ড. ইউনূসের চীন সফরে প্রত্যাশা বিশাল, প্রাপ্তির সম্ভাবনা সীমিত

সাইমন মোহসিন

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফর প্রচুর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এই সফরকে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের পূর্বপরিকল্পনার আলোকে বিবেচনা করা উচিত। এই সফর কূটনৈতিক প্রোটোকল-চালিত ও ড. ইউনূসের জন্য বিশেষভাবে আয়োজিত কোনো সফর কিংবা আয়োজন নয়। এই সফর বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের জন্য অনেক আগে থেকেই আয়োজিত ছিল।

সরকারপ্রধান পদে যেই থাকুক না কেন, এই সফর হতোই। সুতরাং শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, এই সফরে প্রত্যাশার পরিধি বিশাল হলেও প্রকৃত ও বাস্তব অর্জনের মাত্রা সীমিতই হবে।

আসন্ন সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আলোচনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে আলোকপাত করা হবে বলেই সবাই আশাবাদী। বাংলাদেশ নতুন নেতৃত্বের অধীনে এসব ইস্যুতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে পারে। তবে চীনের অবস্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। ফলাফল নির্ভর করবে কূটনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য রক্ষার ওপর। আলোচনার কার্যকারিতা কৌশলগত অগ্রাধিকারের অসমতার প্রেক্ষাপটেই পর্যালোচনা করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হবে। সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তি পর্যায়ে অগ্রাধিকার দেওয়া কিছু নতুন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হতে পারে। তবে বিআরআই নিয়ে আলোচনায় মূলত বিদ্যমান বিআরআই অধীন চুক্তি ও প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতা ও ত্বরান্বিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৬ সাল থেকে বিআরআইয়ের অধীন যে প্রকল্পগুলোতে চীনের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি ও সমঝোতা রয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অনেক মহল সেগুলোর বাস্তবায়ন ও সংশ্লিষ্ট অর্থছাড়ের জন্য বেশ উদগ্রীব।

চীন প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের মধ্যে বেইজিংয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক থেকে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। আলোচনায় তৌহিদ হোসেন সুদের হার ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার, কমিটমেন্ট ফি মওকুফ করার এবং প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) ও গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোনের (জিসিএল) জন্য ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করার অনুরোধ করেন।

ওয়াং ই বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের ইতিবাচক রেকর্ডের প্রশংসা করেন এবং প্রাথমিকভাবে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি জানান। তবে সুদের হার কমানোর বিষয়ে তিনি শুধু ‘বিবেচনা করা’র আশ্বাস দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের এলডিসি গ্র‍্যাজুয়েশনের পর তিন বছর ধরে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য চীনের বাজারে ডিউটি-ফ্রি কোটা-ফ্রি (ডিএফকিউএফ) সুবিধা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিও দেন।

ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো একটি ইতিবাচক উন্নয়ন হলেও চীন বর্তমান ২-৩ শতাংশ সুদের হার কমানোর বিষয়ে সম্মত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ যখন ঋণ পেয়েছিল, তখন একই সময়ে শ্রীলঙ্কাকেও চীন একই সুদের হারে ঋণ দেয় এবং তারা তা গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের জন্য সুদের হার কমানো একটি নজির স্থাপন করতে পারে, যার ফলে এই অঞ্চলে যেসব দেশকে চীন একই রকম সুদের হারে ঋণ দিয়েছে, তাদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে।

এমন পদক্ষেপ চীনের প্রতিষ্ঠিত আর্থিক কাঠামোকে দুর্বল করবে এবং অন্যান্য ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর সঙ্গে শর্তাবলি পুনরায় আলোচনার চাপ তৈরি করবে। তাই বাংলাদেশ কিছু ছাড় পেতে পারে, তবে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর সম্ভাবনা কম। তবে ড. ইউনুসের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক স্থিতিশীলতার অগ্রাধিকারকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা বলতে পারি, সংলাপের সময় এই বিষয়টি উত্থাপন করা হবে।

অধ্যাপক ইউনূসের চীন সফরে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভও (জিডিআই) আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে। চীন বরাবরই এ উদ্যোগে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রতি জোর দিয়ে আসছে। তবে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের জন্য উদ্যোগে এখনই যোগ দেওয়ার সম্ভাবনাকে জটিল করে তুলেছে।

পশ্চিমা দেশগুলো চীনের সঙ্গে যেকোনো দেশের সম্পর্ক গভীর করার বিষয়ে স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ড. ইউনুস, যিনি পশ্চিমা দেশগুলোর নিরঙ্কুশ সমর্থন উপভোগ করেন, তার জন্য এটি একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়। পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে তার সমন্বয় এই সফরে জিডিআই ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

এ ছাড়াও চীন জিডিআইয়ের অনুরূপ আরও দুটি নতুন উদ্যোগের কথাও বলছে। নিরাপত্তা ও সভ্যতা সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ দুটি অতিরিক্ত কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এসফরে জিডিআই সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য ফলাফল আসার সম্ভাবনা কম। পশ্চিমা প্রভাব, ড. ইউনুসের রাজনৈতিক ঝোঁক এবং চীনের ক্রমবিকাশমান উন্নয়ন উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই সফরে জিডিআই আলোচিত হলেও বাস্তব ফলাফল তেমন কিছুই অর্জন হবে না।

চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) ক্ষেত্রেও এই সফরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসার সম্ভাবনা কম। যদিও এই এফটিএর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং আলোচনা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রকৃতপক্ষে এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে এবং কার্যত এটি এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে এগোয়নি।

ফলে আপাতত এই সফরে এ বিষয়ে বাস্তব অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। বরং আলোচনায় এই চুক্তির পক্ষে কূটনৈতিক বক্তব্য ও বাক্যালাপের ওপর জোর দেওয়া হবে। এসব বক্তব্যে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য পারস্পরিক প্রতিশ্রুতিকে জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে এবং দুই পরম মিত্র দেশের মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী করার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে। এই ধরনের ইতিবাচক বক্তব্যের বাইরে এই সফরে এফটিএতে বাস্তব অগ্রগতির সম্ভাবনা কম।

স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা এই সফরের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হবে, যা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে বাস্তব অগ্রগতি ও কৌশলগত কূটনীতির প্রতীক। চীন কুনমিংয়ে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চারটি হাসপাতাল বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে, যার প্রথম ব্যাচ ১০ মার্চ চীনে যাত্রা করেছে। এ ছাড়াও চীন ঢাকায় একটি আধুনিক ও উচ্চ মানের হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে, যা এই অংশীদারিত্বকে আরও সুদৃঢ় করবে।

এই অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। এই অগ্রগতি ভারত-বাংলাদেশ ও ভারত-চীন সম্পর্কের চলমান টানাপড়েনের মধ্যে একটি কূটনৈতিক জয় হিসেবে কাজ করবে। স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা গভীর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু তার স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোই এগিয়ে নেবে না, বরং তার ভূ-রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকেও জোরালোভাবে তুলে ধরবে, যা ঐতিহ্যগত জোটের বাইরে স্বাধীন অংশীদারিত্ব অনুসরণের সক্ষমতার ইঙ্গিত দেবে। এ ক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আশা করা হচ্ছে, যা উভয় দেশের কৌশলগত ও উন্নয়নমূলক অর্জনের জন্য এই সহযোগিতাকে কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলন।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ক্যালকুলাসে ভারত একটি বড় ফ্যাক্টর। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব দৃশ্যমান হয়েছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

এ প্রেক্ষাপটে চীন সফর বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন জোরালোভাবে তুলে ধরবে এবং ইঙ্গিত দেবে যে ভারত একতরফাভাবে শর্ত নির্ধারণ বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করা এই অবস্থানকে জোরালোভাবে তুলে ধরার একটি কার্যকর মাধ্যম, যা এই অঞ্চলে চীনের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তবে এও সত্য, ড. ইউনুসের ভারত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের পদক্ষেপের জোরালো দাবি থাকলেও ড. ইউনূস কূটনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব জোরালো করার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপরেই জোর দেবেন, যেন দেশটি ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সার্বভৌমত্ব ও নমনীয়তা উভয়ই বজায় রাখে। এই সূক্ষ্ম অবস্থান আঞ্চলিক গতিশীলতা ও বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির জটিল ক্যালকুলাসের স্পষ্ট প্রতিফলন বহন করে।

পানি বণ্টন ও আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদী এ সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয় হিসেবে উঠে আসবে। বাংলাদেশ প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। তবে এর বাস্তবায়ন আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে। কারণ তিস্তা নদীর পানির সঙ্গে ভারতের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত।

একই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদীতে চীনের বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশি নীতিনির্ধারক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ তৈরি করেছে। যদিও চীন বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে যে এই বাঁধগুলো নদীর নিম্নপ্রবাহে পানির প্রবাহকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করবে না। তবে এই ধরনের মৌখিক আশ্বাস দীর্ঘমেয়াদি পানি ও পরিবেশগত নিরাপত্তা উদ্বেগ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ পানি বণ্টনে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। দেশের জন্য এই ইস্যুটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনুসের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের কারণে চীনের নেতৃত্বের সঙ্গে তার এই উদ্বেগগুলো তুলে ধরার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে চীন কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, বেইজিং এ বিষয়ে গভীর আলোচনা এড়িয়ে যেতে চাইবে এবং সহযোগিতার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করবে।

এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জকে আরও স্পষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার পানি অধিকারের পক্ষে সংলাপ করার পাশাপাশি চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতাকে মাথায় রাখতে হবে।

অন্যবারের মতোই এ সফরেও রোহিঙ্গা ইস্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে। চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখে। তবে বাস্তব অগ্রগতি এখনো অধরাই রয়েছে। ফলে এই সফরেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এ ইস্যুতে তাৎক্ষণিক সমাধানের প্রত্যাশা রাখা উচ্চাভিলাষ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে মানবিক তহবিল সংকট মোকাবিলার দিকে মনোনিবেশ করে চীন ও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা তহবিল সংকট এখন চরমে, যা বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ফেলেছে। এই চ্যালেঞ্জ সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরেও সর্বাধিক আলোচিত বিষয় ছিল।

