মহাকাশ
তবে কি মিলছে প্ল্যানেট নাইনের খোঁজ!

আমাদের সৌরজগৎ নিয়ে কল্পনা করতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সূর্য আর তার চারপাশে ঘুরতে থাকা আটটি গ্রহ—বুধ থেকে শুরু করে নেপচুন পর্যন্ত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই সন্দেহ করে আসছিলেন, নেপচুনের বাইরেও হয়তো আরও একটি গ্রহ লুকিয়ে আছে, যাকে ‘প্ল্যানেট নাইন’ নামে ডাকা হয়। এবার সেই রহস্যময় গ্রহের একটি সম্ভাব্য প্রমাণ পাওয়া গেছে পুরনো দুইটি ইনফ্রারেড (তাপ-ভিত্তিক) মহাকাশ জরিপের মাঝে—যার একটি করা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, অপরটি ২০০৬ সালে।
২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন ও কনস্টানটিন বাটিগিন প্রথম প্ল্যানেট নাইনের ধারণা দেন। তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন, নেপচুনের বাইরে অবস্থিত কিছু বরফঘেরা বস্তু (যেমন সেডনা) অদ্ভুতভাবে একই দিকে কাত হয়ে কক্ষপথে ঘুরছে। এই অস্বাভাবিক আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁরা ধারণা দেন—সেখানে নিশ্চয়ই এক বিশাল গ্রহ আছে যার মহাকর্ষীয় টান এসব বস্তুকে প্রভাবিত করছে।
তাইওয়ানের ন্যাশনাল সিং হুয়া ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী টেরি লং ফান এবং তাঁর গবেষক দল পুরনো ইনফ্রারেড ডেটা ঘেঁটে এমন একটি বস্তু খুঁজে পেয়েছেন যা সময়ের সঙ্গে জায়গা বদলেছে—১৯৮৩ সালে ইর্যাস (IRAS) স্যাটেলাইটের ছবি এবং ২০০৬ সালে আকারি (AKARI) স্যাটেলাইটের ছবিতে তার অবস্থান আলাদা। দুই ছবির মাঝে ২৩ বছরের ব্যবধানে বস্তুটি প্রায় ৪৭ আর্কমিনিট দূরত্ব অতিক্রম করেছে। যদি এই বস্তু সত্যিই প্ল্যানেট নাইন হয়, তবে এটি এখন সূর্য থেকে ৭০০ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (AU) বা ১০৫ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে রয়েছে, যা পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৭০০ গুণ দূরে।
এটি কি সত্যিই একটি গ্রহ?
এই মুহূর্তে প্ল্যানেট নাইনের কক্ষপথ সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি, তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এটি আসলেই সেই খোঁজ করা গ্রহ কিনা। তবে ইনফ্রারেড ছবিতে বস্তুটির উজ্জ্বলতা দেখে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, এটি নেপচুনের থেকেও ভারী হতে পারে।
ফান বলছেন, “আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এটি হয়তো পৃথিবীর চেয়ে একটু বড় একটি গ্রহ হবে, কিন্তু এখন যা দেখা যাচ্ছে, এটি সম্ভবত নেপচুনের মতো বিশাল।”
কীভাবে এল এই গ্রহ?
যদি এই বস্তু সত্যিই প্ল্যানেট নাইন হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে—এটি এতো দূরে কীভাবে এল?
ফান বলেন, “সম্ভাবনা আছে যে গ্রহটি মূলত বৃহস্পতি কিংবা শনি যেখানে গঠিত হয়েছিল, সেখান থেকেই সৌরজগতের শুরুর দিকে অন্য বড় গ্রহদের মহাকর্ষীয় টানে এটা বহুদূরে ছিটকে পড়ে।” আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, এটি হয়তো এক সময় অন্য কোনো নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরতো এবং আমাদের সূর্য তাকে নিজের কক্ষপথে টেনে এনেছে—একটি ‘রোগ গ্রহ’ হিসেবে।
এই বস্তুকে নিশ্চিত করতে হলে এখন আরো আধুনিক টেলিস্কোপ দিয়ে এর অবস্থান নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। ফান বলছেন, “যদি আমরা জানি বস্তুটি কোথায় রয়েছে, তাহলে বড় টেলিস্কোপে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে সহজেই দেখা যাবে এটি কী।” এই কাজে ব্যবহার হতে পারে চিলির ব্ল্যাঙ্কো টেলিস্কোপের ‘ডার্ক এনার্জি ক্যামেরা’, যার দৃষ্টিক্ষেত্র অনেক বড়।
এই খোঁজ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষকরা বেশ উৎসাহিত। মাইকেল রোয়ান-রবিনসন, লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ২০২১ সালে IRAS ডেটা ঘেঁটে এমনই এক বস্তু খুঁজে পেয়েছিলেন, যদিও সেটা পরবর্তীতে অন্য কোনো ডেটাতে নিশ্চিত হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যামস বুলার বলেন, “যদি প্ল্যানেট নাইন থেকে থাকে, তবে আমাদের সৌরজগৎ সম্পর্কে অনেক পুরনো ধারণা পাল্টে যাবে। এটি বোঝাবে যে আমাদের পরিচিত পৃথিবী-কেন্দ্রিক সৌরজগৎ আসলে আরো বিশাল ও জটিল।”
প্ল্যানেট নাইনের অস্তিত্ব এখনো নিশ্চিত হয়নি। কিন্তু টেরি ফান ও তাঁর দলের গবেষণা আমাদের সামনে নতুন একটি জানালার মতো খুলে দিয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারা সি. রুবিন অবজারভেটরি ও ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপ ভবিষ্যতে এই গ্রহের খোঁজে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—যদি সত্যিই প্ল্যানেট নাইন থেকে থাকে, তবে সেটা কতদিনের মধ্যে আমরা দেখতে পাব? সময়ই বলবে। তবে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান বলে দিচ্ছে—আমাদের সৌরজগৎ এখনো অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, যা শুধু অপেক্ষা করছে খুঁজে পাওয়ার।
সূত্র: স্পেস ডট কম