স্বাস্থ্য

কালোজিরা: এক প্রাকৃতিক ওষুধের খোঁজে

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ২২: ৪৯

সাধারণ মসলা হিসেবে আমাদের রান্নাঘরে যার উপস্থিতি নিতান্তই স্বাভাবিক, সেই কালোজিরার মধ্যে যে এত উপকার লুকিয়ে আছে, তা জানলে অবাক হতে হয়। ছোট ছোট কালো দানার মতো দেখতে এই জিনিসটি বহু শতাব্দী ধরেই উপমহাদেশে আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুধু যে গন্ধ বা স্বাদের জন্য রান্নায় এটি ব্যবহৃত হয় তা নয়, বরং নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দূর করতেও কালোজিরার গুরুত্ব অপরিসীম।

বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে কালোজিরায় রয়েছে একাধিক উপকারী উপাদান, যা আমাদের শরীরের নানা সমস্যার প্রতিকার করতে সক্ষম।

যুত্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষক ড. রেবেকা শার্প বলেন, “কালোজিরা বা নিগেলা সাটিভা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এতে আছে থাইমোকুইনোন নামক রাসায়নিক, যা প্রদাহ কমায়, ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।”

প্রথমেই আসা যাক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কথায়। আজকের দিনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখা খুব জরুরি। কালোজিরার তেলে থাকা থাইমোকুইনোন উপাদানটি শরীরে ফ্রি র‍্যাডিকেল ধ্বংস করে, যা কোষের ক্ষতি করে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ায়। ২০১৩ সালে ‘এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অব ট্রপিক্যাল বায়োমেডিসিন’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, কালোজিরা নিয়মিত গ্রহণ করলে শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইমের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কার্যকর হয়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কালোজিরার ভূমিকা। ইরানের মাশহাদ ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক ড. ফারহাদ যাহেদি জানান, “প্রতিদিন কালোজিরার গুঁড়া বা তেল নিয়ম করে খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে আসে। এর ফলে ইনসুলিন নির্ভরশীলতা অনেকটাই হ্রাস পায়।” তার মতে, এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে।

এছাড়াও কালোজিরা হজমে সহায়তা করে, গ্যাস ও অম্বলের সমস্যা কমায়। আমাদের দেশে অনেকেই কালোজিরা দিয়ে চা বানিয়ে খেয়ে থাকেন পেটের গ্যাস কমাতে। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও রয়েছে এর পেছনে। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো-র গবেষক ও পুষ্টিবিদ ড. লিন্ডা ম্যাকডোনাল্ড জানান, “কালোজিরার তেলে থাকা ভেষজ উপাদানগুলো অন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে ভূমিকা রাখে।”

কালোজিরার আরেকটি চমকপ্রদ উপকারিতা হলো চুল পড়া কমানো ও ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে এর ভূমিকা। সৌন্দর্য চর্চার ক্ষেত্রে কালোজিরার তেল এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রিটেনের হার্বাল থেরাপি বিশেষজ্ঞ ড. নিকোল রোজ বলেন, “কালোজিরার তেল চুলের গোড়া মজবুত করে এবং খুশকি দূর করে। পাশাপাশি এটি স্কিন টোন ইভেন করে এবং ব্রণ বা দাগ কমাতে সাহায্য করে।” তাই এখন অনেক আন্তর্জাতিক বিউটি প্রোডাক্টেও কালোজিরার নির্যাস ব্যবহার হচ্ছে।

আরেকটি ক্ষেত্র যেখানে কালোজিরা খুব উপকারী তা হলো হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের মতো রোগে। ২০১০ সালে ‘ফাইটো মেডিসিন’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, কালোজিরার তেল ব্রংকিয়াল টিউব খুলে দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যাদের অ্যালার্জি থেকে সিজনাল হাঁপানি হয়, তাঁদের জন্য কালোজিরা অত্যন্ত কার্যকর।

পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ এবং শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতেও কালোজিরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মিশরের টান্টা ইউনিভার্সিটি-র পুষ্টি গবেষক ড. আয়মান খলিল। তিনি বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ১-২ গ্রাম কালোজিরা খাচ্ছেন, তাদের রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল দুটোই অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে।”

তবে এসব উপকারিতার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, কোনো প্রাকৃতিক উপাদানই ‘ম্যাজিক কিওর’ নয়। যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে বা যারা ওষুধ খাচ্ছেন নিয়মিত, তাঁদের ক্ষেত্রে আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে কালোজিরা অতিরিক্ত খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ড. রেবেকা শার্প।

অতএব বলা যায়, আমাদের রান্নাঘরের একটি সাধারণ উপাদান কালোজিরা—যা আমরা অনেক সময় অবহেলা করি—আসলে একটি অসাধারণ ওষুধ। বিশ্বের নানা দেশের গবেষক ও চিকিৎসকরা একমত হয়েছেন যে, কালোজিরা কেবল শরীর নয়, মনকেও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে যদি আমরা অল্প পরিমাণে হলেও কালোজিরা রাখি, তাহলে উপকার পাওয়া যেতেই পারে।

মানুষের সুস্থ জীবনের জন্য প্রকৃতি যে কত কিছু দিয়ে রেখেছে, তার অন্যতম নিদর্শন এই কালোজিরা। একটু সচেতন হয়ে এবং নিয়ম মেনে ব্যবহার করলে আমরা হয়তো ওষুধের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারি। কালোজিরা আমাদের সেই পথেই এক শক্তিশালী সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে।

সূত্র: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিক্যাল সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

প্রথম অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট: কতটা বদলেছে সেবার চিত্র?

ওয়েবসাইটে ফি এবং প্রক্রিয়াকরণের সময় দুইজনের কারও চোখই এড়ায় না স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা তথ্য- সাধারণ প্রসেসিংয়ে ২১ থেকে ৩০ দিন এবং এক্সপ্রেস প্রসেসিংয়ে ৭ থেকে ১০ দিন।

২ দিন আগে

হাত-পায়ের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘরোয়া উপায়

অনেক সময় হাত-পায়ের ব্যথা কোনো পেশির টান বা স্নায়ুর সমস্যার কারণে হয়। এর জন্য ঘরোয়া ব্যায়াম হতে পারে ভালো উপায়। যেমন প্রতিদিন সকালে ৫-১০ মিনিট হালকা স্ট্রেচিং করলে পেশির নমনীয়তা বাড়ে এবং ব্যথা কিছুটা কমে।

২ দিন আগে

ডিজিটাল বিচারালয়: নাগরিকের আরও কাছাকাছি

কয়েক মিনিটের মধ্যেই রহিমা তার মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ, বিচারকের নাম, মামলার অবস্থা জানতে পারলেন ওই তরুণের মাধ্যমে।

২ দিন আগে

জামিনে মুক্তি পেয়ে যা বললেন ফারিয়া

ফেসবুক পোস্টে চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া লেখেন, ‘সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা যারা আমার পাশে ছিলেন। শারিরীক অসুস্থতার জন্য আজ কথা বলতে পারিনি। সুস্থ হয়ে খুব দ্রুত ফিরে আসব আপনাদের মাঝে।’

২ দিন আগে