সংসদের বিরোধীদল জাপা না তৃণমূল বিএনপি?

শাহরিয়ার শরীফ
জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি

রাজনীতিতে বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে— এ বিষয়ে খুব একটা বিতর্ক নেই।  কিন্তু জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কে হবে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ও যুক্তিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও গত দুই মেয়াদে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি যে এবারও বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে, সেই সম্ভাবনা অনেকটাই কম দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

 

জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে আসন ভাগাভাগিতে আগ্রহী। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা। বৈঠকের পর দুই দলের পক্ষ থেকেই দাবি করা হয়, নির্বাচনে আসন বন্টন নিয়ে আলোচনা হয়নি।

 

বিরোধী দল কারা হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই গুঞ্জনের মধ্যে চমকও আছে। তাহলো এবার জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে নতুন দল আসতে পারে। কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে।

 

গত ৬ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‌‘দাঁড়িয়ে যাবে বিরোধী দল। এখানে আরো অনেক দল আছে না? এখানে তৃণমূল আছে না? তৃণমূল তো বিরাট জোট। তাদেরকে আপনি বিচ্ছিন্ন করবেন কেমন করে? সুপ্রিম পার্টি আছে, আরো কত পার্টি।’

 

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী অংশের প্রতি আওয়ামী লীগের যে আস্থা রয়েছে, জিএম কাদেরপন্থীদের প্রতি সেই আস্থা নেই। ফলে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল ও দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসানোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের আস্থা নেই। 

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘রওশন এরশাদ শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিনি নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের একটা সহানুভূতি পেতেন। তা ছাড়া জাতীয় পার্টিতে তিনি সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত। জাতীয় পার্টির দলীয় কোন্দল ও হিসাব-নিকাশের মধ্যে রওশনপন্থীরাই ছিটকে পড়েছেন। ফলে তাদের নিয়ে এই মুহূর্তে সরকারের ভাবনার কোনো সুযোগ নেই।

 

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বরাবরই আওয়ামী লীগ-বিরোধী অবস্থানে রয়েছেন এবং তিনি সরকারের কড়া সমালোচক। ২০১৪ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে জিএম কাদের উৎসাহিত করেছিলেন। সরকারি দলের মূল্যায়ন হচ্ছে, জিএম কাদেরকে বোঝা কঠিন। তার ওপর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আস্থা কম। সেক্ষেত্রে তাকে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার সুযোগ দিলে সরকার অস্বস্তিতে পড়তে পারে।

 

অবশ্য জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেছেন, কারো সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষযটি তারা ভাবছেন না। এককভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যই ২৮৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছে জাতীয় পার্টি। তবে এটাও সত্য যে, নির্বাচনের মাঠের যে অবস্থা তাতে সরকারের সমর্থন না পেলে জাতীয় পার্টির কয়েকটি আসন পাওয়া বেশ কঠিন হতে পারে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সমঝোতা না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে থাকা জাপা নেতাদের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ। 

২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা কেবল ওইসব আসনেই জয় পেয়েছে যেখানে সমঝোতা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি।

এ থেকে বোঝা যায় যে, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শক্তি জাতীয় পার্টির নেই।

দাঁড়িয়ে যাবে বিরোধী দল। এখানে আরো অনেক দল আছে না? এখানে তৃণমূল (তৃণমূল বিএনপি) আছে না? তৃণমূল তো বিরাট জোট। তাদেরকে আপনি বিচ্ছিন্ন করবেন কেমন করে? সুপ্রিম পার্টি আছে, আরো কত পার্টি।
ওবায়দুল কাদের
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

জাতীয় পার্টির নেতাদের একাংশ মনে করছেন, দলে জিএম কাদেরের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও রওশন পন্থীদের কোণঠাসা করতেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আকস্মিক ঘোষণা দেন সরকারবিরোধী মনোভাব পোষণ করা জিএম কাদের। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে দলের বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির বন্ধুপ্রতীম বলে পরিচিত একটি দেশের চাপ থাকার গুঞ্জন রয়েছে।

 

গত ১৪ নভেম্বর থেকে প্রায় এক মাস দলটির প্রধান জিএম কাদের মিডিয়ার সামনে আসছেন না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ছাড় নিয়ে দলটি সংকটময় পরিস্থিতিতে আছে। এটিও জিএম কাদেরের নীরব থাকার অন্যতম কারণ বলে দলীয় নেতারা মনে করছেন।

এদিকে সাবেক কূটনীতিক শমসের মুবিন চৌধুরী এবং বিএনপির সাবেক নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল বিএনপি ২৩০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এম এ আউয়ালের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল ইসলামিক জোট। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত ওই জোটে রয়েছে ১৫টি রাজনৈতিক দল। 

 

জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হচ্ছে—ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি, নেজামে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরীকত ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী জনতা দল (বিএনজেপি), ইসলামী লিবারেল পার্টি, জনতার কথা বলে, বাংলাদেশ স্বাধীন পার্টি, বাংলাদেশ গণতন্ত্র মানবিক পার্টি, সাধারণ ঐক্য আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামিক গণতান্ত্রিক লীগ ও বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক ফোরাম।

 

তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘আমরা যে জোট গঠন করেছি, সে জোট নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’

দলটির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ ১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। দলের এই শীর্ষ নেতা সরকারি দলের আশীর্বাদ না পেলে বিজয়ী হতে পারবেন- এমন নিশ্চয়তা নেই।  ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈমুর আলম খন্দকারের একটি কথোপকথনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন দাখিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তাকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে মনোনয়ন জমা দিতে বলা হচ্ছিল। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তৈমুর বলেন, ‘তৈমুর এক কথার মানুষ’।

 

এদিকে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরীর নির্বাচনী আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নুরুল ইসলাম নাহিদের শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

 

তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে ও দলটির নির্বাহী চেয়ারম্যান অন্তরা হুদা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে। আসনটি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনসঙ্গী বিকল্প ধারার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এবার ঋণ খেলাপির অভিযোগে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। 

 

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপি গঠন করেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন তিনি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর নাজমুল হুদা মারা যান।

২০১৫ সালে গঠিন তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় গত ১৯ সেপ্টেম্বর, যেখানে নেতৃত্ব নেন শমসের মুবিন ও তৈমুর আলম। দলটি ইতিমধ্যে ‌কিংস পার্টি নামে পরিচিতি পেয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা দলগুলো কিংস পার্টি নামে পরিচিতি। তবে এতো অল্প সময়ের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল সংসদে বিরোধী দল হয়ে উঠলে তা হবে রাজনীতিতে নতুন ধরনের রেকর্ড।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যালোচনা করে বলছেন, এবারের নির্বাচন হবে মূলত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ মনোনীত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে। গুটিকয়েক ব্যতিক্রম বাদে সরকারের হস্তক্ষেপ বা সমর্থন ছাড়া অন্য দলের প্রার্থীদের পাস করে আসা কঠিন হবে। তাই সংসদে বিরোধী দল কে হবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব পরোক্ষভাবে সরকারের ওপরই বর্তাচ্ছে। কারণ সরকারি দলের আশীর্বাদ ছাড়া বিরোধী প্রার্থীর বিজয় সর্বত্রই বেশ কঠিন। এই পরিস্থিতিতে সরকার হয়তো এমন কোনো দলকে বিরোধী দল বা এমন কোনও নেতাকে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসাবে না, যার ওপর আস্থার ঘাটতি আছে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৬ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৭ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৭ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

১১ দিন আগে