বিচিত্র
টানা পঞ্চান্ন বছর বিষপান করেছিলেন গুজরাটের এই শাসক

ইতিহাসের পাতায় অনেক শাসকের নাম ঝকঝক করে, কিন্তু কেউ কেউ তাদের অদ্ভুত অভ্যাসের জন্যও বিখ্যাত হয়ে থাকেন। এমনই একজন শাসক ছিলেন সুলতান মাহমুদ। তিনি ভারতের গুজরাট অঞ্চলের শাসক ছিলেন এবং ইতিহাসবিদদের চোখে এক রহস্যময় চরিত্র হয়ে আছেন। শুধু তাঁর রাজত্ব আর ন্যায়বিচার নয়, তাঁর জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত দিক ছিল—তিনি প্রতিদিন বিষ পান করতেন, তাও আবার দীর্ঘ ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন!
কিন্তু কেন তিনি বিষ খেতেন? এটা কি কোনো পাগলামি ছিল? নাকি এর পেছনে ছিল অন্য কোনো কারণ?
সুলতান মাহমুদের বিষ পান করার পেছনে ছিল এক চমকপ্রদ কৌশল। তাঁর মা, বিবি মুগালি, ছোটবেলা থেকেই তাকে অল্প অল্প করে বিষ খাওয়ানো শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট—তার শরীরে এমন প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা, যাতে যদি কখনো কোনো শত্রু তাঁকে বিষ দিয়ে মারতে চায়, তাহলে সেই বিষ যেন তাঁর শরীরে কোনো ক্ষতি না করতে পারে।
আজকের দিনে আমরা যেমন টিকাভ্যাকসিনের কথা বলি, ঠিক তেমনি এটা ছিল বিষের বিরুদ্ধে একধরনের "প্রাকৃতিক টিকা"। সুলতান মাহমুদের শরীর বিষের সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে কোনো সাধারণ বিষ প্রয়োগ তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারত না।
এই আশ্চর্য অভ্যাসের কথা শুধু গল্প-কথায় সীমাবদ্ধ ছিল না, ইতিহাসের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লেখক ও পর্যটকও এর উল্লেখ করেছেন। ইতালির বিখ্যাত পরিব্রাজক ও দুঃসাহসিক অভিযাত্রী লুডোভিকো ডি ভার্থিমা লিখেছেন, "আমার সঙ্গী যখন জানতে চাইল কীভাবে সুলতানদের বিষ প্রয়োগ করা হতো, তখন কিছু স্থানীয় বণিক জানায় যে সুলতানের বাবা ছোটবেলা থেকেই তাঁকে বিষ খাওয়াতে শুরু করেছিলেন।"
পর্তুগিজ লেখক দুয়ার্তে বারবোসাও একই রকম মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, সুলতান মাহমুদ ছোট ছোট মাত্রায় বিষ গ্রহণ করতেন, যাতে শত্রুরা যদি কখনো তাঁকে বিষ দেয়, তবুও তাঁর কিছু না হয়।
ভার্থিমা ও বারবোসার লেখায় আরও জানা যায়, শুধু সুলতান মাহমুদই নন, গুজরাটের অন্যান্য শাসকরাও ছোটবেলা থেকে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। তাদের মনে হত, শক্তিশালী শাসক হতে গেলে শুধু বাহিনীর জোর বা অস্ত্রের শক্তি যথেষ্ট নয়, নিজের শরীরকেও বিষের মত গোপন শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারার যোগ্যতা থাকতে হবে।
ভাবুন তো, প্রতিদিন অল্প অল্প করে বিষ খাওয়া কতটা বিপজ্জনক ছিল! সামান্য ভুল হলেই মৃত্যু নিশ্চিত। তবে তখনকার সময়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এতটাই ভয়ংকর ছিল যে এমন ঝুঁকি নেয়ার কথাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল। অনেক সময় রাজপ্রাসাদের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতকতা হত, খাদ্য বা পানীয়ের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হত। তাই নিজের শরীরকে বিষ প্রতিরোধী করে তোলা ছিল বেঁচে থাকার এক অভিনব কৌশল।
আজকের দুনিয়ায় বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা এখন জানি, বিষের প্রতি শরীরের সহনশীলতা তৈরি করা যায়, তবে সেটা খুবই বিপজ্জনক এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ছাড়া প্রায় অসম্ভব। তবু ইতিহাসের এই অধ্যায় আমাদের দেখায়, অতীতের শাসকেরা কী ভীষণ বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের রক্ষা করতেন।
সুলতান মাহমুদের প্রতিদিন বিষ পান করার অভ্যাস শুধু তাঁর ব্যক্তিগত কাহিনি নয়, বরং একটি সময়ের কথা বলে, যখন রাজা-বাদশাহদের জীবন ছিল সর্বক্ষণ বিপদের মুখে। নিজের জীবন রক্ষায় তাঁরা কত অদ্ভুত এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতেন।