প্রযুক্তি

ফেরিডুবির ঘটনা বিশ্বে এত কম কেন?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

ইন্দোনেশিয়ায় আজ একটি ফেরি ৬৫ জন যাত্রীসহ ডুবে গিয়েছে। সচরাছর অন্য যেকোনো নৌযানের চেয়ে ফেরি ডুবে নিহতের হার কম। ফেরি এথ কম ডোবে কেন, কী প্রযুক্তি ব্যবহার হয় এতে?

বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে ফেরি মানেই গুরুত্বপূর্ণ এক পরিবহন ব্যবস্থা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ, যানবাহন আর পণ্য পরিবহন হয় এই ফেরিগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—এত পানি, এত ঝুঁকি, অথচ কেন ফেরি ডোবার ঘটনা খুবই কম ঘটে? আমরা প্রায়ই বাস দুর্ঘটনার খবর শুনি, প্লেন ক্র্যাশের কথাও জানতে পারি, এমনকি ট্রলার বা নৌকাডুবির ঘটনাও আমাদের পরিচিত। কিন্তু ফেরি ডোবার ঘটনা এত বিরল কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এক গভীর পরিকল্পনা, বিজ্ঞানভিত্তিক নকশা, এবং ফেরি পরিচালনায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে।

প্রথমেই আসা যাক ফেরির নকশা বা ডিজাইনের কথায়। ফেরি একধরনের জাহাজ হলেও তার নির্মাণ পদ্ধতি একটু ভিন্ন। সাধারণ জাহাজের চেয়ে ফেরিকে অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ এবং স্থিতিশীলভাবে তৈরি করা হয়। যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. স্যাম কার্টার বলেন, “ফেরিগুলো চওড়ায় বেশি এবং নীচের অংশ ফ্ল্যাট বা সমান হয়, যাতে জলরাশিতে ভেসে থাকতে সহজ হয় এবং ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। এটি এক ধরনের নকশাগত নিরাপত্তা।”

এই নকশার কারণে হঠাৎ কোনো একদিকে ভার বেশি হয়ে গেলেও ফেরি সহজে উল্টে যায় না। এমনকি কোনো দিকে ঢেউ উঠলেও বা একটু হেলেও পড়ে, তার কেন্দ্রীয় ভারসাম্য বজায় থাকে। অনেক সময় আমরা দেখি, ফেরিতে অসংখ্য গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষ থাকে—তবুও এটি স্থির ভেসে থাকে। এটি সম্ভব হয় ‘ডিসপ্লেসমেন্ট থিয়োরি’ নামের একটি নৌবৈজ্ঞানিক সূত্রের কারণে, যা বলছে—জলের যে পরিমাণ স্থান একটি ভাসমান বস্তু নেয়, সেটি যদি তার ওজনের সমান হয়, তবে সেটি ভেসে থাকবে।

তাছাড়া, ফেরিতে থাকে বিশেষ ধরনের চেম্বার বা কক্ষ, যেগুলো জলে ভর্তি হলেও পুরো ফেরিকে ডোবার হাত থেকে রক্ষা করে। এগুলিকে বলা হয় 'ওয়াটারটাইট কমপার্টমেন্ট'। যদি কোনো দুর্ঘটনায় ফেরির নিচে ফুটো হয় বা কিছুটা পানি ঢুকে পড়ে, তাও অন্যান্য চেম্বার শুকনো থেকে ফেরিকে ভেসে থাকতে সাহায্য করে।

আধুনিক ফেরিগুলোতে থাকে শক্তিশালী জিপিএস, রাডার, ইকো-সাউন্ডার এবং অটোমেটিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল ব্যবস্থা। এসব প্রযুক্তি চালকের হাতে আগাম সংকেত পাঠায়—আবহাওয়া খারাপ, ঢেউ বাড়ছে, নাব্যতা কম—সবকিছুই আগে থেকে জানিয়ে দেয়। এর ফলে চালক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পরিবহন গবেষক ড. লুইস পেরেজ বলেন, “ফেরি চালানো যতটা সহজ মনে হয়, তা নয়। এটি একটি সাবধানে পরিচালিত প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া। প্রতি ইঞ্চি ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়। তার ওপর ফেরিচালকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকে—যা একটি নিরাপদ যাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এছাড়া, ফেরি চলাচলের সময় আবহাওয়া, নদীর গভীরতা, প্রবাহের গতি, এমনকি নদীর মোড়ের তথ্য পর্যন্ত রুটিন মনিটরিং করা হয়। ফেরি পারাপারে সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বিআইডব্লিউটিসি বা বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন এবং বিআইডব্লিউটিএর মতো কর্তৃপক্ষ নিয়মিত তথ্য নিয়ে কাজ করে। ফেরি চালানো হয় নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী, যা এর নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করে।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—ফেরির গতি। বাস বা ট্রেনের মতো ফেরি কখনোই খুব বেশি গতিতে চলে না। তার গতি তুলনামূলকভাবে কম, যাতে জলের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়, এবং ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা কম থাকে।

এইসব কারণের ফলে দেখা যায়, বিশ্বজুড়েই ফেরি দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত কম। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ম্যারিটাইম রিপোর্ট অনুযায়ী, সামগ্রিক জাহাজ দুর্ঘটনার তুলনায় ফেরি দুর্ঘটনার হার মাত্র ১ শতাংশের নিচে। আর যেসব দুর্ঘটনা হয়, তার বেশিরভাগই ঘটে উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তাহীন ছোট দেশে, যেখানে নিয়ম না মানার প্রবণতা বেশি।

বাংলাদেশেও কিছু ফেরি দুর্ঘটনার খবর আমরা পেয়েছি, কিন্তু তা শতকরা হারে অত্যন্ত কম। বরং নদীপথে চলাচলকারী ট্রলার, ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা যাত্রীবাহী ছোট নৌযানই বেশি ডুবে। কারণ এগুলোর মধ্যে নিরাপত্তাব্যবস্থা ততটা নেই, পরিচালনাও অনেক সময় নিয়মবহির্ভূত হয়।

নিরাপদ ফেরি চলাচলের পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। ফেরিগুলো সাধারণত নির্দিষ্ট ঘাট থেকে ঘাট পর্যন্ত চলে, মাঝপথে থামে না, পথ হারায় না। তাই দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কমে যায়।

সবশেষে বলা যায়, ফেরি আসলে আধুনিক প্রযুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং প্রাকৃতিক বাস্তবতা মিলিয়ে এক চমৎকার ভারসাম্যের ফল। এর নকশা, গতি, নিরাপত্তাব্যবস্থা, এবং পরিচালনার কৌশল সব মিলিয়ে একে করে তুলেছে খুবই স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য এক যান।

তাই আমরা যখন ফেরিতে উঠি, তখন ভাবতে পারি—এটি শুধু একটি জলযান নয়, এটি এক ধরনের ভাসমান প্রযুক্তি, যার ভেতর আছে বিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল আর অনেক মানুষের যত্ন। আর সে কারণেই ফেরি ডোবার ঘটনা এতটা বিরল, যা আমাদের নদীমাতৃক দেশের জন্য এক স্বস্তির কথা।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

নিম্নচাপ কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় নিম্নচাপ হলো একটি এমন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি যেখানে বাতাসের চাপ চারপাশের তুলনায় কম হয়ে যায়। সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাতাস সবসময় উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।

১২ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১ দিন আগে

খালি পেটে লেবু খাওয়া ক্ষতিকর!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই অভ্যাস বশে এক গ্লাস লেবু পানি খান। বিজ্ঞাপন আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে এমন ধারণা ছড়িয়ে গেছে যে খালি পেটে লেবু খেলে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যায়, ওজন কমে, আবার হজমশক্তিও নাকি বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি খালি পেটে লেবু খাওয়া এতটা উপকারী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেবুর কিছু ভালো দিক

১ দিন আগে

কেন ভাদ্র মাসে তাল পাকে?

১ দিন আগে