সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ, হাসনাতের অস্বীকার

ডয়চে ভেলে
চলতি বছরে ১৫০ জনেরও বেশি টেলিভিশন সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (প্রতীকী ছবি)

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ মালিক পক্ষকে ‘হুমকি’ দিয়ে ৫ সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে হাসনাত অভিযোগ অস্বীকার করেন। ফেসবুক পোস্টে তার দাবি, ‘আমরা সিটি গ্রুপে আমাদের প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলাম। আমরা কাউকে চাকরিচ্যুত করতে বলিনি বা তালিকা দেইনি। সময় টিভি আমার বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যকে বিকৃত করে অপপ্রচার চালাচ্ছিল এবং পতিত রাজনৈতিক দলের মত প্রচার করছিল।’

প্রকৃত ঘটনা এবং তার বর্তমান দাবি সম্পর্কে স্পষ্টতর ধারণা নিতে হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে, তবে ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি। ২২ ডিসেম্বর সময় টিভির যে পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করা হয় তারা হলেন, চিফ ইনপুট এডিটর ওমর ফারুক, চিফ আউটপুট এডিটর আরিফুল সাজ্জাদ, ডিজিটাল হেড কামাল শাহরিয়ার, সহযোগী বিশেষ প্রতিবেদক দেবাশীষ রায় ও সিনিয়র বিপোর্টার বুলবুল রেজা।

এর আগে ২৫ আগস্ট চাকরিচ্যুত করা হয় অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর খান মুহাম্মদ রুমেল এবং চিফ আউটপুট এডিটর লোপা আহমেদকে।

‘তোমরা না থাকলে সময় টিভি ঝুঁকিমুক্ত হবে’

সময় টিভির চাকরিচ্যুত সিনিয়র বিপোর্টার বুলবুল রেজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমি ২১ তারিখ নাইট ডিউটির পর বাসায় ছিলাম। ২২ তারিখ সকালে আমাদের ফোনে অফিসে ডেকে নিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। আমরা কারণ জানতে চাইলে সময় টিভির চেয়ারম্যান মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদেরও তো কর্তৃপক্ষ আছে, সেট হলো সিটি গ্রুপ (সময় টিভির ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান)। সিটি গ্রুপ মনে করে তোমরা পাঁচজন যদি না থাকো তাহলে সময় টিভি ঝুঁকিমুক্ত হয়।’ আমাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়। আমরা পদত্যাগ করতে রাজি না হলে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরিচ্যুতির চিঠিতে তারা কোনো কারণ উল্লেখ করেননি।’

‘আমরা এরই মধ্যে জানতে পারি কোনো একজন সমন্বয়ক সিটি গ্রুপ অফিসে দলবল নিয়ে গিয়ে ১০ জনের তালিকা দিয়ে আসে, যাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে। তার পরিবর্তে যাদের নিয়োগ দেয়া হবে, তাদের তালিকাও দিয়ে আসেন তিনি,’ বলেন বুলবুল রেজা।

‘গালগল্প সাজিয়ে চাপ দিয়ে চাকরিচ্যুত করানো হয়েছে’

চাকরি হারানো আরেক সাংবাদিক ওমর ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের সময় টিভি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সমন্বয়ক হাসনাতের নেতৃত্বে সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেবের দপ্তরে একটি দল গিয়েছিল। তারা একটি লিস্ট দিয়েছে। সেই লিস্টে আমাদের নাম আছে এবং আমাদের যদি চাকরি থেকে বাদ দেয়া না হয় তাহলে ওনার সমস্যা হবে। তার যে শিল্প গ্রুপ আছে, সেই গ্রুপের সমস্যা হবে এবং সময় টিভির সমস্যা হবে।’

‘অন্যায়ভাবে গালগল্প সাজিয়ে চাপ দিয়ে আমাদের চাকরিচ্যুত করানো হয়েছে। তারা যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে, তার ফলে এখন নতুন চাকরির ক্ষেত্রেও আমাদের একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে,'’ বলেন তিনি।

‘এএফপি যে নিউজ করেছে তাতে সত্যতার অভাব নেই’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাসানকে বার বার ফোন করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সময় টিভির এডিটোরিয়াল উপদেষ্টা নিয়াজ মোর্শেদ বলেছেন, ‘তাদের চাকরিচ্যুত করার মালিক তো আমি না। আমি এখানে উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করি। তাদের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত করেছে। তাই কারণ তারা বলতে পারবে। তবে আপনারা যা শুনেছেন কিছু কিছু জায়গায় এমন খবর ছাপা হয়েছে। এএফপি একটা নিউজ করেছে। ওইসব খবরে যা বলা হয়েছে, তাতে সত্যতার খুব একটা অভাব নেই।’

