মহাকাশ
বিচিত্র এক ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা

মহাবিশ্ব আমাদের কাছে এক বিশাল রহস্যের নাম। তারার আলো, গ্রহের ঘূর্ণন, ছায়াপথের বিস্তার—সব কিছুই যেন মহাজাগতিক এক নাটকের অংশ। এই নাটকের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্রগুলোর একটি হলো কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। অদৃশ্য, অথচ ভয়ানক। এই মহাজাগতিক দৈত্যদের নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এমন এক কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন, যা আগের সব ধারণা বদলে দিতে পারে। কারণ, এই কৃষ্ণগহ্বর একা। তার কোনো সঙ্গী তারা নেই। এটি যেন নিঃসঙ্গ এক মহাজাগতিক যাযাবর।
কৃষ্ণগহ্বর আসলে কী?
কৃষ্ণগহ্বর হলো এমন এক জায়গা, যেখানে মহাকর্ষ এত বেশি যে আলোও সেখানে থেকে পালাতে পারে না। তাই আমরা সরাসরি কোনো কৃষ্ণগহ্বর দেখতে পারি না। তবে এর আশপাশের বস্তু, বিশেষ করে কোনো সঙ্গী তারা থাকলে, সেটির গতি ও আলোর বিচ্যুতি দেখে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব বোঝা যায়। সাধারণত কৃষ্ণগহ্বরকে আবিষ্কার করার পেছনে সঙ্গী তারার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এবার যা পাওয়া গেছে, তা একেবারে ব্যতিক্রম। মিল্কিওয়ে ছায়াপথেই বিজ্ঞানীরা এমন এক কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন, যার কোনো সঙ্গী তারা নেই। অর্থাৎ, এটি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কৃষ্ণগহ্বর পৃথিবী থেকে প্রায় ৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই আবিষ্কারটি প্রথম জানান দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের জ্যোতির্বিদ কৈলাশ সাহু ও তাঁর দল।
তাঁরা ২০২২ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে ধনু তারামণ্ডলে একটি অদ্ভুত গতি সম্পন্ন অন্ধকার বস্তু আবিষ্কার করেন। প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন, এটি হয়তো একটি নিউট্রন তারা—অর্থাৎ একটি মৃত তারা, যার কেন্দ্রে বিপুল ঘনত্ব থাকে। কিন্তু পরে বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই বস্তুটি আসলে একটি কৃষ্ণগহ্বর। গবেষক দল হাবল ও গাইয়া স্পেস প্রোবের তথ্য ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর আলো শোষণ করে নেয়, তাই তা সরাসরি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু তারা বা অন্য কোনো আলোকউৎস যখন কৃষ্ণগহ্বরের সামনে দিয়ে যায়, তখন আলোর পথে বাঁক তৈরি হয়। এটিকে বলে "মহাকর্ষীয় লেন্সিং"। এবারও এমনই এক ঘটনা ঘটে। একটি দূরবর্তী তারা যখন এই অন্ধকার বস্তুটির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন বিজ্ঞানীরা তার আলোর পথের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন।
সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে হিসাব করে দেখা যায়, অন্ধকার বস্তুটির ভর আমাদের সূর্যের প্রায় সাত গুণ। নিউট্রন তারার ভর সাধারণত এত বেশি হয় না। তাই গবেষকেরা নিশ্চিত হন—এটি একটি কৃষ্ণগহ্বর। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশে কোনো সঙ্গী তারা নেই।
এই আবিষ্কার শুধু একটি কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে পাওয়ার গল্প নয়। এটি আমাদের মহাবিশ্ব বোঝার পদ্ধতিতেই নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। কারণ এর আগে যত কৃষ্ণগহ্বর আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি, সব কটির ক্ষেত্রেই আশেপাশে কোনো তারা ছিল। কিন্তু এবার সেই প্রচলিত নিয়ম ভেঙে প্রথমবার এমন একটি কৃষ্ণগহ্বর পাওয়া গেল, যেটি একা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মহাবিশ্বে হয়তো এরকম আরও বহু একাকী কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, যাদের এখনো আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। এরা কোথা থেকে এলো, কীভাবে তৈরি হলো, কেন একা—এসব প্রশ্ন ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রইল।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০২৭ সালে উৎক্ষেপণযোগ্য ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে এই একা কৃষ্ণগহ্বরটির ওপর আরও গভীর পর্যবেক্ষণ চালানো হবে। তখন হয়তো আমরা জানতে পারব, এর গঠন কেমন, গতি কত, কীভাবে এটি তৈরি হয়েছিল, এমনকি এর আশেপাশে কী ধরনের পরিবেশ রয়েছে।
মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে নতুন রহস্য উন্মোচন করে। আলোহীন, একা এক কৃষ্ণগহ্বর তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে আমাদের চমকে দিয়েছে। এটি শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায় নয়, বরং মানব কল্পনার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করে দিয়েছে। কে জানে, এমন আরও কত একা ভ্রমণকারী আজও আলো ছুঁয়ে যেতে পারছে না, আমাদের অজান্তেই মহাবিশ্বের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে?