রাজনীতি

স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচন

অরুণাভ বিশ্বাস
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৫৮
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। গণতন্ত্র, মুক্তি, ন্যায়ের স্বপ্নে উদ্বেলিত একটি জাতি তখন নতুন পথচলা শুরু করেছিল। সেই পথচলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল নির্বাচন—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার গঠনের হাতিয়ার। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা ধরনের নির্বাচন—জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ—যার প্রতিটি রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ। এই দীর্ঘ নির্বাচনী ইতিহাসে যেমন ছিল গণতন্ত্রের উদ্ভাস, তেমনই ছিল সহিংসতা, কারচুপি ও অনিয়মের ছায়া। তবে প্রতিটি নির্বাচনই কোনো না কোনোভাবে এই জাতির রাজনৈতিক পরিণতির রূপরেখা গড়েছে।

১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের তাজা আবেগ ছিল এই নির্বাচনের প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু এই নির্বাচনের মাত্র দুই বছর পরেই বাংলাদেশে ঘটে যায় এক নির্মম রাজনৈতিক বিপর্যয়—১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হন সামরিক অভ্যুত্থানে। এরপর থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনী ধারায় দেখা দেয় অস্থিরতা ও সামরিক হস্তক্ষেপের ছায়া।

এরপর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তিনি একটি একটি গণভোট আয়োজন করেন। ‘হ্যাঁ ও না ভোট’ ছিল সেটা । এই ভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে। পরে ১৯৭৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি ২০৭ আসনে জয়লাভ করে আবার ক্ষমতায় আসে।

১৯৮১ সালের জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর আবারো দেশে সামরিক শাসনের সূচনা হয়—এইবার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরে। তিনি ১৯৮৬ সালে একটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে। এই নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মহল ব্যাপকভাবে ছিল।

নরওয়ের গবেষক ড. ক্রিস্টিন লিডার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করছেন, তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশের ৮০ ও ৯০-এর দশকে নির্বাচন ছিল অনেকটা রাজনৈতিক লড়াইয়ের রণক্ষেত্রের মতো, যেখানে গণতন্ত্রের চেয়ে ক্ষমতা দখলই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।”

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় এক বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনেই সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার কারণে এটি ‘স্বচ্ছ’ নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই নির্বাচন থেকে শুরু হয় দুই দলের—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—মিজক্যাল চেয়ারের রাজনীতি। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রতিটিতেই এই দুই দলের সংঘর্ষ, জোট গঠন, অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ ছিল নির্বাচনী মাঠের বৈশিষ্ট্য।

২০০৬-২০০৮ সময়কালে বাংলাদেশ পড়েছিল গভীর রাজনৈতিক সংকটে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সেনা-সমর্থিত এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে এবং দুই শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী—শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করা হয়। এই সময় দেশজুড়ে চলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের যিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেমোক্র্যাসি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ও বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ল্যারি ডায়মন্ড ২০০৯ সালে এক সেমিনারে বলেন, “২০০৮ সালের বাংলাদেশ নির্বাচন ছিল গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার এক সাহসী প্রয়াস, যদিও রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও শাসন কাঠামোর দুর্বলতা সে চেষ্টাকে পুরোপুরি সফল হতে দেয়নি।”

২০১৪ সালের নির্বাচনটি ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। ফলে দেশের অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও ‘গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের নিচে’ বলে অভিহিত করেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনও বিতর্ক এড়াতে পারেনি। এসময় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের প্রসঙ্গ ওঠে, এবং বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অংশ নিলেও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সেনাবাহিনীর ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তীব্র সমালোচনা উঠে। টার্নআউট ছিল বিপুল, রাতেই ছিল দেওয়া ব্যালটে বাক্স ভরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক জেমস মিকলওয়েট এক নিবন্ধে লেখেন, “২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল একটি ‘প্রতীকী ভোট’, যেখানে ফলাফল অনেকাংশেই পূর্বনির্ধারিত মনে হয়েছে।”

