স্বাস্থ্য

হঠাৎ কানে ব্যথা হলে করণীয়

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কানে ব্যথা শুরু হলে তা যেন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এক বিশাল বিঘ্ন ঘটায়। হঠাৎ করে এক কান অথবা দুই কানেই যদি তীব্র ব্যথা শুরু হয়, তা হলে ঘুম থেকে কাজ—সব কিছুই অস্থির হয়ে পড়ে। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি কষ্টদায়ক, কারণ তারা ব্যথার কারণ ঠিকভাবে বলতে পারে না। অনেক সময় আমরা বিষয়টিকে খুব হালকাভাবে নিই—ভাবি ঠান্ডা লেগেছে বা পানি ঢুকেছে, কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব হলো, হঠাৎ কানে ব্যথা একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ, যার পেছনে থাকতে পারে একাধিক কারণ। তাই বিষয়টিকে অবহেলা না করে প্রাথমিক কিছু করণীয় অনুসরণ করা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ঠান্ডা লাগা বা সর্দি-কাশির সংক্রমণ থেকে কানের ভেতরে চাপ তৈরি হওয়া। নাক ও গলা দিয়ে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া কানের মধ্যকর্ণে পৌঁছায়, যেখানে তরল জমা হতে পারে এবং সেই চাপ থেকে ব্যথা শুরু হয়। একে বলা হয় অটাইটিস মিডিয়া, অর্থাৎ মধ্যকর্ণে সংক্রমণ। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ডেফনেস অ্যান্ড আদার কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস’-এর (NIDCD) গবেষক ড. লরা শটজ বলেন, “শিশুদের মধ্যে এই কানের সংক্রমণ বেশি দেখা যায় কারণ তাদের ইউস্টেশিয়ান টিউব ছোট এবং সরল, ফলে জীবাণু সহজে মধ্যকর্ণে পৌঁছাতে পারে।” তিনি বলেন, “যদি কানের ব্যথার সঙ্গে জ্বর বা শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার লক্ষণ থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।”

অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ ধুলা, ধোঁয়া, ঠান্ডা বাতাসে থাকার পরও কানে ব্যথা শুরু হতে পারে। আবার হঠাৎ পানিতে ডুব দিলে বা স্নান করার সময় পানি কানে ঢুকে আটকে গেলে ‘সুইমারস ইয়ার’ নামে পরিচিত ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে। এতে কানের বাইরের অংশ বা ক্যানেল লাল হয়ে ফোস্কা পড়তে পারে এবং ব্যথার সঙ্গে চুলকানিও হতে পারে। এ অবস্থায় কান খোঁচানো বা তেল-দেওয়া আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকো (UCSF)-এর কানের রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মাইকেল লারসেন বলেন, “কান খোঁচানো এক ধরণের আত্মঘাতী অভ্যাস। এতে শুধু ইনফেকশন নয়, কানের পর্দাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “অল্প ব্যথা মনে হলেও কান নিজে থেকে পরিষ্কার করার চেষ্টা না করে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করাই শ্রেয়।”

হঠাৎ কানে ব্যথার আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হলো চুল বা ধুলাবালি জমে গিয়ে কানের ভেতরে ‘ইয়ার ওয়াক্স’ জমে যাওয়া। এটি অনেক সময় কানের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে এবং শব্দ শুনতে কষ্ট হয়। আবার কান পরিষ্কার করতে গিয়ে কেউ কেউ কটন বাড বা হেয়ারপিন দিয়ে কানের ভেতর ঢুকিয়ে দেন, এতে কানের পর্দা ফুটো হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ব্রিটেনের ‘রয়াল ন্যাশনাল থ্রোট, নোজ অ্যান্ড ইয়ার হসপিটাল’-এর চিকিৎসক ড. এলেনা গ্রিন বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি কানে ব্যথার পেছনে থাকে অনাকাঙ্ক্ষিত কটন বাড ব্যবহার বা তেল ঢেলে দেওয়ার পর প্রতিক্রিয়া। এসব একেবারেই পরিহারযোগ্য।”

