ফিচার

ধূমপান ছাড়ার পর শরীরে যে পরিবর্তন ঘটে

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ২১
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

ধূমপান বহু মানুষের জীবনের অংশ হয়ে থাকে, কিন্তু খুব কম মানুষই বুঝতে পারেন নিকোটিন নামের এই আসক্তির বন্ধন কতটা শক্ত। ধূমপান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিঃসন্দেহে সাহসী পদক্ষেপ। তবে এই সাহসের পরীক্ষাটা সহজ নয়, কারণ ধূমপান ছাড়ার পর শরীর ও মনের ভেতর নানা ধরণের পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তনগুলোর অনেকটাই আসলে শরীরের নিকোটিন-নির্ভর অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার প্রক্রিয়া, যাকে বিশেষজ্ঞরা “উইথড্রয়াল সিনড্রোম” বলেন। প্রথম দিকে এটি কিছুটা অস্বস্তিকর হলেও সময়ের সঙ্গে শরীর নিজে থেকেই মানিয়ে নেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ সুফল বয়ে আনে।

ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শরীরে আশ্চর্যজনক পরিবর্তন শুরু হয়। রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা কমতে থাকে, অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে। নিকোটিন ধীরে ধীরে রক্ত থেকে কমে যেতে থাকে, ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণের স্বাভাবিক চক্রে বিঘ্ন ঘটে। ডোপামিন এমন এক রাসায়নিক যা আনন্দ, স্বস্তি ও মনোযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই নিকোটিনের অভাবে প্রথম দিকে খিটখিটে মেজাজ, মনোযোগের ঘাটতি, অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। অনেকেই বলেন, ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম তিন দিন সবচেয়ে কঠিন সময়, কারণ এই সময়েই উইথড্রয়াল সবচেয়ে তীব্র হয়।

শারীরিক দিক থেকে দেখা যায়, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, গলার খুসখুসানি, কাশি, এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। বিশেষ করে কাশি ও গলার অস্বস্তি অনেককে ভয় পাইয়ে দেয়, কিন্তু এটি আসলে ভালো লক্ষণ। দীর্ঘদিন ধূমপানের ফলে ফুসফুসে জমে থাকা মিউকাস ও ক্ষতিকর কণাগুলো বের হয়ে আসতে শুরু করে, ফলে শ্বাসযন্ত্র পরিষ্কার হয়। কানাডার সেন্টার ফর অ্যাডিকশন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ-এর চিকিৎসক ড. পল গ্রাহাম এ বিষয়ে বলেন, “ধূমপান ছাড়ার পর যে কাশি ও গলার জ্বালা হয়, তা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটি ফুসফুসের প্রাকৃতিক পরিষ্কার হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ।”

মানসিক দিক থেকেও অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। নিকোটিনের অভাবে শরীরের ‘রিওয়ার্ড সিস্টেম’ বা পুরস্কার-ভিত্তিক প্রতিক্রিয়া বদলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজ-এর পরিচালক ড. নোরা ভলকো বলেন, “নিকোটিন আসক্তি ভাঙা শারীরিক ও মানসিক দুই দিক থেকেই চ্যালেঞ্জিং। তবে শরীর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মানিয়ে নেয়, আর দীর্ঘমেয়াদে এটি স্বাস্থ্যর জন্য অসাধারণ সুফল বয়ে আনে।” প্রথম দিকে উদ্বেগ, মনমরা ভাব, এমনকি হালকা বিষণ্নতাও হতে পারে। অনেকের ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং খাবারের স্বাদ-গন্ধ নতুনভাবে অনুভব করতে শুরু করেন। নিকোটিন ক্ষুধা দমন করে, তাই এটি বাদ পড়লে খাবারের রুচি বাড়ে এবং ওজনও কিছুটা বাড়তে পারে।

সময়ের সাথে এই পরিবর্তনগুলোর তীব্রতা কমতে থাকে। সাধারণত প্রথম এক সপ্তাহ সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়। দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে শ্বাস নিতে স্বাচ্ছন্দ্য আসে, শক্তি ও সহনশীলতা বাড়ে। তিন মাসের মধ্যে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা অনেকটাই উন্নত হয়। অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা অনেকের ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে, তবে শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ঘুমের ছন্দ ফিরে পায়।