স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর ইতিহাসও কম রোমাঞ্চকর নয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সহিংসতা, দলীয় প্রভাব, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি বহু অভিযোগ ছিল সবসময়ই।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও এই দীর্ঘ ইতিহাসে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। সংবিধান অনুযায়ী, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর দায়িত্ব থাকে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার। কিন্তু বাস্তবে বহু সময়েই কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন পরিচালনায় কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আদালতে পর্যন্ত অভিযোগ গিয়েছে। বিদেশি সংস্থাগুলো যেমন—ফ্রিডম হাউস, ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল—বারবার বলেছে, “বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।”

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর বিষয়ে নানা বিতর্ক আছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের দিকে এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে ওঠে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। কারণ হিসেবে তারা জানায়—এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভোট কারচুপি আরও সহজ হয়। অন্যদিকে সরকার পক্ষ বলে—ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন আরও দ্রুত, সহজ ও নির্ভুল হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মেলানি কেলার বলেন, “ইভিএম তখনই নিরাপদ, যখন এর পেছনের প্রোগ্রাম ও সার্ভার নিরাপদ হাতে থাকে। বাংলাদেশে এই বিশ্বাসের জায়গা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”

অবশ্য ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে—বিশেষ করে নির্বাচন পদ্ধতি ও সংবিধানের সংস্কারের দাবিতে—তা একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। তরুণ প্রজন্মের এই অভ্যুত্থান দেখিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও প্রত্যাশা রয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যম যেমন দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, দি গার্ডিয়ান, এবং দ্য ইকনমিস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, “বাংলাদেশে তরুণ সমাজ একটি নতুন রাজনৈতিক ন্যায়ের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তারা শুধু ভোট দিতে চায় না, তারা একটি অর্থবহ ভোট চায়।”

সবশেষে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস একটি জটিল, কিন্তু বর্ণাঢ্য অধ্যায়। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বারবার বাধাগ্রস্ত হলেও, এই জাতির জনগণ প্রতিবারই ভোটাধিকার রক্ষার জন্য লড়েছে। প্রতিটি নির্বাচন, তার আলো-আঁধারির গল্প, আসলে এই দেশের গণতন্ত্রচর্চার অনিবার্য অংশ। বিদেশি গবেষকরা বারবার বলেন—“বাংলাদেশের ভোটাররা কখনোই উদাসীন নন, বরং তারা প্রতিবার চান যেন তাদের কণ্ঠটি গণতন্ত্রের কানে পৌঁছে যায়।” সেই কণ্ঠ যেন সত্যিই মূল্য পায়—এটাই হোক বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনগুলোর প্রধান চাওয়া।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

বদহজম দূর করার উপায়

এক গ্লাস হালকা গরম পানি খেলে বদহজমের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। পানি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং পেটের ভেতরে জমে থাকা অতিরিক্ত এসিডকে পাতলা করে দেয়।

১৮ ঘণ্টা আগে

সাপ কেন আঁকাবাঁকা হয়ে পথ চলে?

সাপের মেরুদণ্ডে অসংখ্য হাড় আর পেশী আছে। এই হাড় ও পেশীর সাহায্যে তারা শরীর বাঁকায়, সঙ্কুচিত করে আবার প্রসারিত করে। একেকটা অংশ মাটিতে ধাক্কা দেয়, আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী মাটিও পাল্টা চাপ দিয়ে সাপকে সামনে এগিয়ে দেয়।

২ দিন আগে

গণতন্ত্রের গলদ

গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণই ক্ষমতার উৎস। সেটা আজকাল কেউ মানে বলে মনে হয় না। সে বাংলাদেশেই হোক বা যুক্তরাষ্ট্র—ক্ষমতাসীন নেতাদের সবাই নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে। গণতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য

২ দিন আগে

লাউয়ের পুষ্টিগুণ

লাউ মূলত ৯০ শতাংশেরও বেশি পানি দিয়ে তৈরি। তাই গরমকালে শরীর ঠান্ডা রাখতে এটি দারুণ কাজ করে। যারা নিয়মিত লাউ খান, তারা জানেন যে এটি হজমে সহায়ক, শরীরের অতিরিক্ত তাপ কমায় এবং প্রস্রাবের সমস্যা দূর করে।

২ দিন আগে