আওয়ামী লীগের থাকা, না থাকা

ডয়চে ভেলে
ঢাকার গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

শহীদ নূর হোসেন দিবসে রবিবার (১০ নভেম্বর) ঢাকার গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হঠাৎ মাঠের রাজনীতি উত্তপ্ত হলেও সেখানে সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

আর ওই এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন। আর ছিলো বিপুল সংখ্যক পুলিশ। তবে আওয়ামী লীগ সন্দেহে ওই এলাকায় প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে মারধরের পর তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধাও মারপিটের শিকার হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেছে বিএনপি।

আওয়ামী লীগ রবিবার বিকেল তিনটায় তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছিলো। তবে তাদের এই কর্মসূচির তৎপরতা প্রধানত ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখা গেছে। আর ওই কর্মসূচি ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা শনিবারই ওই এলাকায় ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী’ সমাবেশ ঘোষণা করে। রবিবার সকাল ১১টায় কর্মসূচির সময় দেয়া হলেও শনিবার রাত থেকেই তারা জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়। রবিবার সারাদিনই সেখানে ছিলো।

এদিকে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষার পর শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম তার এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘‘বর্তমানে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিস্ট দল। বাংলাদেশে এই ফ্যাসিস্ট দলকে বিক্ষোভ করতে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।” তার কথা, গণহত্যাকারী ও স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নির্দেশে যদি কেউ সমাবেশ, সমবেত হওয়া ও মিছিলের চেষ্টা করে তাহলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তির মুখোমুখি হতে হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ধরনের সহিংসতা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা সহ্য করবে না বলেও উল্লেখ করেন প্রেস সচিব। আর শনিবার রাত থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে সতর্ক অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সারাদেশে মোতায়েন করা হয় ১১৯ প্ল্যাটুন বিজিবি।

৫ আগস্ট শেখ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর রবিবার তারা প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি দেয়। তারা কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। দলটির অধিকাংশ নেতা হয় গ্রেপ্তার অথবা পলাতক আছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা যা বলছেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ মনে করেন আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের কাছে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। ‘দলটিকে ৫ আগস্টের পরে আসলে এদেশের মানুষ অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে তারা যখনই কোনো কর্মসূচির নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আসে মানুষ তাদের প্রতিরোধ করে। এবারও তাই হয়েছে,’ বলেন তিনি।

তার কথা, তাদের আর রাজপথে আসার কোনো সুযোগ নেই। যারা অপরাধ করেছে, গণহত্যা করেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আর যারা সাধারণ সমর্থক বা অপরাধ করেনি তাদের তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলে কীভাবে মূল ধারার রাজনীতিতে আনা যায় সেটা রাজনৈতিক দলগুলো বসে সিদ্ধান্ত নেবে।’

আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে সরকার এরইমধ্যে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে এখনো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাহলে তাদের সভা সমাবেশে সরকার বাধা দেবে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের ডাকে মানুষ সাড়া দেয়নি। তাদের ডাকে তো কেউ রাস্তায় নেমে আসেনি। মানুষ তাদের নিষিদ্ধ করেছে। ফলে দেশের মানুষ তাদের সাথে নাই। সরকার কোনো বাধা দেয় নাই।’

আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের নিশ্চয়ই রাজনীতি করার অধিকার আছে যেহেতু সরকার এখনো তাদের নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু আমাদের কথা হলো, তারা ফ্যাসিস্ট। তারা গণহত্যা চালিয়েছে। তাই আগে তাদের বিচার করতে হবে। তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারবে না।’

‘তারা এখনো অনুতপ্ত নয়, তারা গণহত্যার জন্য ক্ষমাও চায়নি। এখনো তারা দম্ভ করছে। এই খুনি, ফ্যাসিস্টদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই,’ বলেন তিনি।

রাজনৈতিক দলের অবস্থান

মানবতা বিরোধী আইনের যে সংশোধন প্রক্রিয়ায় সরকার যাচ্ছে তাতে দলের বিচারও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এরইমধ্যে অবশ্য গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনাসহ আরো অনেক নেতার বিচার শুরু হয়েছে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল রবিবার বলেছের, ‘শেখ হাসিনাকে ধরে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হবে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি একথা বলেন। আর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তজুল ইসলাম বলেছেন, ‘দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচারের জন্য তদন্ত প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। শুরু হলে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা শুরু থেকেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবিতেই সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে।’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘এই দলটি দেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তার তো এই দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই।’

তার কথা, রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু যারা দেশের জনগণকে হত্যা করে, যারা ফ্যাসিস্ট তারা কীভাবে রাজনীতি করে? তাদের ব্যাপারে দেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে। এই দেশের মানুষ তাদের রাজনীতি আর গ্রহণ করবেনা। তারা এখনো দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি।

আর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। তাতে ওই দলটির প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বিচারের মধ্য দিয়ে আসতে হবে।’

‘আওয়ামী লীগ যে অপরাধ করেছে তার বিচার এবং তারা জাতির কাছে এর জন্য অনুশোচনা এবং ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে কীভাবে ফিরতে চায় তার ওপর দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে,’ বলেন তিনি।

আর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মন্নান বলেন, ‘আমি মন্ত্রী ছিলাম কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটিতে আমি নাই। আমি সংবাদ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির কথা জেনেছি। নেতারা কে কোথায় আছেন তাও জানি না। আমি আমার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিষিদ্ধ না হলেও আওয়ামী লীগকে সভা-সমাবেশ করতে কেন দেয়া হচ্ছে না তা তো সরকার বলতে পারবে। এটা সরকারের বিষয়। আর দলের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আমার কিছু জানা নাই।’

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেহেতু কোনো নিষিদ্ধ দল নয় তাই সংবিধান অনুযায়ী সভা সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকার তাদের আছে।’

৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতে দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার কোনো প্রক্রিয়া যদি ভবিষ্যতে দেখা যায় তাহলে আওয়ামী লীগ আবার ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। আর তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী হবে বলে মনে করি।’

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৫ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৬ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৬ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

১০ দিন আগে