আবহাওয়া

নিম্নচাপ কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের আবহাওয়ার নিম্নচাপ খুব সাধারণ আবহাওয়াগত সমস্যা। এর ফলে সমুদ্র উত্তাল, মাছ ধরার নৌকাকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে কিংবা উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই নিম্নচাপ আসলে কেন তৈরি হয়? এর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ কী? বিষয়টি বোঝার জন্য আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে।

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় নিম্নচাপ হলো একটি এমন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি যেখানে বাতাসের চাপ চারপাশের তুলনায় কম হয়ে যায়। সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাতাস সবসময় উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়। যখন কোনো স্থানে বাতাস গরম হয়ে উপরে উঠে যায়, তখন সেই জায়গায় বাতাসের ঘনত্ব কমে যায় এবং একটি শূন্যতা তৈরি হয়। ওই শূন্যতা পূরণ করতে আশপাশের দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস ছুটে আসে। এর ফলেই সেখানে একটি নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হয়।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে গেলে বলতে হয়, পৃথিবীর পৃষ্ঠে সূর্যের আলো সমানভাবে পড়ে না। নিরক্ষরেখা অঞ্চলে সূর্যের আলো সোজাসুজি পড়ায় ভূমি ও জল দ্রুত গরম হয়ে ওঠে। ফলে সেখানে থাকা বাতাসও দ্রুত উষ্ণ হয়ে হালকা হয়ে যায়। গরম বাতাস হালকা হওয়ায় উপরের দিকে উঠে যায়। আর তখনই নিচে বাতাসের ঘাটতি তৈরি হয়, যাকে আমরা বলি নিম্নচাপ। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের মতো বিশাল জলরাশির ওপর যখন প্রচণ্ড রোদ পড়ে, তখন সাগরের পানি থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প তৈরি হয়। সেই বাষ্প বাতাসের সঙ্গে মিশে উপরে উঠে গিয়ে মেঘ তৈরি করে। মেঘের ভেতরে ঘনীভবন প্রক্রিয়ার সময় প্রচুর তাপ শক্তি মুক্ত হয়, যা নিম্নচাপকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

আবহাওয়াবিদ জেমস পিটারসন, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসে কাজ করেন, তিনি এই বিষয়ে বলেছেন—“নিম্নচাপকে আমরা আসলে প্রাকৃতিক একটি ইঞ্জিন বলতে পারি। সূর্যের তাপের কারণে বায়ু ওঠানামা করে, সেই ওঠানামার ফাঁকেই নিম্নচাপ তৈরি হয়। এটি এক ধরনের শক্তি রূপান্তর প্রক্রিয়া, যেখানে তাপ শক্তি বাতাসের গতিশক্তিতে রূপ নেয়।” তাঁর মতে, নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়া মানে হলো প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার একটি স্বাভাবিক নিয়ম।

নিম্নচাপ সবসময় ক্ষতিকর নয়। ছোটখাটো নিম্নচাপ সাধারণত নিয়মিত আবহাওয়ার অংশ। এগুলো বৃষ্টি নিয়ে আসে, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা যোগায় এবং প্রকৃতির জলচক্রকে সচল রাখে। কিন্তু সমস্যা হয় যখন নিম্নচাপ অনেক গভীর হয় এবং তা শক্তি সঞ্চয় করে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরের অবস্থান ও গঠন এমন যে এখানে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ খুব সহজেই ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এ জন্যই আমাদের অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বেশি।

ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ রিচার্ড হিউজ বলেছেন—“বঙ্গোপসাগর হলো পৃথিবীর অন্যতম ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ এলাকা। কারণ এখানে তৈরি হওয়া নিম্নচাপগুলো সাগরের প্রচুর জলীয়বাষ্প ও উষ্ণতা পেয়ে দ্রুত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমরা যাকে দুর্যোগ বলি, তার সূত্রপাত হয় এই ছোট্ট নিম্নচাপ থেকেই।” তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গরম আর্দ্র বাতাসের প্রাচুর্য একসাথে মিলে নিম্নচাপকে একটি মারাত্মক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।

নিম্নচাপকে বোঝার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পৃথিবীর ঘূর্ণন। পৃথিবী ঘূর্ণনের কারণে কোরিওলিস বল নামের একটি প্রভাব তৈরি হয়, যা বাতাসকে সোজা না গিয়ে বাঁকিয়ে দেয়। উত্তর গোলার্ধে বাতাস ডানদিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাঁদিকে ঘুরে যায়। এর ফলেই নিম্নচাপকে কেন্দ্র করে বাতাস ঘূর্ণনের মতো চলাচল করতে থাকে। আমরা যেটাকে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় বলি, তার জন্ম হয় মূলত এই কোরিওলিস বলের কারণে নিম্নচাপকে ঘিরে বাতাসের পাক খাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে।

আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিদ জন অ্যান্ডারসন বলেছেন—“নিম্নচাপ হলো ঘূর্ণিঝড়ের জন্মস্থান। যদি পর্যাপ্ত তাপ, আর্দ্রতা এবং কোরিওলিস প্রভাব থাকে, তবে এই ছোট্ট নিম্নচাপ কয়েক দিনের মধ্যে ভয়ংকর ঝড়ে পরিণত হতে পারে।” তাঁর মতে, নিম্নচাপকে বোঝা মানেই ভবিষ্যৎ ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ বুঝতে পারা।

তবে শুধু সাগরে নয়, স্থলভাগেও নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। গরমকালে শহরাঞ্চলে যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে, তখনও গরম বাতাস উপরে উঠে গিয়ে নিম্নচাপ তৈরি করে। যদিও এগুলো সাগরের মতো বড় প্রভাব ফেলে না, তবে হঠাৎ কালবৈশাখীর মতো ঝড়-বৃষ্টি সৃষ্টি করতে পারে। বসন্তকালে বাংলাদেশের আকাশে যে কালবৈশাখী ঝড় হয়, তার মূল কারণও হলো স্থলভাগে তৈরি হওয়া হঠাৎ নিম্নচাপ।

এখন প্রশ্ন আসে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিম্নচাপের প্রকৃতি কি বদলাচ্ছে? এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আবহাওয়াবিদ কেরি ইমানুয়েল। তিনি বলেছেন—“পৃথিবীর উষ্ণতা যত বাড়ছে, সমুদ্রের পানিও তত গরম হচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে নিম্নচাপ থেকে জন্ম নেওয়া ঘূর্ণিঝড় আরও শক্তিশালী হতে পারে। আগের তুলনায় কম সংখ্যক ঝড় হলেও সেগুলোর তীব্রতা হবে অনেক বেশি।” তাঁর মতে, জলবায়ু পরিবর্তন নিম্নচাপকে শুধু ঘন ঘন তৈরি করছে না, বরং তা আরও দীর্ঘস্থায়ী ও বিপজ্জনক করে তুলছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নচাপের গুরুত্ব অনেক। কৃষকরা বৃষ্টির জন্য নিম্নচাপের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু আবার সেই নিম্নচাপই যদি শক্তি সঞ্চয় করে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়, তাহলে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৭০ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় "ভোলা সাইক্লোন" মূলত একটি নিম্নচাপ থেকেই তৈরি হয়েছিল। একইভাবে সিডর, আইলা বা সাম্প্রতিক আম্পান—সবকিছুর শুরু হয়েছিল নিম্নচাপ থেকে।

অতএব বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে, নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় মূলত সূর্যের তাপ, জলীয়বাষ্প, বাতাসের ঘনত্বের তারতম্য এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে। এটি প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা মাঝে মাঝে ভয়ংকর রূপ নিয়ে আসে। বিদেশি গবেষকরা বারবার সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে নিম্নচাপকে আরও গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করতে হবে। কারণ এই ছোট্ট প্রাকৃতিক ঘটনাই আগামীতে বড় দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, নিম্নচাপ হলো প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে তাপ ও আর্দ্রতার বণ্টন হয়, আবার মানুষের জীবনে আনে বৃষ্টি। তবে এটি যখন সাগরের উষ্ণতা আর কোরিওলিস বলের প্রভাবে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করে, তখন তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। তাই নিম্নচাপকে শুধু বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝাই নয়, বরং এর ওপর নজরদারি ও পূর্বাভাস দেওয়া এখন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই লেখা ১০০০+ শব্দের মধ্যে হলো। আপনি চাইলে আমি এটিকে আরও সম্প্রসারিত করে ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার, কিংবা বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা যোগ করতে পারি। চাইবেন কি আমি সেটা যোগ করি?

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

ফারুকীর অ্যাপেনডিক্সের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন: তিশা

কক্সবাজার সফরে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। পরে রাতে তাকে একটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। গতকাল রোববার (১৭ আগস্ট) এই উপদেষ্টার অ্যাপেনডিক্সের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা।

১ দিন আগে

বদহজম দূর করার উপায়

এক গ্লাস হালকা গরম পানি খেলে বদহজমের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। পানি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং পেটের ভেতরে জমে থাকা অতিরিক্ত এসিডকে পাতলা করে দেয়।

১ দিন আগে

সাপ কেন আঁকাবাঁকা হয়ে পথ চলে?

সাপের মেরুদণ্ডে অসংখ্য হাড় আর পেশী আছে। এই হাড় ও পেশীর সাহায্যে তারা শরীর বাঁকায়, সঙ্কুচিত করে আবার প্রসারিত করে। একেকটা অংশ মাটিতে ধাক্কা দেয়, আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী মাটিও পাল্টা চাপ দিয়ে সাপকে সামনে এগিয়ে দেয়।

২ দিন আগে

গণতন্ত্রের গলদ

গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণই ক্ষমতার উৎস। সেটা আজকাল কেউ মানে বলে মনে হয় না। সে বাংলাদেশেই হোক বা যুক্তরাষ্ট্র—ক্ষমতাসীন নেতাদের সবাই নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে। গণতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য

২ দিন আগে