেচনাধীন৷ তবে বিগত সরকারের সময় বিদ্যুতের যে চুক্তিগুলো হয়েছিল, সেগুলো রিভিউ করার জন্য আমরা একটা স্বাধীন কমিটি করেছি। ওই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো। কমিটি এখনো রিপোর্ট দেয়নি।

আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স একটি রিপোর্ট করেছে। সেখানে তারা বলেছে, চুক্তিটি রাখতে পারে বাংলাদেশ। সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় অবস্থিত তাদের যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে, সেখান থেকে সরবরাহ এর মধ্যেই অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট।

এই কেন্দ্রটির সঙ্গে অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির পার্থক্য হচ্ছে, পিডিবি চাইলেও এই ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াটের ৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ কিনতে পারবে না এখান থেকে। প্রয়োজন না থাকলেও ৩৪ ভাগ বিদ্যুৎ কিনতে হবে। তা না কিনলেও ওই পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য আদানিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। প্রতি চার মাসের ডিমান্ড একবারে দিতে হবে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পিডিবি কী পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে, তার একটি ডিমান্ড ডিসেম্বরেই দিতে হবে। কোনো কারণে পিডিবি বিদ্যুৎ না নিলেও আমদানি করা কয়লার দাম পিডিবি পরিশোধ করবে।

সরকার চাইলেই কি এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে? জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এই চুক্তি বাতিল করতে গেলে সরকারকে বেশ কিছু বিপদে পড়তে হবে। কারণ এই চুক্তিটি রাষ্ট্র করেছে। ফলে আমাদের অনেক গচ্চা দিতে হতে পারে। আবার তারা আন্তর্জাতিক আদালতেও যেতে পারে। ফলে চাইলেই এখন চুক্তিটি বাতিল করা সম্ভব নয়। তবে এখানে যে ব্যত্যয়গুলো হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করতে পারে। তারা আমাদের সঙ্গে কয়লার দাম নিয়ে প্রতারণা করেছে, সেটা নিয়ে তাদের ধরা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই চুক্তিটি যারা করেছে সেটা আমাদের দেশের স্বার্থ বিরোধী হয়েছে। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আবার ক্যাপাসিটি চার্জ যেটা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কোন আইন মেনে করা হয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে৷''

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের এক কর্মকর্তা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সর্বশেষ অডিট রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্সকে বলেছেন, আদানি পাওয়ারের বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট প্রায় ১২ টাকা খরচ হয়, যা ভারতের অন্যান্য বেসরকারি উৎপাদকদের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্লান্টের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি।

বিগত চুক্তির অধীনে, বাংলাদেশ ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আদানি এবং অন্যান্য ভারতীয় প্ল্যান্ট থেকে প্রায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তবে ভারতের একজন মুখপাত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ চুক্তিটি পর্যালোচনা করলেও এ বিষয়ে আদানির কোনো ইঙ্গিত নেই। বকেয়া বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছি, যা উদ্বেগের বিষয়।

আদানিসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে বাংলাদেশের মোট বকেয়ার পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থের কিছুটা এখনই পরিশোধ না করা গেলে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কি বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে? জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে। প্রথমত, আদানি নিজেদের প্লান্ট থেকে কয়লা ব্যবহার করে। সেটাতে যে মূল্য ধরা হয়, সেটা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি। এখানে আরেকটা জিনিস আছে, তারা যদি কোন ট্যাক্স রিবেট পেয়ে থাকে সেটা মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় হবে। কিন্তু তারা ট্যাক্স সুবিধা পাওয়ার পরও মূল্যের সঙ্গে সেটা সমন্বয় করেনি। ফলে তাদের পাওনার বিষয়ে যেমন সমন্বয় দরকার, তেমনি মূল্যের সমন্বয়ও দরকার। এখন আপনি এটা বাতিল করতে গেলে যৌক্তিক কোন কারণ আছে কিনা? এই বিদ্যুৎ না এলে বাংলাদেশের বিদ্যুতের বিকল্প কি? সেটা কি নিশ্চিত করা গেছে? আবার সরকার যদি মনে করে, আর্থিকভাবে তাদের মূল্য পরিশোধ সম্ভব নয় বা কষ্টকর হচ্ছে বা সামর্থ্য নেই তাহলে চুক্তি বাতিলের দিকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এই ‘ক্লজ'গুলো আছে কিনা সেটা দেখতে হবে৷

পুরো বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য সরকার একটি রিভিউ কমিটি করেছে। কমিটি গত ৩ আগস্ট জনগণের কাছে দুর্নীতির তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন এবং সরবরাহকারী সংস্থার দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ইমেইলে পাঠানো যাবে। রিভিউ কমিটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করবে।

পর্যালোচনায় গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান।

পর্যালোচনা কমিটির কাজ কতদূর এগিয়েছে? জানতে চাইলে কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী বলেন, আমরা কাজ করছি, এটি একটি বিশাল কাজ। কাজটা করতে আমাদের একটু সময় লাগবে। আমরা শুধু বিদ্যুৎ নয়, জ্বালানি নিয়েও কাজ করছি। ফলে পুরো কাজ শেষ না করা পর্যন্ত মন্তব্য করা কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা আদানির সঙ্গে চুক্তির পুরো বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করছি।

প্রসঙ্গত, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন' করে। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে দুই বছর, ২০১৪ সালে চার বছর, ২০১৮ সালে তিন বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে পাঁচ বছরের জন্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এ আইনে এমন বিধান করা হয় যে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অথবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্য কোনো কার্যক্রম, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উপস্থাপন করা যাবে না।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৫ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৬ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৭ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

১০ দিন আগে