স্বাস্থ্য

লিভারে সমস্যার মূল কারণ কী?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৪৬

মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো লিভার। এটি শরীরের অভ্যন্তরে এক ধরনের রাসায়নিক কারখানার মতো কাজ করে, যেখানে প্রতিনিয়ত নানা জটিল কার্যক্রম চলে। খাবার হজম, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়া, চর্বি ও গ্লুকোজ জমিয়ে রাখা, এমনকি রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি—এই সব কাজই করে লিভার। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে পুরো শরীরেই নেমে আসে বিপর্যয়। অথচ আজকের দিনে এসে বিশ্বের বহু মানুষ লিভারজনিত নানা জটিলতায় ভুগছেন। প্রশ্ন হলো—লিভারের সমস্যা আসলে হয় কেন? কোন কোন কারণ লিভারকে আক্রান্ত করে? চলুন এই নিয়ে সহজ ভাষায় একটি বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

লিভার সমস্যার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, আধুনিক জীবনে মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে দ্রুতগতিতে। বাড়ছে জাঙ্ক ফুড, কোল্ড ড্রিংকস, অতিরিক্ত তেল-মসলা ব্যবহার। এসব খাবারে থাকা অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট এবং রিফাইন্ড শর্করা সরাসরি লিভারে জমতে থাকে। একে বলে ‘ফ্যাটি লিভার’ বা চর্বিযুক্ত লিভার। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক ড. মাইকেল স্ক্যালি বলেন, “বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অ্যালকোহল না খেয়েও ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এর প্রধান কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং স্থূলতা।” তিনি আরও বলেন, “এই রোগটি নিঃশব্দ ঘাতক। কোনো ব্যথা বা উপসর্গ ছাড়াই এটি লিভারকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে ফেলে।”

লিভার সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হলো—অতিরিক্ত মদ্যপান। অ্যালকোহল লিভারের কোষগুলোকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে। অ্যালকোহল মেটাবলাইজ করার সময় যে টক্সিন তৈরি হয়, তা লিভারের কোষগুলোকে ধ্বংস করে এবং চিরস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে। একসময় এটি সিরোসিসে পরিণত হয়, যেখানে লিভার কোষগুলো ঝরঝরে হয়ে যেতে থাকে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)-এর গবেষক ড. ক্যারোলিন থম্পসন বলেন, “সিরোসিস রোগীদের অনেকেই জানেন না যে, দীর্ঘদিন ধরে তারা যেসব পানীয়কে নিরীহ ভেবেছেন, সেগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ধ্বংসের বীজ।”

ভাইরাল হেপাটাইটিসও লিভারের মারাত্মক শত্রু। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস রক্তের মাধ্যমে ছড়ায় এবং দীর্ঘদিন লিভারে সংক্রমণ ঘটিয়ে ফেলে। অনেকে এই ভাইরাস শরীরে বহন করেন কিন্তু বুঝতেই পারেন না। হঠাৎ করে জন্ডিস, পেট ফোলা বা ক্লান্তিভাবের মধ্য দিয়ে রোগটি ধরা পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের Mayo Clinic-এর হেপাটোলজিস্ট ড. র‌্যাচেল টমাস বলেন, “হেপাটাইটিস হলো নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া একটি মহামারি। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা এবং ভ্যাকসিনই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র।”

লিভারের রোগের পেছনে আরেকটি বড় ভূমিকা রাখে ওজন বাড়া বা মেটাবলিক সিনড্রোম। স্থূলতা, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স—এই উপাদানগুলো একসঙ্গে লিভারে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। আমেরিকান লিভার ফাউন্ডেশনের মতে, বর্তমানে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যেও ফ্যাটি লিভার দেখা যাচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ ও পরিশ্রমের অভাব। সংস্থাটির গবেষক ড. ইভা মরিসন বলেন, “লিভারের রোগ এখন আর শুধু মধ্যবয়সীদের সমস্যা নয়, এটি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।”

অন্যদিকে, কিছু ওষুধও লিভারের ক্ষতি করতে পারে। যেমন—অতিরিক্ত প্যারাসিটামল, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে লিভারের কোষে বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এমনকি ভেষজ ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গ্রহণ করলে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

আবার, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন যেমন ঘুমের অনিয়ম, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ধূমপান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণ লিভারের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। লিভার সব সময় দেহকে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু যদি বিষাক্ত উপাদানের চাপ খুব বেশি হয়, তাহলে লিভার তার স্বাভাবিক কাজ হারিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে তৈরি হয় ক্লান্তিভাব, জন্ডিস, হজমের সমস্যা, পেট ফুলে থাকা ইত্যাদি উপসর্গ।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, লিভারজনিত রোগ এখন বিশ্বের দশটি প্রধান মৃত্যুর কারণের একটি। আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—এর বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য ছিল। এ বিষয়ে গবেষক ড. জেমস ওয়াটস বলেন, “লিভার রোগের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, এটি বহু বছর নিঃশব্দে থেকে হঠাৎ করেই মারাত্মক হয়ে ওঠে। আমাদের সচেতনতা আর খাদ্যাভ্যাসই পারে এই নীরব শত্রুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে।”

সবশেষে বলা যায়, লিভার সমস্যার মূল কারণগুলো হলো—অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ, হেপাটাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণ, ওজন ও ডায়াবেটিসজনিত চাপ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা। এই কারণগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব—সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মাদক ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা, টিকা গ্রহণ এবং সচেতন জীবনযাপনের মাধ্যমে। লিভার আমাদের জন্য নিরবভাবে কাজ করে যাচ্ছে—এবার আমাদের পালা তাকে ভালো রাখার।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কমাবেন কী করে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে জানতে হবে, অ্যাসিডিটি কেন হয়। আমাদের পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা খাবার হজমে সহায়তা করে।

১ দিন আগে

সংখ্যানুপাতিক বা পিআর নির্বাচন ব্যবস্থা আসলে কেমন

এই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো—এতে অনেক সময় জোট সরকার গঠনে দীর্ঘ সময় লাগে।

১ দিন আগে

নিষেধাজ্ঞার পাহাড় মাথায় নিয়েও ইরানের অর্থনীতি কীভাবে টিকে আছে

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের ওপর আরোপিত হয় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।

২ দিন আগে

হৃদরোগের লক্ষণগুলো কীভাবে বুঝবেন

হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ করেই হয় বলে অনেকে মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় আগেভাগে কিছু সংকেত দেয় শরীর, যা যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে অনেক বড় বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব।

২ দিন আগে