ওটস কেন খাবেন?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২: ২৬

সকালের নাশতায় অনেকেই এখন ‘ওটস’ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলছেন। কেউ কেউ আবার এটাকে “বিদেশি খাবার” বলে এড়িয়ে চলেন। কেউ বলেন, এতে ঠিকভাবে পেট ভরে না। আবার কেউ বলেন, ওটস খাওয়া মানে একঘেয়ে একটা জিনিস মুখে দেওয়া। কিন্তু আসলেই কি ওটস খাওয়া কেবল ট্রেন্ড না পেট ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিছু? আমরা যদি একবার এই খাবারটির পেছনের বিজ্ঞানটা বুঝে ফেলি, তাহলে হয়তো ওটসকে শুধু বিদেশি খাবার নয়, বরং নিজের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকারই অংশ করে ফেলতে চাইব।

ওটস বা বাংলায় যাকে বলে ‘জব’—এক ধরনের পূর্ণ শস্য, যেটা বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। এতে থাকে প্রচুর ফাইবার, বিশেষ করে ‘বিটা-গ্লুকান’ নামের এক ধরনের দ্রবণীয় আঁশ যা আমাদের শরীরের জন্য দারুণ উপকারী। এই বিটা-গ্লুকান শরীরে গিয়ে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

আমেরিকার হার্ভার্ড টি.এইচ. চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর পুষ্টিবিদ ড. ওয়াল্টার উইলেট বলেন, “ওটস এমন এক শস্য, যেটা নিয়মিত খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে এবং শরীরে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে। এর আঁশ হজমকে ধীর করে, ফলে রক্তে শর্করার ওঠানামা কম হয়।”

অনেকেই বলেন, সকালবেলায় খালি পেটে একটু হালকা খেয়ে রাস্তায় বের হলে পেট চট করে ক্ষুধায় কেঁপে ওঠে। ওটস এই সমস্যার চমৎকার সমাধান দিতে পারে। কারণ ওটস ধীরে হজম হয়। ফলে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে, ক্ষুধা লাগে না, অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতাও কমে যায়। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল-এর গবেষক ড. ক্লেয়ার কলিন্স, যিনি দীর্ঘদিন পুষ্টি এবং হজমবিষয়ক গবেষণায় যুক্ত, তিনি বলেন, “ওটস খেলে হরমোনালভাবে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ হয়। শরীরে যে ‘ঘ্রেলিন’ নামের ক্ষুধাবর্ধক হরমোন কাজ করে, ওটস তার পরিমাণ কমিয়ে আনে।”

শুধু পেট নয়, মস্তিষ্কের কাজেও ওটস ভালো প্রভাব ফেলে। এতে থাকে ভিটামিন বি, ম্যাগনেশিয়াম ও আয়রন—যা স্নায়ুর কাজ ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং মন-মেজাজ ভালো রাখতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত যারা সকালে ওটস খান, তাদের মনোযোগ ও মেমোরি ভালো থাকে এবং কাজের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্স বিভাগের গবেষক ড. লরেন রডারিক বলছেন, “ওটসের গ্লুকোজ শরীরে ধীরে প্রবেশ করে, যা মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে। এতে মনোযোগের ঘাটতি কম হয়।”

এবার আসি ওটসের আরও কিছু পুষ্টিগুণের কথায়। এতে থাকে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরের কোষগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ‘অ্যাভেনান্থ্রামাইড’ নামের বিশেষ একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শুধু ওটসেই পাওয়া যায়, যা রক্তনালিকে প্রশস্ত করে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির ফুড সায়েন্স গবেষক ড. জেমস হল্যান্ডার বলেন, “ওটসে থাকা এই প্রাকৃতিক উপাদানটি রক্তনালিতে নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসরণ বাড়ায়, যা চাপ কমাতে সহায়ক।” ফলে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাঁদের জন্য ওটস হতে পারে এক ধরনের প্রাকৃতিক ওষুধ।

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ওটস খাওয়ার মাধ্যমে বাড়ে। বিটা-গ্লুকান আমাদের শরীরের ইমিউন কোষগুলিকে সক্রিয় রাখে, ফলে সহজে ঠান্ডা-কাশি কিংবা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ হয় না। শিশুদের ক্ষেত্রে ওটস খাওয়ানো গেলে হজম শক্তি যেমন বাড়ে, তেমনি বাচ্চাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও মজবুত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির চাইল্ড নিউট্রিশন গবেষক ড. এমিলি গ্রিন বলছেন, “ছোট শিশুদের ডায়েটে ওটস যোগ করলে তাদের অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি হয়, যা সার্বিক হজম এবং ইমিউন সিস্টেমের জন্য উপকারী।”

