গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট : সুপারিশ বাস্তবায়ন কি সম্ভব?

ডয়চে ভেলে
আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৫, ১০: ২৩
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদসহ অন্য সদস্যরা তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন

দেশে এবার গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। কিন্তু এই প্রতিবেদনের কোনো কোনো প্রস্তাব বাস্তবতাবিবর্জিত বলে মনে করছেন অনেকে।

শনিবার (২২ মার্চ) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদসহ অন্য সদস্যরা তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন।

প্রতিবেদন জমা দেবার পর যমুনার সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

কামাল আহমেদ বলেন, তারা সাংবাদিকতা সুরক্ষায় আইন করার সুপারিশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা সুরক্ষা অধ্যাদেশের একটি খসড়াও করে দিয়েছেন।

বৈঠকের পর কামাল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কিভাবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটাও আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সরকারের দায়িত্ব এটা বাস্তবায়ন করার। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কাছে একটা সারসংক্ষেপ চেয়েছেন যেটা দ্রুত অধ্যদেশ আকারে বাস্তবায়ন করা যায়। আগামী দুই দিনের মধ্যে সেগুলো আমরা তার কাছে জমা দেব।’

‘সংবাদপত্রের মৃত্যু’ চাইছেন তারা

কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত আর্থিক কাঠামোর বিষয়টি। প্রস্তাব অনুযায়ী, বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের প্রবেশপদ বা নবম গ্রেডের বেতন স্কেলের সঙ্গে সংগতি রেখে সাংবাদিকদের প্রবেশপদের বেতন হতে পারে।

কামাল আহমেদ বলেন, ‘সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য এটি হতে পারে। তবে ঢাকায় যেহেতু জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি, সে ক্ষেত্রে ঢাকার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ‘ঢাকা ভাতা’ যোগ করা হতে পারে। সারা দেশে সাংবাদিকেরা যে বেতন পাবেন, ঢাকার ক্ষেত্রে এই ভাতা যোগ হবে। এই ভাতা ঠিক করবে সরকার ও সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন পক্ষ মিলে।’

জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মূল বেতন শুরু হয় ২২ হাজার টাকা দিয়ে। এর সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা যোগ হয়। সব মিলিয়ে এই বেতন হয় ৩৫ হাজারের বেশি।

সংস্কার কমিশনের এই রিপোর্টকে ‘অবাস্তব ও অলীক চিন্তা’ বলে উল্লেখ করেছেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, এমনিতেই সংবাদপত্রগুলো ধুঁকছে। সেখানে এমন চিন্তা করা মানে ‘সংবাদপত্রের মৃত্যু’ চাইছেন তারা।

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘এই রিপোর্ট অবাস্তব ও অযৌক্তিক পরিকল্পনা। এটা হতে পারে না। এটা হতে পারে না এই কারণে যে, সংবাদপত্র তো এখন মৃত্যুর পথে। মালিকরা চালাবে কিভাবে? প্রিন্ট মিডিয়া এই মুহূর্তে সবচেয়ে চাপের মুখে। এই জায়গায় ব্যবসা নেই, বাণিজ্য নেই, কিছুই নেই। ফলে এটা বাস্তবায়ন হবে কিভাবে? এটা অবাস্তব। এটা কে গ্রহণ করবে? বাস্তব অবস্থা তো বুঝতে হবে। অবাস্তব চিন্তা করে তো লাভ নেই। সংবাদপত্র টিকবে কী করে? অর্থনীতি তো ঠিক নেই। এমন একটা প্রস্তাব দিলেন, এখন সংবাদপত্রের কী হবে? ব্যবসা কি আছে? ব্যবসা নেই, নতুন কলকারখানা হচ্ছে না। কেউ বিনিয়োগ করতে আসছে না। এই অবস্থার মধ্যে আপনারা এই প্রস্তাব দিচ্ছেন। এটা তো বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। এই সুপারিশের মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে সংবাদপত্রের মৃত্যু চাইছেন তারা! এখন বিজ্ঞাপনের ৭০ ভাগ চলে যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। ব্যবসা না থাকলে কে বিজ্ঞাপন দেবে বলেন? এটাকে অলীক চিন্তাও বলতে পারেন।’

