যুদ্ধ

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

ইউরোপের ইতিহাসে অনেক যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, তবে ১০৬৬ সালের ব্যাটল অব হ্যাস্টিংস (Battle of Hastings) যেন আলাদা জায়গা দখল করে আছে। ইংল্যান্ডের ক্ষমতা, সংস্কৃতি, ভাষা, এমনকি রাজপরিবারের ভবিষ্যৎও এই এক যুদ্ধে পাল্টে যায়। একদিকে ছিল অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন, অন্যদিকে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি অঞ্চলের ডিউক উইলিয়াম , যিনি পরবর্তীতে ‘উইলিয়াম দ্য কংকারার’ নামে পরিচিত হন। ইতিহাসবিদদের মতে, এই যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং মধ্যযুগীয় ইউরোপের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেওয়ার মোড় ঘোরানো ঘটনা।

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, নরম্যান্ডির ডিউক উইলিয়াম দাবি করলেন যে, এডওয়ার্ড তাঁকে উত্তরাধিকারী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, হ্যারল্ডও নাকি আগে উইলিয়ামকে সমর্থন দেওয়ার শপথ করেছিলেন। যদিও হ্যারল্ড এ অভিযোগ মানতে নারাজ ছিলেন, তবুও এই দ্বন্দ্বই পরিণত হয় যুদ্ধে।

১০৬৬ সালের অক্টোবরে হ্যাস্টিংসের কাছে মুখোমুখি হয় দুই সেনা। হ্যারল্ডের সেনারা মূলত পদাতিক যোদ্ধা, যারা মজবুত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিল। অপরদিকে উইলিয়ামের সেনাবাহিনীতে ছিল দক্ষ অশ্বারোহী এবং ধনুকধারী সৈন্য। যুদ্ধ শুরু হয় সকাল থেকে এবং চলে পুরো দিন। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল হ্যারল্ডের সেনারা টিকে যাবে, কারণ তারা পাহাড়ি ঢালে দাঁড়িয়ে শক্ত প্রতিরক্ষা তৈরি করেছিল। কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে, উইলিয়ামের কৌশলই শেষ পর্যন্ত ফল দেয়। তিনি ভান করলেন যে তাঁর সেনারা পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে হ্যারল্ডের কিছু সৈন্য প্রতিরক্ষা ছেড়ে তাড়া করতে বেরিয়ে আসে। তখনই উইলিয়ামের অশ্বারোহীরা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের আক্রমণ করে। এই ফাঁদে পড়ে অ্যাংলো-স্যাক্সন সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

শেষপর্যন্ত রাজা হ্যারল্ড নিজেও নিহত হন। ‘বেইয়ু ট্যাপেস্ট্রি’, যা এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান ভিজ্যুয়াল রেকর্ড, সেখানে দেখা যায় যে একটি তীর হ্যারল্ডের চোখে গিয়ে লাগে এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। যদিও ইতিহাসবিদদের মধ্যে এ নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে—তাঁর মৃত্যু আসলেই এভাবে হয়েছিল কিনা। তবুও সাধারণভাবে এটি প্রচলিত গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উইলিয়ামের বিজয় শুধু একটি যুদ্ধ জেতা নয়, বরং ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ ইতিহাসকে পুরোপুরি নতুন দিকে নিয়ে যায়। তিনি ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং দেশের আইন, প্রশাসন ও সংস্কৃতিতে নরম্যান প্রভাব নিয়ে আসেন। পুরোনো অ্যাংলো-স্যাক্সন অভিজাতরা অনেকেই ক্ষমতা হারান, তাঁদের জায়গা দখল করে নরম্যান লর্ডরা। শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষাতেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ফরাসি ও ল্যাটিন শব্দ ইংরেজির সঙ্গে মিশে যায়, যা আজকের আধুনিক ইংরেজির ভিত্তি গড়ে তোলে।