তবে অনেক সময় কানে ব্যথা এমনিতেও শুরু হতে পারে—যেমন বিমানযাত্রার সময় হঠাৎ বায়ুচাপের তারতম্য হলে, বা উচ্চ শব্দের সংস্পর্শে এলে কানের ভিতর একটি ধরণের ‘প্রেশার ইমব্যালান্স’ হয়, যাকে ‘বারো ট্রমা’ বলা হয়। এতে শ্রবণশক্তি ক্ষণিকের জন্য হ্রাস পায় এবং কান ভারী ভারী লাগে, অনেক সময় ব্যথাও হয়। এ ক্ষেত্রে চুইংগাম চিবানো, হাই তোলা বা পানি পান করলে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যায়। জার্মানির ‘ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার হ্যামবার্গ’-এর ইএনটি বিশেষজ্ঞ ড. হ্যানস পিটার ব্রুগার বলেন, “বিমানযাত্রা বা পাহাড়ি এলাকায় গেলে চুইংগাম বা লজেন্স খুব কার্যকর। এটি ইউস্টেশিয়ান টিউব খুলে দেয়, ফলে চাপ স্বাভাবিক হয়।”

হঠাৎ কানে ব্যথা হলে ঘরোয়া কিছু প্রতিকারও সাময়িকভাবে কাজে লাগতে পারে, তবে সেগুলোরও একটি সীমা রয়েছে। কেউ কেউ হালকা গরম কাপড় বা বোতল দিয়ে কান সেঁক দিলে ব্যথা কিছুটা কমে বলে মনে করেন, কিন্তু যদি ইনফেকশন থাকে, তাহলে সেঁক উল্টো ক্ষতি করতে পারে। কিছু মানুষ রসুনের তেল গরম করে কানে দেন, কিন্তু চিকিৎসকরা সাধারণত এ ধরনের প্রথাগত পদ্ধতির বিরুদ্ধে সাবধান করেন। ড. লরা শটজ বলেন, “রসুন বা নারকেল তেল কানে দেওয়ার আগে তার জীবাণুমুক্ততা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে ইনফেকশন আরও বাড়তে পারে।”

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—হঠাৎ কানে ব্যথা শুরু হলে যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে না কমে, যদি জ্বর আসে, কান দিয়ে পানি বা পুঁজ বের হয়, অথবা শ্রবণশক্তি কমে যায়, তবে এক মুহূর্ত দেরি না করে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। কানের সংক্রমণ ধীরে ধীরে হাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনকি ভারসাম্য ও স্নায়ুতন্ত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রাথমিক পর্যায়ে কান পরিষ্কার ও শুকনো রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। যদি পানি ঢোকে, তাহলে মাথা কাত করে পানি বের করে ফেলা উচিত। কোনো কিছু দিয়ে খোঁচানো একেবারেই উচিত নয়। বাচ্চাদের কানে ব্যথা হলে কান ধরে টানবে বা কান চেপে ধরবে—এটি একটি লক্ষণ। তখন শিশুকে চুপচাপ না রেখে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ রাখতে হবে এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, কানে ব্যথা কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। এটি শরীরের অন্য সমস্যার লক্ষণও হতে পারে। একে অবহেলা করলে বড় বিপদের কারণ হতে পারে। তাই প্রাথমিক সতর্কতা, চিকিৎসকদের পরামর্শ এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করলেই কানে ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনই আমাদের সচেতনতা ও সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখা ভালো—কান আমাদের শ্রবণের জানালা, এটি যত্ন পেলে শুধু ব্যথাই কমবে না, জীবনও হবে শ্রুতিমধুর।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

ফারুকীর অ্যাপেনডিক্সের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন: তিশা

কক্সবাজার সফরে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। পরে রাতে তাকে একটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। গতকাল রোববার (১৭ আগস্ট) এই উপদেষ্টার অ্যাপেনডিক্সের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা।

১৯ ঘণ্টা আগে

বদহজম দূর করার উপায়

এক গ্লাস হালকা গরম পানি খেলে বদহজমের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। পানি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং পেটের ভেতরে জমে থাকা অতিরিক্ত এসিডকে পাতলা করে দেয়।

২০ ঘণ্টা আগে

সাপ কেন আঁকাবাঁকা হয়ে পথ চলে?

সাপের মেরুদণ্ডে অসংখ্য হাড় আর পেশী আছে। এই হাড় ও পেশীর সাহায্যে তারা শরীর বাঁকায়, সঙ্কুচিত করে আবার প্রসারিত করে। একেকটা অংশ মাটিতে ধাক্কা দেয়, আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী মাটিও পাল্টা চাপ দিয়ে সাপকে সামনে এগিয়ে দেয়।

২ দিন আগে

গণতন্ত্রের গলদ

গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণই ক্ষমতার উৎস। সেটা আজকাল কেউ মানে বলে মনে হয় না। সে বাংলাদেশেই হোক বা যুক্তরাষ্ট্র—ক্ষমতাসীন নেতাদের সবাই নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে। গণতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য

২ দিন আগে