এই রিপোর্ট কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব? জানতে চাইলে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি দৈনিক সমকালের মালিক এ কে আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে তারা যখন বৈঠক করেছিলেন তখন কিন্তু আমরা সংকটের কথা তাদের বলেছিলাম। এখন তারা যে রিপোর্ট দিলেন সেটার কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটা আমাদের আলোচনা করে দেখতে হবে। এখন সংবাদপত্রের সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে। সেখানে তারা যে বলেছে, সরকারি চাকরির নবম গ্রেডের সমান হবে একজন সাংবাদিকের শুরুর বেতন। এটা কি সম্ভব? সে কিছুই জানে না, তাদের শিখিয়ে নিতে হবে। এমন অনেক কিছুই আছে যা আসলে আমাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। আমাদের আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। বেসরকারি বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা পেতেও অনেক সময় লেগে যায়। আমরা আসলে মিডিয়াগুলো কিভাবে চালাব? সেই পরামর্শ তারা দিক।’

কিছু সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে সরকার

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যেগুলো এখনই করা সম্ভব, তা সরকার দ্রুত করে ফেলবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করে ফেলতে চাই। সে জন্য আমি চাইবো সংস্কার কমিশন আশু করণীয় বা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায় এমন সুপারিশগুলো দ্রুত আলাদাভাবে আমাদের কাছে পেশ করুক।

সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কাজকে ‘অমূল্য’ হিসেবে তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস এই প্রতিবেদন যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য মানুষ পড়তে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দেন। দেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একটি নির্দিষ্ট স্যাটেলাইট ব্যবহারে বাধ্য বলে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখা যায় না- কমিশনের কাছে থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এবং আগ্রহী বিদেশিরা দেখতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেবে সরকার।’

সংস্কার কমিশনের সদস্য দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আজকের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কাছে একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা চেয়েছেন যা এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিছুটা হয়ত ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার করবে।’ এই রিপোর্টটা কেন আপনাদের কাছে আলাদা মনে হয়? জবাবে তিনি বলেন, ‘১৯৮৩ সালেও প্রবীন রাজনৈতিক আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে একটা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন হয়েছিল। এবার সেই রিপোর্টের তুলনায় ব্যাপক। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি আমরা। মালিক তো আর পকেট থেকে বেতন দেবে না। সে আয় করে দেবে। এখন সংবাদপত্র জগতে যে ব্যাপক নৈরাজ্য, আমরা যে সুপারিশ করেছি, সেটা বাস্তবায়ন হলে সেই নৈরাজ্য আর থাকবে না। এতে তাদের আয়ও বাড়বে এবং সবাইকে তারা সঠিকভাবে বেতন ভাতা দিতে পারবে।’

ওয়ান হাউজ ওয়ান মিডিয়ার সুপারিশ

একই কোম্পানি বা মালিকের অধীনে একাধিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান না রাখার সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। এক্ষেত্রে ‘ওয়ান হাউজ, ওয়ান মিডিয়ার’ সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘একই হাউজ থেকে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল একই ধরনের খবর প্রচার করছে। একই হাউজ থেকে একই ধরনের পত্রিকা একাধিক খবর প্রচার করছে। একই ভাষায় মতামত বা বিশ্লেষণ লেখা হচ্ছে। একই ধরনের লেখা কাগজ কেন কিনবে পাঠক, সেই পত্রিকা থেকে কি পাচ্ছে পাঠক। এটি হচ্ছে বাজারের স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। যাদের মালিকানায় একাধিক টেলিভিশন কিংবা পত্রিকা আছে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন কোন প্রতিষ্ঠানটি রাখবেন। হয় মালিকানা বিক্রি করে দেবেন না হলে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করবেন।’

