স্বাস্থ্য

ডাবের পানি কতটা উপকারী

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৭: ২২
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

রোদঝলমলে গ্রীষ্মকালের এক দুপুর। কষ্ট করে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়া শরীরের চাহিদা তখন একটাই—শীতল, সতেজ কোনো পানীয়। ঠিক এমন সময় এক গ্লাস ঠান্ডা ডাবের পানি যেন স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়। এই স্বচ্ছ, মিষ্টি পানীয় শুধু স্বাদেই মন জয় করে না, এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতাও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে বিস্ময় জাগিয়েছে বহুবার। ডাবের পানি শুধু গ্রীষ্মকালীন একটি পানীয় নয়, বরং তা হচ্ছে প্রকৃতির নিজ হাতে তৈরি একটি “ন্যাচারাল স্পোর্টস ড্রিঙ্ক”। সহজ-সরল ভাষায় বললে, এটি এমন এক তরল যা আমাদের শরীরকে একযোগে হাইড্রেট, পরিশ্রান্তি দূর, ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যবিশারদ, পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকেরা ডাবের পানির গুণাবলি নিয়ে বহু গবেষণা করেছেন এবং করছেন। ডাবের পানি শরীরের জন্য কতটা উপকারী, তা বোঝার জন্য আমাদের আগে জানতে হবে এর ভেতরের উপাদান সম্পর্কে। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইট যেমন পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস। রয়েছে কিছু প্রোটিন, প্রাকৃতিক চিনিসহ কিছু ভিটামিন যেমন ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫ ও বি৬। রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদানও। এসব উপাদান আমাদের শরীরকে শুধু হাইড্রেট করে না, বরং নানা রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।

যুক্তরাষ্ট্রের “হাওয়াই ইউনিভার্সিটি অ্যাট মানোয়া”-র এক পুষ্টিবিজ্ঞানী ড. কেটলিন ইয়াং বলেন, “ডাবের পানি হচ্ছে এমন এক পানীয় যা প্রাকৃতিকভাবেই শরীরের ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে। অনেক সময় খেলোয়াড়েরা যেসব ইনার্জি ড্রিঙ্ক খায়, তার প্রাকৃতিক বিকল্প হতে পারে এই পানীয়।” ড. ইয়াং আরও বলেন, “এটি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে কার্যকর, বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় বা ডায়রিয়া হলে এটি জীবনরক্ষাকারী ভূমিকা রাখতে পারে।”

ভারতের “অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস”-এর গবেষক ড. নেহা কৃষ্ণান বলেন, “আমাদের এক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, যেসব রোগীদের ডায়রিয়ার সময় ডাবের পানি খাওয়ানো হয়েছিল, তারা অন্যান্য ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশনের তুলনায় অনেক দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছিল।” তিনি বলেন, “এর মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক চিনিজাতীয় গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ শরীরকে শক্তি দেয়, আবার ইলেকট্রোলাইট শরীরের তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে।”

তবে শুধু শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ নয়, ডাবের পানি ওজন কমাতেও সাহায্য করে। কারণ এতে ক্যালোরি খুবই কম—প্রায় এক গ্লাস (২৪০ মিলি) ডাবের পানিতে কেবলমাত্র ৪৬ ক্যালোরি থাকে। আর এতে কোনো ফ্যাট নেই। তাই যারা ডায়েট করছেন বা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ পানীয়।

যুক্তরাজ্যের “ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড”-এর খাদ্যবিজ্ঞানী ড. লুসি বেনেট বলেন, “আমি অনেক সময় রোগীদের সফট ড্রিঙ্ক বা প্রক্রিয়াজাত জুস বাদ দিয়ে ডাবের পানি খাওয়ার পরামর্শ দিই। কারণ এটি যেমন প্রাকৃতিক, তেমনি এতে কোনো কৃত্রিম রঙ, সংরক্ষণকারী বা অতিরিক্ত চিনি নেই।” তিনি বলেন, “বাচ্চাদের শরীরের জন্যও এটি নিরাপদ এবং খুব উপকারী।”

আরো চমকপ্রদ তথ্য হলো, ডাবের পানি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর ২০১২ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ডাবের পানিতে থাকা উচ্চমাত্রার পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়ক। এই গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ নিয়মিত ডাবের পানি খায়, তাদের রক্তচাপ অপেক্ষাকৃত কম থাকে এবং হৃদ্‌রোগের ঝুঁকিও কমে।

এছাড়া ডাবের পানি কিডনির জন্যও উপকারী। অনেক সময় কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় শরীরে পানির অভাবে। ডাবের পানি নিয়মিত খেলে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যায় এবং ইউরিনের মাধ্যমে পাথর জমার ঝুঁকি হ্রাস পায়। ২০১৮ সালে “জার্নাল অব এথনোফার্মাকোলজি”-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ডাবের পানি কিডনির পাথর প্রতিরোধে প্রাকৃতিকভাবে কার্যকর।

এই পানীয়টি ত্বকের যত্নেও সহায়ক। এতে থাকা সাইটোকাইন ও লরিক অ্যাসিড ত্বকের কোষের পুনর্গঠন এবং প্রদাহ হ্রাসে সাহায্য করে। তাই অনেকে এটি রূপচর্চার অংশ হিসেবেও ব্যবহার করেন। অনেক প্রসাধনী প্রতিষ্ঠান ডাবের পানি-ভিত্তিক স্কিন কেয়ার পণ্য তৈরি করছে।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে রাখা প্রয়োজন—যে ডাবের পানি তাজা হয়, সেটিই সবচেয়ে উপকারী। বাজারে বোতলজাত অনেক ডাবের পানিতে প্রিজারভেটিভ বা অতিরিক্ত চিনি থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না-ও হতে পারে। তাই সব সময় খোসাসহ তাজা ডাব থেকে পানি খাওয়াই সবচেয়ে ভালো।

ডাবের পানির জনপ্রিয়তা এখন বিশ্বজুড়ে। ব্রাজিল, ফিলিপাইনস, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশে এটি বহু শতাব্দী ধরে প্রাকৃতিক পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে গরমকালে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে দেখা যায় ডাব বিক্রেতা আর হাতে ডাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত মানুষজন। এই দৃশ্য যেন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও গ্রামীণ সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আমেরিকান নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্য এবং পুষ্টিবিদ লরা ম্যাকব্রাইড বলেন, “আমি যখন বাংলাদেশে ঘুরতে গিয়েছিলাম, তখন ডাবের পানি ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। এটি আমাকে গরমে হাইড্রেট রাখত, আবার পেটেও কোনো সমস্যা হতো না। পরে আমি যখন গবেষণা করে দেখি এর পুষ্টিগুণ, তখন সত্যিই অবাক হই।”

একটি বিষয় এখানে আরও বলা দরকার—ডাবের পানি খাওয়া উচিত পরিমিতভাবে। কারণ অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে এতে থাকা প্রাকৃতিক চিনির কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়াটাই ভালো।

শেষ কথা হলো, ডাবের পানি কোনো ম্যাজিক নয়, কিন্তু এটি প্রকৃতির পক্ষ থেকে আমাদের উপহার—একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং উপকারী পানীয়। শরীর ক্লান্ত হলে, পিপাসা পেলে, কিংবা রোগের সময় এক গ্লাস ডাবের পানি আমাদের যে উপকার করে, তা কোনো ওষুধ বা এনার্জি ড্রিঙ্ক দিয়েও সম্ভব নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি এক বিশুদ্ধ ‘নেচারাল হাইড্রেশন সলিউশন’। তাই ডাবের পানির গুরুত্ব কেবল গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক জীবনধারায় নয়, বরং বিশ্বজনীন এক স্বাস্থ্যবান বিকল্প হিসেবেও গণ্য হওয়া উচিত।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বাদুড় কেন উল্টো হয়ে ঝোলে ?

পাখির ক্ষেত্রে তুলনামূলক ওজন যেমন কম, তেমনি মানানসই ডানার গঠন। ডানা কতটা ভার বইতে পারে, বাতাসে দেহটাকে কতটা সাপোর্ট দেয়, সেটার ওপর নির্ভর করে ওড়ার ধরন। পাখির ওজন আর ডানার গঠন এমন, সহজেই পায়ে ভর দিয়ে আকাশে উড়তে পারে। এক্ষেত্রে নিউটনের তৃতীয় সূত্র কাজে লাগাতে হয় পাখিকে।

১ দিন আগে

বিড়াল কেন পানি দেখে ভয় পায়?

প্রথমেই আসি বিবর্তনের কথায়। আজকের গৃহপালিত বিড়ালদের পূর্বপুরুষ ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে বসবাসকারী 'আফ্রিকান ওয়াইল্ড ক্যাট' (African Wildcat)। এই বন্য বিড়ালদের প্রাকৃতিক আবাস ছিল শুষ্ক, রুক্ষ, বালুময় পরিবেশে, যেখানে পানির প্রবাহ ছিল খুবই কম। ফলে তাদের দেহ ও মন গঠিত হয়েছিল এমনভাবে, যাতে তারা কম পান

১ দিন আগে

কাঁচা মরিচের উপকারিতা

কাঁচা মরিচের প্রধান সক্রিয় উপাদান হলো ক্যাপসাইসিন। এই রাসায়নিকটি মরিচে ঝাঁজ এনে দেয় এবং এটি শরীরের স্নায়ুতন্ত্র, হজম প্রক্রিয়া, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

১ দিন আগে

খানুয়ার যুদ্ধ: ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল

খানুয়ার যুদ্ধ হয়েছিল আগ্রার কাছে খানুয়া নামের এক সমতল অঞ্চলে। এই অঞ্চল ছিল বাবরের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দিল্লি ও আগ্রার মাঝামাঝি এবং রানা সাঙার আগমন পথের কাছাকাছি।খানুয়ার যুদ্ধ হয়েছিল আগ্রার কাছে খানুয়া নামের এক সমতল অঞ্চলে। এই অঞ্চল ছিল বাবরের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি

১ দিন আগে