তবে সব ভালো জিনিসের ব্যবহারেও কৌশল থাকা দরকার। অনেকেই সুগার মিশিয়ে ওটস খান, যেটা আসলে ওটসের উপকারের বিপরীত কাজ করে। চিনি মেশালে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা একধাক্কায় বেড়ে যায়। তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন—ওটস খেতে হলে ফল, বাদাম, দুধ বা সামান্য মধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এতে স্বাদ যেমন বাড়ে, তেমনি পুষ্টিগুণও বজায় থাকে।

আমাদের দেশে এখন অনেক ব্র্যান্ডের ওটস পাওয়া যায়—ইন্সট্যান্ট ওটস, রোল্ড ওটস, স্টিল কাট ওটস ইত্যাদি নামে। এর ভিন্নতা মূলত প্রস্তুত প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। স্টিল কাট ওটস একটু সময় নিয়ে রান্না করতে হয়, কিন্তু এতে আঁশের পরিমাণ বেশি থাকে। অন্যদিকে ইন্সট্যান্ট ওটস খুব দ্রুত তৈরি হয়, কিন্তু অনেক সময় এতে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ থাকায় পুষ্টিগুণ কিছুটা কমে যায়। পুষ্টিবিদদের মতে, যাদের সময় আছে, তারা সম্ভব হলে রোল্ড বা স্টিল কাট ওটস খাওয়ার চেষ্টা করুন।

অবশ্যই ওটস একাই সব সমস্যার সমাধান নয়। তবে এটি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকলে অনেক রোগের ঝুঁকি কমানো যায়, শরীর থাকে হালকা ও কর্মক্ষম। পেট, হৃদযন্ত্র, রক্তচাপ, রক্তে শর্করা, এমনকি মানসিক সুস্থতার প্রতিও ওটসের অবদান অস্বীকার করার মতো নয়।

শেষে বলা যায়, ওটসকে যদি একঘেয়ে খাবার মনে হয়, তবে সেটার দোষ ওটসের নয়, বরং রান্নার বৈচিত্র্যহীনতায়। একটু ফলের টুকরো, কিছু বাদাম, সামান্য দুধ কিংবা এক চিমটে দারচিনি—এইসব মিশিয়ে নিলেই ওটস হয়ে ওঠে সুস্বাদু আর পুষ্টিকর এক শক্তির উৎস। আজকের দিনে, যখন সবাই একটু স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ওটস হতে পারে এক সহজ, সস্তা এবং কার্যকর বন্ধু। আর এই বন্ধুত্ব গড়ার জন্য খুব বেশি কিছু প্রয়োজন নেই—শুধু একটু আগ্রহ আর রান্নার ছোট্ট রকমফের।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

দুপুরের মধ্যে ঝড়ের আভাস আবহাওয়া অধিদপ্তরের

ঢাকাসহ দেশের ১৬টি নদীবন্দরে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) সকাল ৯টা পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর জন্য দেওয়া এক পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

৯ দিন আগে

ই-গভর্ন্যান্সের ছোঁয়ায় যেভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে বাংলাদেশ

এই দীর্ঘ অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ব জুড়ে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ গড়ার উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ২০০১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি’র (ডব্লিউএসআইএস) আলোকে বাংলাদেশ ২০০২ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন করে।

৯ দিন আগে

কেন হয়েছিল ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ

মুল বিরোধের শেকড় ছিল হিমালয়ের বরফঢাকা সীমান্তে। ভারতের উত্তর-পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ (তৎকালীন নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার অ্যাজেন্সি) এবং উত্তর-পশ্চিমে লাদাখের আকসাই চিন অঞ্চল ছিল এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রস্থল। ব্রিটিশ শাসনামলে গঠিত ম্যাকমাহন রেখা নামের এক কৃত্রিম সীমারেখা চীন কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি।

৯ দিন আগে

রূপান্তরের দৃশ্যকল্প: এক ক্লিকে বাংলাদেশ

এই রূপান্তর শুরু হয়েছে নাগরিক সেবাকে কেন্দ্র করে। এখন অনেক সেবা অনলাইনে, সহজে ও দ্রুত সময়ে পাওয়া যায়। ই-পাসপোর্ট, ই-মিউটেশন, ই-ট্যাক্স রিটার্ন ও শিক্ষা সনদ যাচাই— এই চারটি উদাহরণই যথেষ্ট বোঝাতে, কীভাবে একটা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া আজ নাগরিকের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।

১০ দিন আগে