বিটিভি, বেতার ও বাসসকে একীভূত করে একটি সংস্থা

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) একীভূত করে একটি প্রতিষ্ঠান করার সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হতে পারে ‘বাংলাদেশ সম্প্রচার সংস্থা বা জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা’। এই প্রতিষ্ঠানের বার্তা বিভাগ হিসেবে বাসসকে একীভূত করতে বলেছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানে তিনটি বিভাগ থাকবে। এগুলো হলো টেলিভিশন, বেতার ও বার্তা বিভাগ।

বর্তমানে বিটিভি, বেতার ও বাসস স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় চলে। কমিশনে সুপারিশে বলা হয়েছে, সম্প্রচারমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন ও বেতার এক ছাদের নিচের একটি সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দুটি শাখা হিসেবে কাজ করলে উভয় প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সর্বোত্তম ব্যবহার হবে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিবিসি ও ডয়চে ভেলে। এটা সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গের অনুষ্ঠানমালার ক্ষেত্রে। ভিডিও ফরম্যাটে ধারণকৃত প্রতিবেদন বা অনুষ্ঠানের অডিও ফরম্যাটকে আলাদা করা খুব কঠিন কিছু নয়। আবার বেতারের অনেক অনুষ্ঠানই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের জন্য ভিডিও স্ট্রিমিং করা হয়। বাংলাদেশ বেতার ঢাকা ও আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো তা নিয়মিত করছে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশের বেতারের মধ্যে সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

মাঝারি-বড় সংবাদমাধ্যমকে পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়তে হবে

মাঝারি ও বড় সংবাদমাধ্যমকে একটি সময়সীমার মধ্যে পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার প্রস্তাব করে ব্যাংকিং খাতের মত এসব কোম্পানির মালিকানাতেও সর্বোচ্চ শেয়ার রাখার সীমা বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ করেছে এ বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্যোক্তা পরিচালক ও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেয়ারধারণের সর্বোচ্চ সীমা ২৫ শতাংশের মধ্যে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালক পারিবারিকভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারধারণ করতে পারেন না। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একই সময়ে পরিবার থেকে থাকতে পারেন সর্বোচ্চ তিনজন। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এক্ষেত্রে তাই পরিবর্তন প্রয়োজন। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, কমিশন প্রথম পর্যায়ে মাঝারি ও বৃহৎ মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে সর্বসাধারণের জন্য শেয়ার ছাড়া ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া সমীচীন মনে করছে। উদ্যোক্তা পরিচালক ও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেয়ারধারণের সীমা ২৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত করা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে শেয়ারবণ্টন বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

প্রেস কাউন্সিল খুব একটা কার্যকর নয়

প্রেস কাউন্সিল খুব একটা কার্যকর নয় বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘প্রেস কাউন্সিলকে জাতীয় স্থায়ী গণমাধ্যম কমিশনের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সময় ভুল সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আসে। সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের কাছে হয়রানির শিকার হন। যার ফলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ থেকে প্রতিকার পাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’

তিনি বলেন, ‘একটা প্রেস কাউন্সিল ছিল, এখনো আছে, কিন্তু সেটা খুব একটা কার্যকর না। থাকলেও তা যেমন সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না, তেমনি ভুক্তভোগী যারা গণমাধ্যমের অন্যায় কাজের শিকার হন, তাদের প্রতিকার দিতেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। কমিশন প্রধান বলেন, প্রেস কাউন্সিলের আরও একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রেস কাউন্সিল আইনটি শুধু সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার সাংবাদিকদের জন্য হয়েছিল। কিন্তু এখন তো টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকতার একটি বিরাট অংশ। তাহলে এদের তদারকি প্রতিষ্ঠান কে হবে?’