বিদেশি গবেষকরা ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের গুরুত্ব নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ডেভিড হাওয়ার্ড লিখেছেন, “হ্যাস্টিংস শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি ছিল এক নতুন ইংল্যান্ডের জন্ম। এই যুদ্ধের আগে ইংল্যান্ড ছিল ইউরোপের প্রান্তে একটি দ্বীপ, কিন্তু এর পরে তা হয়ে ওঠে মহাদেশীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”

আমেরিকান গবেষক ও ইতিহাসবিদ ডেভিড বেটস বলেন, “উইলিয়ামের বিজয় ইংল্যান্ডকে প্রশাসনিক দিক থেকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তবে এই পরিবর্তন ছিল রক্তাক্ত এবং অনেক মানুষের জন্য কষ্টকর।”

আরেকজন ফরাসি গবেষক রেজিন পেরন মন্তব্য করেছেন, “হ্যাস্টিংস যুদ্ধ আসলে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করে। শুধু রাজনীতি নয়, ইংল্যান্ডের শিল্প, স্থাপত্য ও ভাষায় নরম্যান প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে।”

এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নানা কিংবদন্তি ও কাহিনি ছড়িয়ে আছে। অনেকেই মনে করেন, হ্যারল্ডের মৃত্যু ইংল্যান্ডের জাতীয়তাবাদের জন্য এক ট্র্যাজেডি। অন্যদিকে উইলিয়ামের বিজয়কে কেউ দেখেন আধুনিক ইংল্যান্ড গঠনের প্রথম ধাপ হিসেবে। সত্যিই দেখা যায়, যদি এই যুদ্ধ না হতো, তাহলে হয়তো আজকের ইংল্যান্ড ভিন্ন রকম হতো।

আজও হ্যাস্টিংস শহরে এই যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধক্ষেত্রকে এখন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সাজানো হয়েছে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে যুদ্ধের বার্ষিকী উপলক্ষে সেখানে ঐতিহাসিক পুনঃমঞ্চায়ন হয়, যেখানে যোদ্ধারা মধ্যযুগীয় পোশাক পরে যুদ্ধের দৃশ্য অভিনয় করেন। এতে শুধু ইতিহাসপ্রেমীরাই নয়, সাধারণ দর্শকরাও অতীতকে কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন।

সবশেষে বলা যায়, ব্যাটল অব হ্যাস্টিংস ছিল ইউরোপীয় ইতিহাসের এমন এক বাঁকবদলকারী মুহূর্ত, যা রাজনীতি, সংস্কৃতি আর ভাষার গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের অবসান ঘটিয়ে নরম্যান যুগের সূচনা করে এই যুদ্ধ ইংল্যান্ডকে নিয়ে যায় এক নতুন অধ্যায়ে, যার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায় আধুনিক ব্রিটিশ সমাজে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

'যারা সংস্কারের বিপক্ষে তাদের সঙ্গে কোনো জোট নয়'

হাসনাত বলেন, ‘টকশোতে এতদিন আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা আওয়ামী লীগের পক্ষে বৈধতা উৎপাদন করেছে। গত দুই দিনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আবারও স্পষ্ট হয়েছে তাদের বৈধতা দেওয়া সম্ভব না।’

১৭ ঘণ্টা আগে

স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের বাইরের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য নয় দলগুলো: বিএনপি

খন্দকার মোশাররফ বলেন, প্রায় এক বছরব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ভিত্তিতে 'নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত জুলাই জাতীয় সনদ গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী সেই সনদ বাস্তবায়নে সব পক্ষ অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে।

১৯ ঘণ্টা আগে

বিএনপির ফাঁকা রাখা ঢাকা-৯ আসনে তাসনিম জারা

দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। পোস্টে তিনি লিখেন, ডা. তাসনিম জারা ঢাকা-৯ (খিলগাঁও, মুগদা, সবুজবাগ, মান্ডা)।

১৯ ঘণ্টা আগে

ভোট হলে জামায়াতের অস্তিত্ব থাকবে না: মির্জা ফখরুল

ফখরুল বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাস সংস্কারের নামে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার পরও অমীমাংসিত বিষয়গুলো চাপিয়ে দিতে চাইলে এর দায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে।’

১৯ ঘণ্টা আগে