ইতিহাস

গিরিয়ার যুদ্ধ এবং আলীবর্দী খাঁর উত্থান

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৪: ১৮
চ্যাটজিপিটির চোখে গিরিয়ার যুদ্ধে আলীবর্দী খাঁ

ভারতবর্ষের ইতিহাসে গিরিয়ার যুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত ঘটনা। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত এই যুদ্ধ শুধুমাত্র দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নবাবের সংঘর্ষ ছিল না—এটি ছিল বাংলার নবাবি ইতিহাসের এক চূড়ান্ত রূপান্তরের প্রতীক, যার প্রভাব পরবর্তী দশকগুলোতে গভীরভাবে পড়েছিল। এই যুদ্ধে একদিকে ছিলেন বাংলার স্বঘোষিত নবাব আলীবর্দী খান, অন্যদিকে সুপরিচিত নবাব সূজাউদ্দিন মোহাম্মদের পুত্র সরফরাজ খান। যুদ্ধস্থল ছিল গঙ্গার তীরবর্তী গিরিয়া নামক স্থান, যা বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত।

গিরিয়ার যুদ্ধ মূলত বাংলার ক্ষমতা কাঠামো ও প্রশাসনিক নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। শাসন, রাজনীতি, সামরিক কৌশল ও কূটনীতির ইতিহাসে এই যুদ্ধ এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করে।

১৭৩৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবাব শুজাউদ্দিন মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান বাংলার নবাব হন। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, সরফরাজ খান শাসনের দিক থেকে দুর্বল ছিলেন। প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষতা বা কৌশলী নেতৃত্বের ঘাটতি ছিল তাঁর। অপরদিকে, তাঁর সেনাপতি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আলীবর্দী খান ছিলেন এক কুশলী ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি, যিনি আফগান ও পারসিক যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী ছিলেন এবং অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার তাঁর “অরিসা” (Orissa) বইয়ে লিখেছেন—আলীবর্দী খানের চেহারা বা পরিবার তাঁকে নবাবির উপযুক্ত করত না, কিন্তু তাঁর সামরিক জ্ঞান ও কূটনৈতিক প্রতিভাই তাঁকে বাংলার সিংহাসনে বসিয়েছিল।”

সরফরাজ খান আলীবর্দী খানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও সৈন্যসংগঠনের বিষয়টি বুঝতে পেরেও তাঁকে উপেক্ষা করেন। এরই মধ্যে আলীবর্দী খান ধীরে ধীরে তাঁর অনুগত সেনাপতি ও প্রভাবশালীদের সহায়তা লাভ করেন। তিনি সেক্রেটভাবে দিল্লির মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের কাছ থেকে ‘বাংলা, বিহার ও ওড়িশার নবাব’ হিসেবে ফারমান সংগ্রহ করে আনেন। এই কৌশলেই শুরু হয় সরাসরি সংঘাতের রাস্তা।

১৭৪০ সালের এপ্রিল মাসে আলীবর্দী খান তাঁর বাহিনী নিয়ে গিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। যুদ্ধ শুরু হয় ১০ এপ্রিল। যুদ্ধস্থলে দুই পক্ষের সৈন্যসংখ্যা প্রায় সমান হলেও আলীবর্দীর নেতৃত্বে তাঁর সেনারা ছিল সুসংগঠিত ও অনুশাসনময়।

যুক্তরাজ্যের গবেষক জন ড্রেইপার তাঁর বই “মুঘল ওয়ারফেয়ার ইন দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার”-এ লেখেন, “আলীবর্দী তাঁর সৈন্যদের মনোবল ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে যুদ্ধজয়ের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে সরফরাজ ছিলেন আত্মতুষ্ট ও নির্বিকার।”

গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খান নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর আলীবর্দী খান নিজেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার একমাত্র নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি শাসনক্ষমতা দখল করে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তী ১৬ বছর বাংলার নবাব হিসেবে রাজত্ব করেন।

এই যুদ্ধের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন পর্ব শুরু হয়। আলীবর্দীর শাসনকাল ছিল একদিকে বহিরাগত আক্রমণের মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সময়কাল। তিনি মারাঠাদের একাধিকবার বাংলায় আক্রমণের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করেন।

ফ্রান্সের ইতিহাসবিদ হেনরি ব্লোকেট তাঁর বই “হিস্ট্রি অব দ্য মুসলিম রুল ইন বেঙ্গল”-এ মন্তব্য করেন—“গিরিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি প্রশাসনিক বিপ্লব, যেখানে দক্ষতার মাধ্যমে রাজশক্তির পূর্ণ রূপান্তর ঘটেছিল।”

গিরিয়ার যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বাসঘাতকতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও রাজনীতির এক বাস্তব পাঠ। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে, শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য ও নেতৃত্বের অভাবে যে কোনো স্থাপিত শাসনব্যবস্থা কতটা দ্রুত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

একই সঙ্গে যুদ্ধটি দেখিয়ে দেয়, কীভাবে এক সামান্য পদাধিকারীও যদি কৌশলগত দৃষ্টিতে সক্ষম হন, তবে তিনি পরিণামে রাজ্যের চূড়ান্ত ক্ষমতাও দখল করতে পারেন। আলীবর্দীর উত্থান ছিল এই বাস্তবতার নিদর্শন।

তবে, আলীবর্দী খানের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলেও বাংলার গণমানুষের জীবনযাত্রায় সে সময়কার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সংস্কারের প্রভাব পড়েছিল কমই। যুদ্ধ পরবর্তী সময় ছিল মারাঠা আক্রমণ, চুরি-ডাকাতি, দুর্ভিক্ষ ও কর নির্যাতনের সময়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ বারবারা মেটকাফ তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন—“যুদ্ধ বিজয়ের পরও আলীবর্দী খান সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে খুব একটা উদ্যোগী হননি।”

গিরিয়ার যুদ্ধ ছিল বাংলার নবাবি ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই যুদ্ধের পরপরই শুরু হয় এক নতুন শাসনের যাত্রা, যার মধ্যে যেমন ছিল নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টার আভাস, তেমনি ছিল রাজনীতির নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও ক্ষমতার জন্য বিশ্বাসঘাতকতার গল্প।

যে আলীবর্দী খান একসময় সরফরাজ খানের সৈন্যদলে কাজ করতেন, সেই তিনিই পরে সরাসরি সংঘর্ষে তাঁকে পরাজিত করে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করেন। এই যুদ্ধ তাই শুধুই এক সামরিক দ্বন্দ্ব নয়—এটি রাজনীতির শত্রু-মিত্রতা, কৌশল, এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তব পাঠশালা।

আজও গিরিয়া নামটি ইতিহাসের পাতায় হয়তো অতটা উজ্জ্বল নয়, কিন্তু ১৭৪০ সালের সেই যুদ্ধ বাঙালি ইতিহাসের মোড় ঘোরানো এক গল্প। ইতিহাস সচেতন পাঠকদের কাছে এই অধ্যায় তাই সবসময়ই প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষনীয়।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

মামলাবাজ, চাঁদাবাজদের দিন ফুরিয়ে আসছে: হাসনাত আব্দুল্লাহ

দেশে যারা মামলা বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে বলে সতর্ক করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

৫ ঘণ্টা আগে

২০২৪ সালে বিএনপির আয় ১৫.৬৫ কোটি টাকা: রিজভী

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিগত এক বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দিয়েছে । ২০২৪ সালে দলটির আয় হয়েছে ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪২ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৪ হাজার ৮২৩ টাকা। বর্তমানে দলটির ফান্ডে জমা আছে ১০ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার ১৯ টাকা।

৬ ঘণ্টা আগে

সেনাপ্রধানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সারজিস

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা, আর্থিক সহযোগিত ও পুনর্বাসনের জন্য সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের প্রশংসা করেন এনসিপির শীর্ষ এই নেতা।

৬ ঘণ্টা আগে

ভোটের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর মুখোমুখি বিএনপি

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ প্রকট হয়েছে। সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দূরত্ব দেখা দিয়েছে রাজপথে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে। একদিকে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে পিআরের পক্ষে থাকা জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক

৬ ঘণ্টা আগে