ধূমপান ছাড়ার পর স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি ফিরে আসা অনেকের জন্য আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন ধূমপানের ফলে নাক ও জিভের সেন্সর বা রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হয়। ফলে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ আরও তীব্রভাবে অনুভূত হয়। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হলো—এই বাড়তি অনুভূতির কারণে অনেক সময় অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তাই বিশেষজ্ঞরা এই সময় সুষম খাদ্যাভ্যাস ও পর্যাপ্ত পানি পানের পরামর্শ দেন।

শরীর শুধু নিকোটিন নয়, ধূমপানের মাধ্যমে গ্রহণ করা চার হাজারেরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব থেকেও মুক্তি পেতে শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান ছাড়ার মাত্র ২০ মিনিট পরই রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, হাঁটাচলা ও শারীরিক কার্যকলাপ সহজ হয়।

দীর্ঘমেয়াদে সুফল আরও বড়। এক বছর ধূমপান না করলে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমে যায়। ৫ বছর পর স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। ১০ বছর পর ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি ধূমপায়ী ব্যক্তির তুলনায় অর্ধেক হয়ে যায়। এ ছাড়া মুখ, গলা, অন্ননালী, মূত্রথলি ইত্যাদি ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেকটাই কমে যায়।

তবে এসব সুফল পেতে প্রথম কয়েক সপ্তাহের অস্বস্তি পার করতে হয়। এজন্য মানসিক প্রস্তুতি ও সহায়তা খুব জরুরি। অনেকেই পরিবার, বন্ধু বা সাপোর্ট গ্রুপের সাহায্য নিয়ে সফল হন। কেউ কেউ নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, যেমন নিকোটিন গাম বা প্যাচ ব্যবহার করেন, যা উইথড্রয়াল উপসর্গ কিছুটা কমাতে সাহায্য করে। তবে এসব ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—ধূমপান ছাড়ার পর যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো দেখা দেয়, সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক। এগুলোকে ভয় না পেয়ে বরং শরীরের পুনর্গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত। কারণ এই প্রতিটি পরিবর্তনই আপনার শরীরকে সুস্থ জীবনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। নিকোটিন-মুক্ত জীবনের প্রথম কয়েক সপ্তাহ যতই কঠিন হোক না কেন, পরবর্তী বছরগুলোতে এর সুফল আপনার স্বাস্থ্য, আয়ুষ্কাল ও জীবনযাত্রার মানে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

বদহজম দূর করার উপায়

এক গ্লাস হালকা গরম পানি খেলে বদহজমের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। পানি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং পেটের ভেতরে জমে থাকা অতিরিক্ত এসিডকে পাতলা করে দেয়।

১৮ ঘণ্টা আগে

সাপ কেন আঁকাবাঁকা হয়ে পথ চলে?

সাপের মেরুদণ্ডে অসংখ্য হাড় আর পেশী আছে। এই হাড় ও পেশীর সাহায্যে তারা শরীর বাঁকায়, সঙ্কুচিত করে আবার প্রসারিত করে। একেকটা অংশ মাটিতে ধাক্কা দেয়, আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী মাটিও পাল্টা চাপ দিয়ে সাপকে সামনে এগিয়ে দেয়।

২ দিন আগে

গণতন্ত্রের গলদ

গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণই ক্ষমতার উৎস। সেটা আজকাল কেউ মানে বলে মনে হয় না। সে বাংলাদেশেই হোক বা যুক্তরাষ্ট্র—ক্ষমতাসীন নেতাদের সবাই নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে। গণতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য

২ দিন আগে

লাউয়ের পুষ্টিগুণ

লাউ মূলত ৯০ শতাংশেরও বেশি পানি দিয়ে তৈরি। তাই গরমকালে শরীর ঠান্ডা রাখতে এটি দারুণ কাজ করে। যারা নিয়মিত লাউ খান, তারা জানেন যে এটি হজমে সহায়ক, শরীরের অতিরিক্ত তাপ কমায় এবং প্রস্রাবের সমস্যা দূর করে।

২ দিন আগে