‘গিয়েছিলাম দাবি জানাতে, দাবি করা যেতেই পারে’

অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুক পোস্টে দাবি করছেন, ‘সময় টিভির সাংবাদিকদের বরখাস্ত করতে সিটি গ্রুপকে বাধ্য করার অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা সিটি গ্রুপ অফিসে গিয়েছিলাম দাবি জানাতে। দাবি করা যেতেই পারে।’

‘জুলাই বিদ্রোহের সময় সময় টিভির গণবিরোধী ভূমিকার বিষয়ে আমরা সময় টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে কথা বলেছি। আমরা বরখাস্তের জন্য মালিকদের সাংবাদিকদের কোনো তালিকা সরবরাহ করিনি। আমরা টিভি স্টেশনের শেয়ারও দাবি করিনি। আমরা বারবার বলেছি যে, আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি’ ফেসবুকে এ কথাও লিখেছেন হাসনাত।

সময় টেলিভিশনের সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘উনি (হাসনাত আব্দুল্লাহ) এটা ব্যক্তিগতভাবে করেছে। এটা যদি অপরাধ হয়, আইনি মেকাবেলা করতে হবে তাকে। তবে তারা (চাকরিচ্যুত সাংবাদিকরা) শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী করেছে। তাদের ব্যাপারে মানুষ ক্ষুব্ধ। তবে এটা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হওয়া উচিত ছিল।’

দলবল নিয়ে গিয়ে হুমকি দিয়ে সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করাও তথাকথিত মবজাস্টিস কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হুমকি দিয়েছেন বলে শুনিনি। আমরা শুনেছি, তিনি রিকোয়েস্ট করেছেন। এটা সিটি গ্রুপের মালিকই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা সামনের নির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে দেখবে আসলে বিষয়টি কী ঘটেছে।’

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে হামলা ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। বেশ কয়েকটি পত্রিকা অফিসেও হামলা চালানো হয়। এরপর কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেয়া হয়। কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত ১৬৭ জন সাংবাদিক ও সম্পাদকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে।

চলতি বছরে ১৫০ জনেরও বেশি টেলিভিশন সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার। এ সময়ে বেশ কিছু সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাও চাকরিচ্যুত হয়েছেন৷

ঢাকা রিপোর্টর্স ইউনিটির সভাপতি আবু সালেহ আকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তারা সবাই যে সাংবাদিক তা নয়। তাদের কেউ কেউ ম্যানেজমেন্টের লোক।’

তিনি বলেন, ‘সময় টিভিতে যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এর দায় মালিককে নিতে হবে। আর বৈষম্যবিরোধীরা তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা তারা অভিযোগ দিতে পারতেন, এই সেক্টরে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা সরকারকে দেখতে হবে। সরকারের কাছে অভিযোগ দিতে হবে। কিন্তু কেউ গিয়ে তালিকা দিয়ে আসবে আর তাদের মালিক চাকরিচ্যুত করবে সেটা হয় না।’

বাকস্বাধীনতা বিষয়ক সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাবেক প্রধান শেখ মঞ্জুর ই আলম বলেন, ‘যা ঘটছে তা সাংবাদিকদের জন্য আরো বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। এটা উদাহরণ তৈরি করছে। যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের বিরুদ্ধে লিখলে যদি হয়রানি হয়, চাকরি যায় তাহলে পরে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও একই কাজ করবে। অতীতেও এটা দেখেছি।’

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জুলাই সনদ সইয়ে জটিলতার সমাধান কোথায়

ঐকমত্য কমিশনে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার অনেকগুলোতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে বা ঘোরতর দ্বিমত জানিয়েছে। এসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ঘোরতম দ্বিমতকে কোনোভাবে ঐকমত্য হিসেবে ধরা যাবে না।

৬ দিন আগে

বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য: মানবতার নীরব বিশ্বাসঘাতকতা

ক্ষুধা ধীরে হত্যা করে, ভেজাল নীরবে হত্যা করে। খাদ্যে ভেজাল কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে চার লাখ ২০ হাজার মানুষ মারাও যায়।

৭ দিন আগে

ইতিহাসের সাক্ষী আহমদ রফিক

এ জাতির মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে কে হবেন কান্ডারী? আমরা কি সেই ইতিহাসের ভারবাহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছি? না পারার দায় কার? লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

৯ দিন আগে

তিন শূন্যের পৃথিবী গড়া জাতিপুঞ্জের সকলের স্বপ্ন হোক

গত আট দশক ধরে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে । বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০ টি দে

১৫ দিন আগে