ইতিহাস

দেশে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার একাল-সেকাল

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১৯: ১৬
চ্যাটজিপিটির চোখে এফ ৭ যুদ্ধবিমান

বাংলাদেশের আকাশপথ, একসময় যা শুধু উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো, আজ তা অনেকের চোখে নিরাপত্তাহীনতার এক বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে যেসব বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা শুধু দেশের নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একেকটি ট্র্যাজিক ‘মাইলস্টোন’। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কয়েকটি দুর্ঘটনা মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।

১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরে পোস্টাগোলা এলাকায় এয়ার পেরাব্যাট এয়ারলাইন্সের একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয় যান্ত্রিক সমস্যার কারণে। বিমানে ছিলেন প্রশিক্ষণকারী পাইলট ফারিয়া লারা ও কো‑পাইলট রফিকুল। উভয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হয় এবং ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। ফারিয়া লারা ছিলেন ঢাকায় বাসিন্দা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন এবং পাইলট লাইসেন্স অর্জন করেছিলেন মাত্র কয়েক বছর আগে।

এর প্রায় সতের বছর পর, ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দর থেকে take‑off করার সময় বাংলাদেশ ফ্লাইয়িং একাডেমি‑এর একটি Cessna D‑১৫২ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে ২২ বছর বয়সী ট্রেইনি পাইলট তামান্না রহমান রুহদি মারা যান, এবং ট্রেইনার সাঈদ কামাল গুরুতর আহত হন।

এই দুটো ঘটনা একদিকে ছিল প্রশিক্ষণ বিমানের হতাহতের দৃষ্টান্ত; অন্যদিকে, সামরিক প্রশিক্ষণেও প্রাণহানির তালিকা দীর্ঘ। গত ২০ বছরে অন্তত ১৫ জন পাইলট ও সাধারণ মানুষ প্রশিক্ষণ ফ্লাইট দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ২০২৪ সালের ৯ মে, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা নদীতে YAK‑১৩০ প্রশিক্ষণ জেট বিধ্বস্ত হয়ে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ মারা যান।
  • ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর, Tangail‑এর মধুপুর উপজেলায় F‑৭ জেট বিধ্বস্ত হয়, যেখানে আরিফ আহমেদ দিপু নিহত হন।
  • ২০১৮ সালের ১ জুলাই, যশোর সদর উপজেলায় K‑৮W প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়, দুইজন স্কোয়াড্রন লিডার মারা যান।
  • এছাড়াও ২০১৫, ২০১৩, ২০১০, ২০০৮ সহ বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা ঘটেছে যেসব উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি ছাড়াও বহু গুরুতর আঘাত ও ক্ষতির ঘটনা রেখেছে।

তুন করে আলোচিত হয় ২০২৫ সালের ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুলে F‑৭ ফাইটার জেট বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা আবার পুরোনো দুর্ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসছে। এই দুর্ঘটনাগুলো আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তুলে ধরছে—প্রশিক্ষণ বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে কী যার কারণে এভাবে জীবন হানির সংখ্যা বাড়ছে?

আন্তর্জাতিক গবেষকরা এই প্রসঙ্গে সর্তকবার্তা দেন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স-এর অ্যারোস্পেস নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. জনাথন হিল বলেছেন, “ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পুরনো যুদ্ধবিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ চালনা করা মানেই বিপদসংকুল দায়িত্বজ্ঞানহীনতা”—এতে বোঝা যায় শুধু বিমানের বয়স নয়, বরং এখানকার পরিকল্পনা ও রুট নির্ধারণেও গুরুতর ত্রুটি রয়েছে ।

আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা ICAO‑র DOC ১০০৮৮ অনুযায়ী, সামরিক ও বেসামরিক বিমানের অপারেশনগুলিকে বিচ্ছিন্ন ও সুপরিকল্পিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে প্রশিক্ষণ রুট ও নিয়ন্ত্রণে এই প্রটোকল যথাযথভাবে অনুসরণ হচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন ।

ফারিয়া লারা এবং তামান্নার মৃত্যু কেবল একটি ট্র্যাজিক ঘটনার চেয়ে বেশি—সে হলো নারী পাইলটদের সম্ভাবনাকে ঘোরতরভাবে বাধাপ্রাপ্ত করা, যেখানে নিরাপত্তার অভাবে দক্ষ প্রশিক্ষণের পথ সূক্ষ্মতা হারিয়ে ফেলে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তাহলে এখন প্রয়োজন কী? শুধু প্রতিটি দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা নয়—তবে:

  • প্রশিক্ষণের জন্য নির্জন ও সংকীর্ণ অঞ্চলে নিরাপদ রুট নির্ধারণ
  • পুরনো বা ঝুঁকিপূর্ণ বিমানের বদল
  • পাইলট প্রশিক্ষণের SOP কঠোর বাস্তবায়ন
  • নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ
  • নিহতদের পরিবারের প্রতি মানবিক ও যথোপযুক্ত সহায়তা নিশ্চিত করা।

যতক্ষণ এ বিষয়গুলো সমাধানযোগ্য নয়, ততক্ষণ প্রশিক্ষণ সকলেই ঝুঁকি মুক্ত ভাবেই প্রত্যাশা করতে পারবে না।

এফ‑৭ মাইলস্টোন দুর্ঘটনার মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলোর ছায়ার নিচে, ফারিয়া লারা ও অন্যান্য প্রশিক্ষণক্ষেত্রের দুর্ঘটনা আমাদের স্পষ্ট করে—নিরাপত্তা শুধু বেসামরিক নয়, সামরিক ও প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পেতে হবে।

এই টানা ফিচারদেশের বিমানয়াতায় নিরাপত্তার দুর্বলতা ও সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে, যেখানে প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধুমাত্র একটি সংঘটন নয়, বরং পরিবর্তনের আহ্বান।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

এফ-৭ যুদ্ধবিমান: সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প

এই বিমানের ইতিহাসে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত যুগান্তরের ছাপ। ১৯৬০-এর দশকে চীন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে মিগ-২১ যুদ্ধবিমান কেনে। তখন থেকেই তারা এর নিজস্ব সংস্করণ তৈরির উদ্যোগ নেয়। কারণ, সোভিয়েতরা পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারণে বিমান সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

২ দিন আগে

কচুরিপানায় যায় যায় নড়াইলের চিত্রা

সরেজমিন নদীটির রতডাঙ্গা, সাবেক শেখ রাসেল সেতু, আউড়িয়া এস এম সুলতান সেতু, গোবরা বাজার, শিঙ্গাশোলপুর বাজার, চুনখোলা সেতুর অংশ ঘুরে দেখা গেছে নদীতে ঘন কচুরিপানা। সেখানে পানি আছে কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। কোনো নৌযান চোখে পড়েনি। অনেক বস্তু নদীর কিছু এলাকায় কচুরিপানায় আটকা পড়ে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পাড়ে

২ দিন আগে

বিমান কেন বিধ্বস্ত হয় , বিজ্ঞান কী বলে?

বিমানে মানুষ চালায়। তাই মানুষের মানসিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি ভয় পায় বা চাপে ভেঙে পড়ে, তবে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ড. টমাস হফম্যান বলেন, “শান্ত মন আর মাথা ঠান্ডা না থাকলে পাইলট ভুল করে ফেলতে পারেন। তখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন তৈরি হয়।”

২ দিন আগে

সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ফরিদা পারভীন

ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ফরিদা সোমবার (২১ জুলাই) রাতে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন।

২ দিন আগে