স্বাস্থ্য

মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কমাবেন কী করে?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

বাংলাদেশে এখন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি জীবনে একবারও গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেননি। আমাদের খাদ্যাভ্যাস, কাজের চাপ, অনিয়মিত ঘুম কিংবা মানসিক উদ্বেগের কারণে অনেকের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সমস্যা তখনই প্রকট হয়ে ওঠে, যখন অ্যাসিডিটি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়—অর্থাৎ পেটে অ্যাসিডের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে সেটা বুকজ্বালা, অস্বস্তি, এমনকি বমির মতো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। প্রশ্ন হলো, তখন কী করবেন?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে জানতে হবে, অ্যাসিডিটি কেন হয়। আমাদের পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা খাবার হজমে সহায়তা করে। তবে নানা কারণে যদি এই অ্যাসিড অতিরিক্ত তৈরি হয় কিংবা পাকস্থলীতে দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকে, তখনই ঘটে অ্যাসিডিটি। বেশি তেল-মশলা খাওয়া, দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকা, রাতজেগে কাজ করা, ধূমপান বা অ্যালকোহল পান—এসব কারণে হজমে সমস্যা তৈরি হয় এবং অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরোডাইজেস্টিভ ডিজঅর্ডারস বিভাগের গবেষক ড. এলেনা হার্ট (Elena Hart) বলেন, ‘অ্যাসিডিটি অনেকাংশেই আমাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই পড়ে। এটা এমন একটি সমস্যা, যা আপনি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা বদলিয়ে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তবে যদি এই অ্যাসিডিটি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে তা আলসার বা গ্যাস্ট্রিক ক্যানসারের দিকে গড়াতে পারে।’

তাহলে যদি হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি হয়, আপনি কী করতে পারেন?

প্রথমত, যত দ্রুত সম্ভব পাকস্থলীকে একটু স্বস্তি দিতে হবে। অতিরিক্ত অ্যাসিড পেটের ভেতর জমে গেলে বমি আসা স্বাভাবিক। যদি এমন হয়, তাহলে জোর করে বমি না চেপে বরং বমি করে ফেলাই ভালো। এতে পাকস্থলীর অতিরিক্ত অ্যাসিড কিছুটা বের হয়ে আসে এবং আরাম লাগে।

এরপর পানি পান করতে হবে। তবে একসঙ্গে অনেকটা পানি খেয়ে ফেললে সমস্যা বাড়তে পারে। তাই অল্প অল্প করে, ধীরে ধীরে পানি খেতে হবে। ঠান্ডা পানি কিছুটা আরাম দিতে পারে, তবে একেবারে বরফঠান্ডা পানি এড়িয়ে চলাই ভালো।

ঘরে থাকলে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি মেনে চলা যেতে পারে। যেমন, এক চিমটি খাবার সোডা এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খেলে পেটে জমে থাকা অ্যাসিড কিছুটা নিরপেক্ষ হয়ে যায়। এটি একটি তাৎক্ষণিক আরামদায়ক উপায় হিসেবে কাজ করে। আবার অনেকে এক গ্লাস গরম পানির সঙ্গে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে পান করেন, যা হজমে সহায়তা করে ও অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)-এর পরামর্শ অনুযায়ী, ‘অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটির সময় চর্বিযুক্ত খাবার, চকলেট, টমেটো, পেঁয়াজ এবং ক্যাফেইনজাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। এসব খাবার পাকস্থলীর এসিড নিঃসরণ আরও বাড়িয়ে তোলে।’ এক্ষেত্রে সেদ্ধ সবজি, পাউরুটি, ওটস, কলা কিংবা ডাবের পানি তুলনামূলক বেশি সহনীয় খাবার হিসেবে কাজ করে।

যদি অতিরিক্ত অ্যাসিডের কারণে বুকজ্বালা হয়, তাহলে শোয়ার সময় মাথা একটু উঁচু করে শোয়া উচিত। কারণ শুয়ে পড়লে অ্যাসিড ওপরের দিকে উঠে এসে খাবারনালিতে জ্বালা সৃষ্টি করে। এ জন্য বালিশ একটু উঁচু করে শোয়া অথবা কাত হয়ে শোয়ার অভ্যাস করা যেতে পারে।

কিছু মানুষ স্বভাবতই বেশি অ্যাসিড তৈরি করে। আবার যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ নিচ্ছেন, যেমন পেইনকিলার বা স্টেরয়েড, তাঁদের ক্ষেত্রেও অ্যাসিডিটি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন একেবারেই অনুচিত।

জার্মানির হ্যানোভারের মেডিকেল স্কুলের গবেষক ড. ক্লাউস রিচার্ড (Dr. Klaus Richard) তাঁর এক গবেষণাপত্রে লেখেন, ‘দীর্ঘদিনের অ্যাসিডিটি আসলে হজমের সমস্যাই নয়, এটি একটি “সাইলেন্ট ডিজঅর্ডার”। অনেক সময় রোগীরা বুঝতে পারেন না, তাঁরা প্রতিদিন অল্প অল্প অ্যাসিড পেটের মধ্যে জমতে দিচ্ছেন। এতে ক্রমাগত ক্ষয় হয় পাকস্থলীর ভেতরের আস্তরণে, এবং একসময় তা আলসারে রূপ নেয়।’

তাই মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি হলে শুধু তাৎক্ষণিক আরাম নয়, ভবিষ্যতের প্রতিকারও ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন, রাত ৯টার পর ভারী খাবার না খাওয়া, ধূমপান বা অতিরিক্ত চা-কফি কমিয়ে আনা, প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুমানো এবং নিয়মিত হালকা হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস গড়ে তোলা।

অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে নিয়মিত খাবারের সময় ঠিক রাখা সবচেয়ে জরুরি। খালি পেটে দীর্ঘ সময় থাকা মানেই পাকস্থলীতে অ্যাসিড জমে থাকা। তাই একটানা না খেয়ে বরং ৩–৪ ঘণ্টা পরপর অল্প করে কিছু খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কোনো সাধারণ অসুস্থতা নয়। এটি একটি সতর্ক সংকেত—আপনার শরীর হয়তো বলছে, সে আর আগের মতো সব মেনে নিচ্ছে না। তাই নিজেকে একটু সময় দিন, নিজের শরীরের কথা শুনুন, খাবার-ঘুম-চিন্তা—সবকিছুর ভারসাম্য রাখুন। তাহলেই হয়তো সেই বুকজ্বালা বা পেটে অস্বস্তির দিনগুলো আপনাকে আর তেমন কষ্ট দেবে না।

যদি ওপরের ঘরোয়া উপায়েও অ্যাসিডিটি না কমে এবং ব্যথা, বমি বা রক্তপাত দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

নিম্নচাপ কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় নিম্নচাপ হলো একটি এমন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি যেখানে বাতাসের চাপ চারপাশের তুলনায় কম হয়ে যায়। সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাতাস সবসময় উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।

১৩ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১ দিন আগে

খালি পেটে লেবু খাওয়া ক্ষতিকর!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই অভ্যাস বশে এক গ্লাস লেবু পানি খান। বিজ্ঞাপন আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে এমন ধারণা ছড়িয়ে গেছে যে খালি পেটে লেবু খেলে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যায়, ওজন কমে, আবার হজমশক্তিও নাকি বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি খালি পেটে লেবু খাওয়া এতটা উপকারী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেবুর কিছু ভালো দিক

১ দিন আগে

কেন ভাদ্র মাসে তাল পাকে?

১ দিন আগে