অনলাইনের ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ

১. অনলাইন পোর্টাল নিবন্ধনের নীতিমালা হালনাগাদ করা এবং এর আলোকে নিবন্ধন প্রদানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা যেহেতু বিগত সরকারের প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের ওপর ন্যস্ত ছিল, সেহেতু তা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশনের ওপর অর্পণ করা সমীচীন।

২. গত দশকে যেসব অনলাইনের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, তা যেহেতু কোনো স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট নীতির অধীনে হয়নি বরং সরকারের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে, সেহেতু সেগুলো পর্যালোচনা প্রয়োজন। এ পর্যালোচনার দায়িত্ব স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা সমীচীন।

৩. অনলাইন পোর্টাল নিবন্ধনের জন্য একাধিক নিরাপত্তা সংস্থার যে তদন্ত ব্যবস্থা রয়েছে, তার অবসান প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশনের জন্য বিদ্যমান পুলিশের তদন্ত ব্যবস্থাই যথেষ্ট গণ্য করা যায়।

৪. অনলাইন পোর্টালগুলো নিবন্ধন পাওয়ার পর তার বার্ষিক নবায়ন পদ্ধতি বাতিল করা হোক।

৫. অনলাইন নীতিমালায় আইপিটিভি ও অনলাইন পোর্টালে সংবাদ বুলেটিন সম্প্রচার করা যাবে না- এমন নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা উচিত।

৬. অনলাইন পোর্টালে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার আলোকে সরকারি বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. অনলাইন পোর্টালের জন্য ট্রেড লাইসেন্সের ফি সাধারণ ট্রেড লাইসেন্সের ফির কয়েক গুণ। এটি সংবাদমাধ্যমকে নিরুৎসাহিত করার নীতি। এর অবসান হওয়া উচিত।

এই রিপোর্ট বাস্তবায়নের গণমাধ্যমে কতটুকু শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব? জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এটা আসলেই বাস্তব এবং কঠিন। কমিশন থেকে আমরা নিজেরাও আলোচনা করেছি, শৃঙ্খলা ফিরবে কিনা? ১৯৮৪ সালে পাওয়া ওই রিপোর্টের প্রায় ৪০ বছর পর আমরা একইভাবে সমস্যাগুলো শনাক্ত করেছি যে, আসলে কোথাও কোনো কাজ হয়নি। এটা আসলে নির্ভর করছে মালিকপক্ষ এবং সরকারের যে সংস্থাগুলো এটা বাস্তবায়ন করবে তাদের উপর। আমরা আজকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছি, এর আগে তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গেও বৈঠক করেছি। তারা বলেছেন, আপনারা রিপোর্ট দেন আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করবো এটা বাস্তবায়নের জন্য।’

ডিএফপি থেকে যে সংবাদপত্রের ভুতুরে সার্কুলেশনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেটা তো এই সরকারের আমলেও চলছে? এখান থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ কী? জানতে চাইলে জিমি আমির বলেন, ‘ডিএফপির অনিয়মের প্রমাণ আমরা বের করেছি। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে দুই-এক দিনের মধ্যে এটা আপলোড করা হবে, সেখানে কিন্তু ডিএফপির অনেক দুর্নীতির কাগজও দেওয়া হয়েছে। কিভাবে এই দুর্নীতি হয় সেটাও দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে হকাররা যে পত্রিকা বিলি করেন সেখান থেকে তালিকা যাবে ডিএফপিতে। সে অনুযায়ী তাদের বিজ্ঞাপনের রেট নির্ধারণ হবে। পাশাপাশি মালিকদের তো রিটার্ন দাখিল করতেও বলা হয়েছে। এটাও মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। এটা যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে ডিএফপির দুর্নীতি কমানো সম্ভব।’

গত বছরের ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার লক্ষ্যে এই ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন' গঠন করা হয়। কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অ্যাটকোর সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপরিচালক কামরুন নেসা হাসান, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক জাহিদ, নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সচিব আখতার হোসেন খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি ফাহিম আহমেদ, মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির, দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের উপসম্পাদক টিটু দত্ত গুপ্ত এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন।

গত নভেম্বরে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যেগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ৩১ মার্চ। এর আগে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ইতিমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে