সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই অভ্যাস বশে এক গ্লাস লেবু পানি খান। বিজ্ঞাপন আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে এমন ধারণা ছড়িয়ে গেছে যে খালি পেটে লেবু খেলে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যায়, ওজন কমে, আবার হজমশক্তিও নাকি বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি খালি পেটে লেবু খাওয়া এতটা উপকারী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেবুর কিছু ভালো দিক থাকলেও খালি পেটে এটি খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

লেবুতে থাকে প্রচুর ভিটামিন সি এবং সাইট্রিক অ্যাসিড। ভিটামিন সি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ত্বক ভালো রাখে এবং ক্ষত দ্রুত সারতে সাহায্য করে। কিন্তু লেবুর টকভাবের মূল উৎস এই সাইট্রিক অ্যাসিডই শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যদি সেটা খালি পেটে খাওয়া হয়। আমাদের পাকস্থলীতে স্বাভাবিকভাবেই হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড থাকে, যা খাবার হজমে সহায়তা করে। যখন পেটে কোনো খাবার থাকে না আর আমরা লেবু খাই, তখন ওই সাইট্রিক অ্যাসিড সরাসরি পাকস্থলীর আস্তরণে আঘাত করে। এতে পাকস্থলীতে জ্বালা, ব্যথা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে আলসারের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রবার্ট হ্যানসন এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, “লেবুর অ্যাসিড যদি খালি পেটে সরাসরি পাকস্থলীতে যায়, তবে গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। এতে বুক জ্বলা, হজমে সমস্যা, এমনকি অ্যাসিড রিফ্লাক্সের ঝুঁকি বাড়ে।” তার মতে, লেবু উপকারী হলেও সেটি কখন খাওয়া হচ্ছে, সেটিই আসল ব্যাপার।

একইভাবে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন-এর পুষ্টিবিদ ড. মার্গারেট হোয়াইট মনে করেন, “খালি পেটে লেবু খাওয়া মানে শরীরকে অপ্রয়োজনীয় চাপে ফেলা। পাকস্থলীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে পরে দিনের বাকি সময়টা অস্বস্তি তৈরি করতে পারে।” তিনি বলেন, নাশতা বা দুপুরের খাবারের সঙ্গে লেবু খাওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর এবং কার্যকর।

লেবুর আরেকটি বড় সমস্যা দাঁতের স্বাস্থ্যে। লেবুর রসের অ্যাসিড দাঁতের এনামেল বা সাদা আস্তরণ ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দেয়। দাঁতের ডাক্তাররা বলেন, খালি পেটে যখন মুখে লালারসের পরিমাণ কম থাকে, তখন লেবুর টক রস দাঁতের জন্য আরও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড স্কুল অব ডেন্টাল মেডিসিনের গবেষক ড. লিসা কার্টার বলেছেন, “লেবুর অ্যাসিড দাঁতের এনামেল দুর্বল করে দেয়। দীর্ঘদিন খালি পেটে লেবু খেলে দাঁতে সংবেদনশীলতা ও ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।”

খালি পেটে লেবু খাওয়ার ফলে অনেকের বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা বা গা গুলানো অনুভূত হতে পারে। কারণ পাকস্থলীতে তখন অ্যাসিডের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এতে শরীরের ভেতর অস্বস্তি তৈরি হয়, যা অনেক সময় দিনভর কাজের মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। যাদের আগে থেকেই আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তাদের জন্য এটি আরও বিপজ্জনক।

তবে এর মানে এই নয় যে লেবু ক্ষতিকর। বরং লেবু একটি দারুণ উপকারী ফল, যদি সেটি সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে খাওয়া হয়। লেবু খাওয়ার সঠিক সময় হলো খাবারের পরপর বা খাবারের সঙ্গে। এতে লেবুর ভিটামিন সি শরীরে শোষিত হয় এবং হজমে সাহায্য করে। অনেকেই দুপুর বা রাতের খাবারের সালাদে লেবু ব্যবহার করেন, যা একেবারেই সঠিক পদ্ধতি।

ভারতের দিল্লি ইউনিভার্সিটির খাদ্যবিজ্ঞানী ড. অরুণ কুমার এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন, “খালি পেটে লেবু খাওয়া শরীরের জন্য কোনো উপকার আনে না। বরং পরে হজমের সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু যদি খাবারের সঙ্গে বা পরে লেবু খাওয়া হয়, তবে সেটি হজমকে সহজ করে এবং ভিটামিন সি-এর জোগান দেয়।”

ওজন কমাতে লেবুর নামও বারবার শোনা যায়। অনেকেই মনে করেন খালি পেটে লেবু পানি খেলে চর্বি দ্রুত গলে যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে এর তেমন প্রমাণ নেই। ওজন কমাতে হলে দরকার সুষম খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম। শুধু লেবু পানি খেলে শরীরে কিছুটা পানি কমতে পারে, যা সাময়িকভাবে ওজন কমার মতো মনে হয়। কিন্তু আসলে চর্বি কমে না। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. এলেন জনসন এ বিষয়ে বলেন, “লেবু পানি শরীরকে তরল দেয়, যা অনেক সময় ক্ষুধা কিছুটা দমন করে। কিন্তু এটিকে ওজন কমানোর ম্যাজিক ড্রিঙ্ক ভাবা ভুল।”

সব মিলিয়ে বলা যায়, লেবু আমাদের জন্য উপকারী ফল হলেও সেটি খাওয়ার সময় ও পদ্ধতি সঠিক হতে হবে। সকালে খালি পেটে লেবু পানি খাওয়া আসলে শরীরের ক্ষতি করে বেশি। এর পরিবর্তে সকালে খালি পেটে এক গ্লাস সাধারণ পানি খাওয়া শরীরের জন্য অনেক বেশি ভালো। এরপর নাশতা বা দুপুরের খাবারের সঙ্গে লেবু খাওয়া যেতে পারে, তাতেই লেবুর আসল উপকার পাওয়া সম্ভব।

অতএব, স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের উচিত এই ভুল অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা। কারণ শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে শুধু কী খাচ্ছি সেটাই নয়, কখন খাচ্ছি সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। লেবুর টক স্বাদ আমাদের খাবারকে সুস্বাদু করে তোলে, শরীরকে ভিটামিন সি দেয়, কিন্তু খালি পেটে এটি খাওয়া মানে শরীরকে অযথা কষ্ট দেওয়া। তাই বিজ্ঞাপন বা অন্ধ বিশ্বাসের ওপর না গিয়ে বিজ্ঞান আর চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলাই শ্রেয়।