স্বাস্থ্য

গ্যাস্ট্রিক দূর করবেন যেভাবে

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ০১: ২৫

গ্যাস্ট্রিক—এই একটি শব্দই অনেকের মাথাব্যথার কারণ। বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যিনি কখনও না কখনও গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেননি। পেটের ভেতর জ্বালাপোড়া, অস্বস্তি, ঢেঁকুর, বুক জ্বালা বা পেটে গ্যাস হওয়া—এসব উপসর্গ একসঙ্গে মিলে গ্যাস্ট্রিক বলে পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় Gastritis বা Acid Reflux। তবে আশার কথা হলো, এই সমস্যা দূর করা খুব কঠিন নয়, যদি আমরা কিছু সহজ অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে পারি এবং আমাদের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনতে পারি।

গ্যাস্ট্রিকের মূল কারণ হলো পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হওয়া। এই অ্যাসিড আমাদের খাবার হজমে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু যখন এটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তৈরি হয় বা পাকস্থলীর দেওয়াল দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই শুরু হয় সমস্যা। গ্যাস্ট্রিকের পিছনে অন্যতম কিছু কারণ হলো অনিয়মিত খাওয়া, অতিরিক্ত ঝাল-মশলা খাওয়া, বেশি চা-কফি পান করা, ধূমপান, মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাব।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেস’-এর গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিশেষজ্ঞ ড. রবার্ট জোনস বলেন, “গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির প্রধান কারণ হচ্ছে খালি পেটে থাকা এবং দেরিতে খাওয়া। পাকস্থলী যখন খালি থাকে, তখন সেখানে থাকা অ্যাসিড নিজেই পাকস্থলীর দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে গ্যাস, জ্বালাপোড়া ও পেটে ব্যথা হতে থাকে।” তিনি পরামর্শ দেন, “অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা পরপর হালকা কিছু খাওয়া উচিত, যাতে পেট কখনও একেবারে খালি না থাকে।”

খাবার নির্বাচনের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, তেলে ভেজে রাখা খাবার, চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কস, অতিরিক্ত চিনি বা সোডা জাতীয় খাবার গ্যাস্ট্রিক বাড়ায়। আবার কিছু খাবার আছে যা গ্যাস্ট্রিক কমাতে সাহায্য করে। যেমন, কলা, তাজা দই, ওটস, আদা, শসা, পেঁপে ইত্যাদি। ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস’ (AIIMS)-এর পুষ্টিবিদ ড. অমিতা সিং বলেন, “খালি পেটে একটুকরো কলা খেলে অ্যাসিড অনেকটাই কমে যায়, কারণ কলা পাকস্থলীতে একধরনের প্রাকৃতিক আবরণ তৈরি করে যা অ্যাসিডকে ঠেকাতে সাহায্য করে।”

আদা হচ্ছে আরেকটি প্রাকৃতিক উপাদান যা গ্যাস্ট্রিক কমাতে জাদুর মতো কাজ করে। চীনের হংকং ইউনিভার্সিটির খাদ্যবিজ্ঞানী ড. লিন ঝাও বলেন, “আদা একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান, যা হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে এবং পাকস্থলীতে গ্যাস জমতে দেয় না।” তাঁর মতে, এক কাপ গরম পানিতে কয়েক টুকরো কাঁচা আদা দিয়ে পাঁচ মিনিট ফুটিয়ে সেই পানি পান করলে গ্যাস্ট্রিকের উপসর্গ অনেকটা কমে যায়।

এছাড়া অনেক সময় গ্যাস্ট্রিকের পেছনে মানসিক চাপ বড় ভূমিকা রাখে। অনেকেই আছেন, যাঁরা চিন্তা বা দুশ্চিন্তায় থাকলেই পেটে ব্যথা বা গ্যাস অনুভব করেন। এ বিষয়ে কানাডার মন্ট্রিয়ালের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. লরেন্স ক্যাম্পবেল বলেন, “আমাদের মস্তিষ্ক ও অন্ত্রের মধ্যে একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। যখন মস্তিষ্ক চাপ অনুভব করে, তখন হজমক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয় এবং পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হয়।” তিনি বলেন, “নিয়মিত ধ্যান, যোগব্যায়াম বা হালকা হাঁটা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে গ্যাস্ট্রিক সমস্যাকেও কমায়।”

শরীরচর্চাও গ্যাস্ট্রিক কমানোর এক দুর্দান্ত উপায়। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করলে হজমশক্তি বাড়ে, শরীর চনমনে থাকে এবং পাকস্থলীতে গ্যাস জমার প্রবণতা কমে। তবে ব্যায়ামের পরপরই খাওয়া বা খাওয়ার পরপরই ব্যায়াম করলে গ্যাস্ট্রিক আরও বাড়তে পারে, তাই সময় নির্বাচনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বেশি রাত জাগা এবং খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শোয়ার অভ্যাসও গ্যাস্ট্রিক বাড়ায়। ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির চিকিৎসক ড. হ্যান্স পিটার বলেন, “রাতের খাবারের অন্তত দুই ঘণ্টা পর শোয়া উচিত। কারণ, খাবারের পরপরই শুয়ে পড়লে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীর দিকে উঠে আসে, যা বুক জ্বালাপোড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।”

একটি ছোট অথচ কার্যকর অভ্যাস হলো গরম পানি খাওয়া। বিশেষ করে খাবারের পর হালকা গরম পানি পান করলে তা হজমে সাহায্য করে এবং পাকস্থলীতে গ্যাস কম তৈরি হয়। চীনের ইউনান মেডিকেল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন অন্তত তিনবার গরম পানি খায়, তাদের গ্যাস্ট্রিক সমস্যা অন্যদের তুলনায় অনেক কম হয়।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, গ্যাস্ট্রিক দূর করতে ওষুধের ওপর নির্ভর না করে জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন আনাই হলো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। সময়মতো ঘুম, সময়মতো খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান, মানসিক চাপ কমানো, ঝাল-তেল-মশলা কমানো, এবং কিছু প্রাকৃতিক খাবার খাওয়া—এই কয়েকটি সহজ অভ্যাসই আমাদের গ্যাস্ট্রিক সমস্যাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।

সুতরাং, গ্যাস্ট্রিক আর কোনও অমীমাংসিত রোগ নয়। বরং এটি আমাদেরই তৈরি করা এক অভ্যাসগত সমস্যা, যার সমাধানও আমাদের হাতেই। নিজের শরীরের প্রতিদিনের প্রয়োজন ও সংকেত বুঝে জীবনযাত্রায় সচেতন পরিবর্তন আনলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিদেশি গবেষকদের মতো আমাদের দেশীয় চিকিৎসকরাও আজ এই সহজ নিয়মগুলোকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই আর দেরি না করে আজ থেকেই শুরু হোক গ্যাস্ট্রিকমুক্ত জীবনের পথচলা।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

প্রযুক্তির হাত ধরে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পৌঁছাবে বাংলাদেশ?

নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার এখনও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে তাঁদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।

২ দিন আগে

মধু কেন খাবেন?

প্রচলিত কফ সিরাপের তুলনায় মধু অনেক বেশি কার্যকর। বিশেষ করে শিশুদের সর্দি-কাশিতে মধু একটি প্রাকৃতিক এবং নিরাপদ বিকল্প।

২ দিন আগে

পি এল আইডি: কারণ, লক্ষণ ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ভূমিকা

প্রলাপস লাম্বার ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক (PLID)— সংক্ষেপে পি এল আইডি—একটি পরিচিত মেরুদণ্ডজনিত সমস্যা। এটি তখন ঘটে, যখন কোমরের হাড়ের (কশেরুকা) মাঝখানের নরম ডিস্ক স্বাভাবিক স্থানচ্যুতি হয়ে পাশের স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে দেখা দেয় কোমর ব্যথা, সায়াটিকা এবং পেশীর দুর্বলতাসহ একাধিক সমস্যা।

৩ দিন আগে

সুস্পষ্ট হয়েছে লঘুচাপ, বন্দরে সতর্কসংকেত অব্যাহত

বঙ্গোপসাগরের উত্তরপশ্চিম ও সংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এটি আরও ঘনীভূত হতে পারে। এর প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ার শঙ্কা থেকে দেশের চার সমুদ্রবন্দরেই তিন নম্বর সতর্কসংকেত বহাল রাখা হয়েছে। বুধবার (২৮ মে) সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তর এ লঘুচাপের জন্য সামুদ

৩ দিন আগে