এ সফরে রোহিঙ্গা মানবিক তহবিল সংকট মোকাবিলায় চীনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হতে পারে, যা নতুন উদ্যোগ বা প্রতিশ্রুতির দিকে অগ্রসর হতে পারে। এ ধরনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জন্য বেশ ইতিবাচক হবে এবং আরও জোরালো আন্তর্জাতিক সমর্থনের আশা জাগাবে।

এই সফরের একটি উল্লেখযোগ্য ও স্বাগত ফলাফল হতে পারে রাখাইন রাজ্যের প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে কার্যকর ও গভীর আলোচনার চ্যানেল প্রতিষ্ঠা, যার মধ্যে আরাকান আর্মি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলের ক্রমবিকাশমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি সম্ভাব্য পরিবেশ তৈরি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের এই জটিল প্রেক্ষাপট সামলানোর জন্য জোরালো আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজন। এবং মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ও কৌশলগত স্বার্থের কারণে চীন এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপনে সহযোগিতা করতে পারে। চীন তার কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে বাংলাদেশ ও রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবধান কমাতে সাহায্য করতে পারে, যা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতির প্রচার করতে পারে। এ ধরনের প্রচেষ্টা শুধু বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক মানবিক ও নিরাপত্তা উদ্বেগই মেটাবে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে অঞ্চলীয় স্থিতিশীলতাতেও অবদান রাখবে।

এ সফরে শক্তিশালী বাক্যালাপ ও আকাঙ্ক্ষামূলক বিবৃতি দেওয়া হবে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীরকরণ ও বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেবে। ফোকাসের মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে থাকতে পারে—

কৃষি, শক্তি, সংযোগ, পানি ব্যবস্থাপনা ও শিল্প উন্নয়নের মতো খাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর আলোচনা হতে পারে। ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) সইয়ের সম্ভাবনা অন্বেষণ করা হতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে প্রদত্ত চীনের ঋণের শর্তাবলি, যেমন উচ্চ সুদের হার ও স্বল্প মেয়াদে পরিশোধের বিষয়ে উদ্বেগ মোকাবিলা করা হতে পারে।

বাংলাদেশ চীন থেকে উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করার ওপর গুরুত্বারোপ করবে, যেন দেশের কৃষি খাত আধুনিকায়ন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। হুয়াওয়ের হাইটেক কারখানা পরিদর্শন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে সহযোগিতার সুযোগ তুলে ধরবে।

এ ছাড়াও আলোচনায় ‘সানসেট ইন্ডাস্ট্রিজ’ ধারণা উঠে আসতে পারে, যেখানে চীনের দক্ষতা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে পতনশীল খাতগুলোর রূপান্তর বা পুনরুজ্জীবনের উপায় অন্বেষণ করা হতে পারে। এই আলোচনাগুলো আশার জন্ম দেবে। তবে বাস্তব পরীক্ষা হবে এই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তব, পারস্পরিক উপকারী ফলাফলে রূপান্তর করার মধ্যে।

এ সফর শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনা তুলে ধরবে। তবে বাস্তব অগ্রগতি বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের ওপর এই সফরের প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করবে।

চীন এই সফর থেকে আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক ভূ-রাজনৈতিক সর্বাধিক লাভের চেষ্টা করবে। চীন এই সফরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব শক্তিশালী করার সুযোগকে কাজে লাগাবে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ তার নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থকে বাস্তবতার সীমাবদ্ধতায় এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। দেশের ভূ-রাজনৈতিক চাহিদাগুলো জোরালোভাবে তুলে ধরবে। পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতিতে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখবে। চীন স্পষ্টভাবে জানে, যদিও বর্তমান সরকার জনপ্রিয়, তবে এটিও সত্য যে এই ইউনূস সরকার অনেক অভ্যন্তরীণ ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যা বেইজিংকে শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি চুক্তি ও সমঝোতায় এখনই রাজি হওয়া থেকে বিরত রাখবে।

বাংলাদেশের জন্য, এই সফরটি তার অগ্রাধিকারগুলোর ওপর জোর দেওয়ার একটি বড় সুযোগ। এই অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম হলো— অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও আন্তঃসীমান্ত ইস্যু। পাশাপাশি এটি পরিষ্কার করে জানান দেওয়া, বাংলাদেশ কোনো একক অংশীদারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হবে না।

এ সফরের আলোচনাগুলো আকাঙ্ক্ষামূলক বিবৃতি ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতার কাঠামোর ওপর গুরুত্বারোপ করবে। তবে এই সফরে প্রকৃত অগ্রগতি ও বাস্তব ফলাফল সীমিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উভয় পক্ষই দীর্ঘমেয়াদি কোনো চুক্তির চেয়ে সতর্ক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেবে। এই সফর পরিবর্তনমূলক ফলাফল প্রদানের চেয়ে ভবিষ্যৎ সম্পৃক্ততার ভিত্তি স্থাপনের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে