স্বাস্থ্য

দ্রুত ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১৪: ৫২

ডায়েবেটিস বা বহুমূত্র রোগ এখন শুধু বার্ধক্যের নয়, বরং তরুণদের মাঝেও এই রোগ দেখা যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ১১ জনে ১ জন মানুষ ডায়েবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশও এই তালিকায় পিছিয়ে নেই। আমাদের দেশে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ইনসুলিন নিচ্ছেন কিংবা ওষুধ খাচ্ছেন রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই রোগ কি কেবল ওষুধে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? নাকি কিছু সহজ জীবনযাপনের অভ্যাস বদলেই এই রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব?

ডায়েবেটিস মূলত এমন একটি রোগ, যেখানে শরীর ইনসুলিন নামক হরমোনটি ঠিকমতো উৎপাদন করতে পারে না বা উৎপাদিত ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করে না। এর ফলে শরীরে গ্লুকোজ জমতে থাকে এবং রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যায়। এই মাত্রা যদি দীর্ঘ সময় ধরে বেশি থাকে, তাহলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে পারে—বিশেষ করে কিডনি, চোখ, হৃদযন্ত্র এবং স্নায়ুতে। তাই রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত জরুরি।

বিশ্বখ্যাত মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ড. মার্ক হাইম্যান বলেন, “ডায়েবেটিসকে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা পরিবর্তন। ওষুধ একধরনের ব্যান্ডএইডের মতো কাজ করে, কিন্তু রোগের শিকড়ে আঘাত করতে হলে আমাদের খাদ্য এবং শরীরচর্চার দিকে নজর দিতে হবে।” ড. হাইম্যান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক-এর ফাংশনাল মেডিসিন সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং তাঁর লেখা "The Blood Sugar Solution" বইটি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত।

প্রথমেই আসা যাক খাদ্যাভ্যাসের দিকে। অতিরিক্ত চিনি, ময়দা ও প্রক্রিয়াজাত খাবার শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। তাই যাঁরা দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে চান, তাঁদের এই ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি। এর বদলে খাবারে রাখা উচিত বেশি করে আঁশযুক্ত শাকসবজি, যেমন করলা, পুঁইশাক, লাউ, বরবটি, এবং বিটরুট। এইসব খাবারে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, অর্থাৎ এগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায়। এছাড়া বাদাম, ওটস, চিয়া বীজ, ডিম, দেশি মাছ, এবং কাঁচা আমলকী খাওয়াও খুব উপকারী। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পুষ্টিবিদ মারিয়া রোজ বলেন, “প্রাকৃতিক ও কম প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খেলে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ে এবং ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহজ হয়।”

বলা দরকার, শুধু কি খাবার ঠিক করলেই হবে? মোটেও না। একে সঙ্গ দিতেই হবে নিয়মিত হাঁটা কিংবা শরীরচর্চাকে। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা এক্সারসাইজ রক্তে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। ২০২৩ সালে “The Lancet Diabetes & Endocrinology” জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, “ডায়েটের পাশাপাশি শরীরচর্চা করলে টাইপ-২ ডায়েবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা গড়ে ১.৫% পর্যন্ত কমে যায়।” গবেষণাটি পরিচালনা করেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধ্যাপক ড. টম ইয়েটস।

মানসিক চাপও ডায়েবেটিস বাড়ার বড় কারণ। যখন আমরা চাপ অনুভব করি, তখন শরীরে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ হয়, যা আবার গ্লুকোজ উৎপাদন বাড়ায়। তাই ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান, প্রার্থনা বা নিঃশ্বাস-নিয়ন্ত্রণ চর্চা করা খুবই উপকারী। আমেরিকার হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ড. হারবার্ট বেনসন বলেন, “ধ্যান বা মেডিটেশন শুধু মন শান্ত রাখে না, বরং এটি শারীরিক হরমোনের ভারসাম্যও রক্ষা করে, যার প্রভাব পড়ে রক্তে শর্করার মাত্রাতেও।”

একটি জরুরি বিষয় হলো ঘুম। অপর্যাপ্ত ঘুম বা রাতে ঘন ঘন জেগে ওঠা ডায়েবেটিস বাড়িয়ে দিতে পারে। ঘুম ঠিক না হলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যায়, অর্থাৎ শরীর ইনসুলিনের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাই প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা নিরবিচারে ঘুমানো অত্যন্ত জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH) তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, “ঘুমের ঘাটতি টাইপ-২ ডায়েবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় অন্তত ৩০%।”

তবে এসবের পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণ করাও খুব জরুরি। কারণ অতিরিক্ত মেদ শরীরের ইনসুলিন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। যাঁদের পেটের চারপাশে মেদ বেশি, তাঁদের ডায়েবেটিসের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। তাই ওজন ঠিক রাখা, বিশেষ করে পেটের চর্বি কমানো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্যতম চাবিকাঠি।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সময়মতো খাবার খাওয়া। অনেকেই না খেয়ে থেকে একসঙ্গে অনেক খেয়ে ফেলেন—এটি খুব ক্ষতিকর। দিনে তিন বেলা পরিমাণমতো খাবার খাওয়া, এবং মাঝে মাঝে হালকা নাশতা শরীরের গ্লুকোজ ব্যবস্থাকে সহায়তা করে। এছাড়া রাতের খাবার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। কারণ রাতে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কম থাকে।

সবশেষে বলা যায়, ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণ কোনো একদিনের কাজ নয়। এটি একটি অভ্যাসের বিষয়। তবে বিজ্ঞান এবং পুষ্টিবিদরা একমত—যদি আমরা নিয়মিতভাবে খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তির দিকে নজর দিই, তাহলে ডায়েবেটিস অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আর প্রয়োজন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।

পরিচর্যা, ধৈর্য আর নিয়মিত অভ্যাস—এই তিনে মিলেই সম্ভব ডায়েবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে আনা। আমরা যদি নিজেকে ভালোবাসি, তাহলে শরীরের জন্য একটু সময় বের করাই উচিত। কারণ, সুস্থ শরীরেই সুস্থ মন এবং সুন্দর জীবন।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইরাক-ইরান যুদ্ধ: কেন হয়েছিল এই ভয়াবহ সংঘাত?

সাদ্দাম হোসেন তখন চাচ্ছিলেন নিজেকে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি ভাবেন, সদ্য বিপ্লব-পরবর্তী অস্থির ইরান দুর্বল অবস্থায় আছে, এই সুযোগে আক্রমণ করলে হয়তো ইরানের কিছু এলাকা দখল করে নেওয়া যাবে এবং খোমেনি সরকারের পতন ঘটানো যাবে।

২ দিন আগে

জিভে ঘা হয় কোন ভিটামিনের অভাবে?

শুধু ভিটামিনই নয়, জিভে ঘা হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো আয়রনের ঘাটতি। আয়রনের অভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, শরীরে অক্সিজেন পরিবহন কম হয় এবং কোষ দুর্বল হয়ে পড়ে।

২ দিন আগে

সাজিল ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে কাজ করে?

ই ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর কঠিন জ্বালানিচালিত ইঞ্জিন। কঠিন জ্বালানি ব্যবহারে একাধিক সুবিধা রয়েছে। তরল জ্বালানির মতো আলাদা ট্যাঙ্ক বা ফিলিংয়ের ঝামেলা নেই।

২ দিন আগে

শিশুদের পায়খানা না হলে কী করবেন?

শিশুদের হজমপ্রক্রিয়া বড়দের মতো নয়। তারা খাওয়ার পর অনেক সময় সহজে হজম করতে পারে না, আবার কিছু শিশু জন্মগতভাবেই একটু ধীরে হজম করে।

২ দিন আগে